গত ১০ বছরে ১৪০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে জীবনদায়ী ওষুধের এবং ইতিমধ্যেই সবাই জেনেছেন যে আজ থেকেই ৯০০টা জীবনদায়ী, জরুরি ওষুধের দাম বেড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অ্যানাস্থেশিয়া, অ্যান্টি-অ্যালার্জি, নার্ভের এবং কান, নাক ও গলার বিভিন্ন রোগের ওষুধ। আছে সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ। এইসব ওষুধের দাম ১.৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। কারা বাড়াল? ওষুধ কোম্পানিগুলো বাড়ালে সব্বাই মিলে একদিনে এরকমভাবে তো বাড়াতে পারে না, কাজেই আসুন দেখা যাক এই বৃদ্ধি কী ভাবে হয়, কারা করেন। ভারতে জরুরি ওষুধের দাম ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি (NPPA) নিয়ন্ত্রণ করে। এটা সরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকেই এই সংস্থা কাজ করে। সাধারণত, প্রতি বছর এই দাম সংশোধন করা হয় এবং এই দামের পরিবর্তন আগের বছরের পাইকারি মূল্য কত ছিল, তার ভিত্তিতেই হয়। বলা হয় যে মুদ্রাস্ফীতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কারণগুলোর জন্য ওষুধের দামে এক নিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি জরুরি। মানে যাঁরা ওষুধ তৈরি করছেন তাঁদের ওষুধ তৈরির খরচ, তাঁদের কাঁচামালের খরচ আর মুদ্রাস্ফিতীকে সামলানোর জন্যই দাম বাড়ানো হয়।
আরও পড়ুন: Aajke | লন্ডনের ষড়যন্ত্রে বিজেপি সিপিএম হাত মিলিয়েছে
১ এপ্রিল, ২০২৫ থেকে কার্যকর হওয়া জরুরি ওষুধের ডব্লিউপিআই-ভিত্তিক বৃদ্ধি হচ্ছে ১.৭৪ শতাংশ। এর মানে এরকমও নয় যে ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম আরও বাড়াবে না, আসলে সরকারি কেনাবেচার জন্য এই দাম ঠিক করে দেওয়া হয়, এর চেয়ে ঢের ঢের বেশি দামেই তাঁরা ওষুধ বিক্রি করেন, তাঁদের এই বৃদ্ধি সরকারের এই বৃদ্ধির উপরেই নির্ভর করে, গত বছরে এই বৃদ্ধি ছিল মাত্র.৫৫ শতাংশ এবারে তিনগুণের খানিক বেশি ১.৭৪ শতাংশ। এবং মাথায় রাখুন এরপরে ব্র্যান্ডেড ওষুধের দাম রকেটের মতই বাড়বে। অতএব আপনি অসুস্থ হলে আপনার কাছে দুটো উপায় আছে, ওষুধের অভাবে মারা যাওয়া, দু’ নম্বর হল জয় শ্রীরাম বলে বসে থাকা। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে মোদিজির কোপ এবারে অসুস্থদের ঘাড়ে।
যখন ভাবছেন যে ১.৭৪ শতাংশ হারে ওষুধের দাম বেড়েছে, তখন জেনে রাখুন ওটা একটা গড় হিসেব, এবং ওটা মাত্র এ বছরের। ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি অক্টোবর ২০২৪-এ আটটি ওষুধের এগারোটি জরুরি তালিকাভুক্ত ফর্মুলেশনের সর্বোচ্চ দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যাবে বলে জানিয়েছিল আর সেই হিসেবেই দাম বেড়েছিল। সাধারণ বছরে একবার যখন ওষুধের দাম বাড়ানোর ঘোষণা করা হয় তখন তা এক অঙ্কের শতাংশে থাকে, যা এবারে ১.৭৪ শতাংশ কিন্তু বছরের মধ্যিখানেও জরুরি ভিত্তিতে যে দাম বাড়ানো হয় তা কিন্তু আলাদা, যেমন ২০২৪-এ ৮টা ওষুধের দাম বাড়ান হয়েছিল। যে আটটা ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছিল সেগুলো হল: বেনজিল পেনিসিলিন, অ্যাট্রোপিন ইনজেকশন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন পাউডার ফর ইনজেকশন, সালবুটামল ট্যাবলেট এবং রেসপিরেটর সলিউশন, পিলোকার্পিন ড্রপস, সেফাড্রক্সিল ট্যাবলেট, ডেসফেরিওক্সামিন ইনজেকশন এবং লিথিয়াম ট্যাবলেট। এই ওষুধগুলো ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, হাঁপানি ও যক্ষ্মার মতো শ্বাসকষ্টের রোগ, গ্লুকোমার মতো চোখের রোগ, থ্যালাসেমিয়ার মতো রক্তের রোগ এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়, এবং এর আগে ২০১৯ এবং ২০২১ সালেও বছরের মধ্যিখানেই এইভাবেই ৫০ শতাংশের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল। মানে কেবল মাত্র বার্ষিক মূল্যনিয়ন্ত্রণ করা হবে এরকম নয়, ওষুধের দাম বছরের যে কোনও সময়েই এখন বাড়ানো হচ্ছে। আর অজুহাত কাঁচা মালের দাম বাড়া, রফতানি শুল্ক বৃদ্ধি, অন্যান্য খাতে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়। আর এসব দাম ইত্যাদি বাড়ার ক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভুলেও একটা কথাও বলেন না, তিনি এসব বিষয়ে চুপ করে থাকাটাই পছন্দ করেন। যেহেতু সরকারি সংস্থাই এই দাম বাড়াচ্ছে, তাই আপনার মনে হতেই পারে যে তাহলে ওষুধ কোম্পানিগুলোর হাল খুব খারাপ, তাদের খানিক সাহায্য করার জন্যই দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে মোদিজির সরকার। তাহলে আসুন দেখা যাক আমাদের দেশের প্রথম পাঁচটা ওষুধের কোম্পানি গত ১০ বছরে কেমন আয় করেছে। জেনে রাখুন ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেট পুরো দুনিয়ার হেলথকেয়ারে বড় জায়গা করে নিয়েছে বেশ কিছু বছর ধরে। তাদের এই বাজারটা হু হু করেই বাড়ছে। হিসেব বলছে ২০৩০ সাল নাগাদ এটা ১২০-১৩০ বিলিয়ন ডলার আর ২০৪৭ নাগাদ ৪০০-৪৫০ বিলিয়ন ডলার হয়ে যাবে। এই বাড়ার পেছনে অনেক কারণ আছে—জীবনযাত্রার রোগ বাড়ছে, দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে, স্বাস্থ্যের দিকে বেশি নজর দেওয়ার ঝোঁক বাড়ছে, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ফলে এক ধরনের কৃত্রিম চাহিদা তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া, ভারত জেনেরিক ওষুধের সবচেয়ে বড় এক্সপোর্টার। গত দশ বছরে (২০১৫-২০২৪) পাঁচটা বড় ফার্মা কোম্পানি—সান ফার্মা, সিপলা, ড. রেড্ডিস, ডিভিস, আর টরেন্ট-এর নেট প্রফিট বাড়ার হিসেবে দেখা যায় এই সেক্টরে বাড়ার ট্রেন্ড অত্যন্ত ভালো। বাড়ার হার আলাদা হলেও, সবাই ভালরকমের লাভের মুখ দেখেছে। সিপলা আর ড. রেড্ডিস বেশি বেড়েছে। সিপলা ২৫২ শতাংশ, ড. রেড্ডিস ১৫১ শতাংশ, টরেন্ট ১২০ শতাংশ, সান ফার্মা ১১১ শতাংশ, ডিভিস ল্যাবরেটরির লাভ ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। তাহলে শেষমেশ কী দাঁড়াল? গত ১০ বছরে দেশের সবথেকে বড় হাউসগুলো সুপার প্রফিটে চলেছে এবং পাশাপাশি খুচরো জীবনদায়ী ওষুধের দাম ১৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বিরাট লাভেই চলছে, তাদের সম্পদ বাড়ছে, অথচ নিয়ম মাফিক বছরে একবার নয়, বছরের মধ্যিখানেও ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে, তা গত দশ বছরে ১৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অথচ মোদিজির মুখে সবার স্বাস্থ্য ইত্যাদি কথা শোনা যাচ্ছে, আপনাদের কথা শুনতে চাই। শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সভ্যতার নামে ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গল বানানো হচ্ছে, এক নয়া জীবনযাত্রা ডেকে আনছে নানান ওষুধ, পৃথিবীজুড়েই সেই তাল বুঝেই বেড়ে উঠছে ওষুধ কোম্পানি, আর বাড়ছে তাদের সম্পদ। আমাদের দেশ তার বাইরে নয়, বরং আরও খুল্লমখুল্লা লুঠপাট চলছে আমাদের দেশে, সস্তার শ্রমে কাঁচামাল এনে ওষুধ রফতানি করে কোটি কোটি ডলার কামানো ওষুধের কোম্পানিগুলো ফুলে ফেঁপে লাল, আর এদিকে গত ১০ বছরে ওষুধের দাম বেড়েছে ১৪০ শতাংশ, সাধারণ মানুষজনের নাভিশ্বাস উঠছে এই বেড়ে যাওয়া ওষুধের হ্যাপা সামাল দিতে। মোদিজি বলেছিলেন সবকা সাথ সবকা বিকাশ, এ কেমন বিকাশ যেখানে অসুস্থ মানুষ ওষুধ পর্যন্ত পাবে না?