সেই ১৯৮১ সালে যখন মহমেডান স্পোর্টিং কলকাতা লিগ জয় করেছিল, তখন পৃথিবীতে অনেক কিছুই ছিল না। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, বলিউডের এক নম্বর তারকার নাম অমিতাভ বচ্চন, ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সুনীল গাভাসকর আর পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তখন মোবাইল ফোন ছিল না, আই পি এল ব্যাপারটা মানুষের মনেই আসেনি, ফেস বুক, টুইটার শব্দগুলি দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায়নি। বি জে পি-র সবে জন্ম হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রসের কথা কেউ ভাবেনি। এই প্রেক্ষিতে বুধবার মহমেডান যখন ২০২১ সালের কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হল তখন ভারতবর্ষে অনেক কিছুই বদলেছে। কিন্তু একশো তিরিশ বছরের ক্লাবের ঘরে আর কলকাতা লিগটা ঢোকেনি। এত দিনে সেই খরা কাটল। একজন রাশিয়ার কোচের হাত ধরে। যাঁর নাম আন্দ্রে চেরনিশভ। মোহনবাগান এবং ইস্ট বেঙ্গল বিদেশি কোচের হাত ধরে লিগ চ্যাম্পিয়ন হলেও মহমেডানে বিদেশি কোচের সাহায্যে লিগ জয় এই প্রথম। আসলে ১৯৮১ সালে কলকাতা ফুটবলে বিদেশিদের এত রমরমা ছিল না। কোচ তো তাই দূর অস্ত। সেবারের কোচ ছিলেন আব্দ্স সাত্তার। বড় ফুটবলার এবং ভাল মানুষ।
সেবারে মহমেডান ছিল সত্যিই তারকাখচিত দল। গোলে ভাষ্কর গাঙ্গুলি, চার ডিফেন্ডার চিম্ময় চ্যাটার্জি, মইদুল ইসলাম,রমেন ভট্টাচার্য,অলোক মুখার্জি। মাঝ মাঠে প্রসূন ব্যানার্জি এবং প্রশান্ত ব্যানার্জি। ফরোয়ার্ডে মানস ভট্টাচার্য, মহম্মদ আকবর, সাব্বির আলি এবং বিদেশ বোস। অধিনায়ক ছিলেন মইদুল ইসলাম। এবারের লিগে মোহনবাগান এবং ইস্ট বেঙ্গল ছিল না। সেবার কিন্তু দুই প্রধানই ছিল। এবং তাদের টিমও কম শক্তিশালী ছিল না। তাই সেবার মহমেডানের লিগ জয় সব দিক থেকেই ছিল অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। এবার কি তাহলে মহমেডান ফাঁকতালে লিগ চ্যাম্পিয়ন হল?
একেবারেই না। এবার মহমেডানকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে লিগ জিততে হয়েছে। লিগের শুরুর দিকে পর পর দুটি ম্যাচ হেরে মহমেডানের নক আউটে কোয়ালিফাই করা নিয়েই সংশয় ছিল। এবার তো শুধু লিগ নয়। লিগ কাম নক আউট। লিগের মধ্যেই ডুরান্ড কাপ খেলতে হয়েছে মহমেডানকে। তাতে মহমেডান চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও রানার্স হয়েছে ফাইনালে এফ সি গোয়ার কাছে হেরে। কিন্তু সেই ডুরান্ড খেলতে খেলতেই মহমেডান টিমটাকে গুছিয়ে নিতে পেরেছিল। যার ফলশ্রুতি লিগে সেরা হওয়া। বুধবার ফাইনালে তারা ১-০ গোলে হারাল রেলওয়ে এফ সি-কে। ম্যাচের তিন মিনিটে গোলটি করলেন মার্কাস জোসেফ। মহমেডানের দ্বিতীয় বিদেশি হলেন নিকোলা স্টোজানোকভিচ। লিগ পর্যায়ে ছয় ম্যাচে দশ পয়েন্ট নিয়ে মহমেডান নক আউটে গিয়েছিল। এর পর কোয়ার্টার ফাইনালে ভবানীপুরকে ৭-০ গোলে এবং সেমিফাইনালে ইউনাইটেড স্পোর্টসকে ১-০ গোলে হারিয়ে তারা ফাইনালে উঠৈছিল। এবার ফাইনালে রেলওয়ে এফ সি-কে হারিয়ে চল্লিশ বছর পর চ্যাম্পিয়ন হওয়া। মাঝের এই চল্লিশ বছরে মহমেডান ভারতের সব টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ফেডারেশন কাপ, রোভার্স কাপ, ডুরান্ড কাপ, আই এফ এ শিল্ড। একবার তো (১৯৯১ সালে) তারা চারটে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। নাগজি, স্ট্যাফোর্ড, কলিঙ্গ এবং বরদলৈ। কিন্তু কিছুতেই লিগটা তাদের তাঁবুতে ঢুকছিল না। অবশেষে সেই দৈন্যতা কাটল।
এই সাফল্যে শেখ ফৈয়াজের নেতৃত্বে মহমেডানের সব ফুটবলারের কৃতিত্ব আছে। অসামান্য ভূমিকা আছে কোচ চেরনিশভের। তবে মহমেডান কর্তাদেরও কৃতিত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে ফুটবল সচিব দীপেন্দু বিশ্বাসের। জাতীয় ফুটবল দলের এই প্রাক্তন স্ট্রাইকার মহমেডানের জন্য দিন-রাত এক করে খেটেছেন। এর আগে দুই প্রধানের হয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কিন্তু অধরা ছিল মহমেডানের হয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। বুধবার লিগের ট্রফিটাতে দীপেন্দু হাত ছোঁয়াতে পারলেন। তাঁর ফুটবল জীবনে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
এখানে আরও একটা ব্যাপার উল্লেখ করতে হবে। কলকাতা ফুটবলের বাকি দুই প্রধান ইনভেস্টরের হাতে তাদের দুটো দলকে তুলে দিয়েছে। টিম চ্যাম্পিয়ন হলে তাদের দুই হাত তুলে নৃত্য করা ছাড় কোনও কাজ নেই। মহমেডান কিন্তু সে পথে হাঁটেনি। তাদেরও ইনভেস্টর আছে। তারাও টিম গড়তে এবং চালাতে অনেক টাকা খরচ করেছে। বুধবারই যেমন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা উপহার দিয়েছে প্লেয়ারদের। কিন্তু টিমের রাশ কিন্তু মহমেডান কর্তাদের হাতেই ছিল। এই লিগ খেতাব তাই মহমেডানের সবার। ফুটবলার, কোচ, কর্তা, স্পনসর–সবার। তবে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে মহমেডানের লক্ষ লক্ষ সমর্থকের। যারা আজ খুবই খুশি মনে বলবে মহমেডান তুমকো লাখো সেলাম।
চল্লিশ বছর পর কলকাতা লিগ জয়, মহমেডান তুমকো লাখো সেলাম
Follow Us :