সাংবাদিকদের অনেকের মনে আছে, বয়স্ক লোকজনের মনে আছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা বড় ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ভোটার কার্ড। আমরা এখন নির্বাচন কমিশনার নিয়ে কত আলোচনা করি, ১৯৯০-এর আগে নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন কমিশনার নিয়ে মানুষের, সংবাদমাধ্যমের কোনও আগ্রহ ছিল না। ৯০-এর ডিসেম্বরে টি এন সেশন এই পদে এসে বসলেন এবং শুরু হল হলচল। তিনি বললেন ভোটার কার্ড করব, প্রত্যেকের ভোটার কার্ড থাকবে। সে কী হাসি, সে কী খিল্লি। বাম ছাত্র যুবরা রাস্তাতে ভাষণ দিচ্ছেন, মাথার উপর ছাদ নেই যাদের, ঝড়ে বন্যায় যাঁদের ঘর উজাড় হয়, তাঁরা রাখবেন কোথায় এই এপিক কার্ড? মাথাতেও নেই এরই মধ্যে বাম সরকার ক্ষমতায় নয় নয় করে ২০ বছর। জ্যোতি বসু বলেই দিলেন এই সেশন হলেন একজন মেগালোম্যানিয়াক। ওদিকে হাতে ইস্যু পেয়ে গেছেন মমতা, অতএব রাস্তায় ফায়ারব্র্যান্ড নেত্রীর স্লোগান, নো এপিক, নো ভোট, ভোটার কার্ড ছাড়া ভোট হবে না। এবং শেষমেশ ২১ জুলাই ১৯৯৩, ১৩ জনের মৃত্যু আর এসব পেরিয়ে দেশের মানুষ পেল এপিক কার্ড, ভোটার কার্ড। হ্যাঁ, এটা ছিল মমতার প্রথম জয় যা সারা ভারতের ইতিহাসে লেখা থাকবে। শুরুর দিকে ছবি নিয়ে, ভোটার কার্ড থাকা না থাকা নিয়ে, এপিক কার্ড ছাড়া ভোট দেওয়া যাবে না এসব নিয়ে বিস্তর আইনি লড়াই হয়েছে, রাস্তায় লড়াই চলেছে, কিন্তু শেষমেশ জ্যোতি বসুর সেই মেগালোম্যানিয়াক সেশন সাহেব জিতে গেছেন, প্রত্যেকের হাতে আছে ভোটার কার্ড। এই জয় এসেছিল কিন্তু এই জয়ই মমতাকে সিপিএম-এর সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আর সেই লড়াইয়ের কথাই বিষয় আজকে।
আরও পড়ুন: Aajke | আরজি কর, যাদবপুর, এত মিথ্যে কেন?
ভোটার কার্ড হওয়ার পরেও কিছুদিন তানানানা করার পরে তা লাগু হল বটে কিন্তু তখনও গ্রামবাংলাতে সিপিএমের জমি যথেষ্ট শক্ত, প্রান্তিক চাষি, মুসলমান চাষি, গরিব মানুষ তখনও সিপিএমের পক্ষে। ঠিক সেই সময়ে আবার এক নতুন লড়াই শুরু করলেন মমতা। সিপিএমের তাড়া ছিল শিল্পায়নের, কারণ ততদিনে দল তো আর পুওরেস্ট অফ দ্য পুওর নয়, দল তখন মধ্যবিত্তের, কাজেই শিল্প চাই, চাকরি চাই, তাড়াতাড়ি চাই।
বুদ্ধদেব সেই তাড়াহুড়োকে এক আত্মঘাতী লড়াইয়ের দিকে নিয়ে গেলেন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে শিল্পায়ন। আসলে কী? নকলে কী? গলদ কোথায় ছিল? ইত্যাদি তর্ক-বিতর্ক আছে, থাকবে, কিন্তু পাবলিক পার্সেপশন, গরিবগুর্বো মানুষেরা ভাবলেন জমি চলে যাবে, মুসলমান দরিদ্র চাষিরা ভাবলেন বুদ্ধের সরকার আমাদের জমি কেড়ে নিতে চায়, সেখান থেকে শুরু হল শেষ হল নন্দীগ্রামে গুলি চালানোতে, ওই ১৪ মার্চ, ভবিষ্যৎ স্থির হয়ে গিয়েছিল সিপিএমের। মমতা জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে যে লড়াই গড়ে তুলেছিলেন তা কেবল ভারতে নয়, বিশ্বের শিল্পায়নের তত্ত্বের বিরুদ্ধে এক বড় লড়াই হয়ে থাকল আর সেই লড়াই সিপিএমকে এক ঝটকায় ২৩৫ থেকে ৩৫ আর তার পরে শূন্যতে এনে নামাল। হ্যাঁ, এটা ছিল মমতার দ্বিতীয় বড় জয়। এবারে তৃতীয় জয়ের কথা। দেশ জুড়ে বিরোধীরা মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লির নির্বাচনের হারকে এক ষড়যন্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। বলেই চলেছেন ভোটার লিস্টে কারচুপি করে আমাদের হারানো হল। ওদিকে তাঁদের যাবতীয় অভিযোগকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিচ্ছে, কোথায়? অভিযোগটা কী? হ্যাঁ, দেশের বিরোধী দল না দিয়েছে প্রমাণ, না জানাতে পেরেছে তাঁদের অভিযোগ, কাজেই নির্বাচন কমিশন সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এমন কিছুই তো হয়নি। না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল অভিযোগ করেননি, নাম আর ভোটার লিস্ট ধরে বেশ কিছু গন্ডগোল তুলে ধরেছেন, এই নাম, এই তালিকা, এই হল ভুয়ো ভোটার। এবং এবারে সেই অভিযোগ নির্বাচন কমিশন উড়িয়ে দিতে পারেনি, উল্টে তাঁরা জানিয়েছেন যে আগামী ৩ মাসের মধ্যে এই গন্ডগোল তাঁরা ঠিক করে দেবেন। হ্যাঁ, সারা ভারতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার এক জয় এনে দিলেন বিরোধীদের কাছে যা ইতিহাস মনে রাখবে। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগের পরে নির্বাচন কমিশন স্বীকার করে নিয়েছে যে ভোটার লিস্টে গড়বড় ছিল, ভোটার লিস্টে ভুয়ো ভোটার ছিল, ছিল বলেই তারা জানিয়েছে যে আগামী মাস তিনেকের মধ্যে তা ঠিক করা হবে। এটা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০২৬-এর লড়াইতে অনেকটা আগে নিয়ে গেল না? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
কতটা গড়বড় ছিল? সেই গড়বড়ের ফলে ভোটের ফলাফল কতটা অন্যরকম হয়ে যেতে পারত? সেসব বিরাট আলোচনা, তা চলতেই থাকবে, কিন্তু পপুলার পার্সেপশন, সাধারণ ভোটারদের ধারণা হল এই ভোটার লিস্টের ভুয়ো ভোটারদের কাজে লাগিয়েই বিজেপি মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লি জিতেছে, বাংলাতে সেই ঘাপলা করার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধরে ফেলেছেন। হ্যাঁ, সেখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতে গেলেন, অনেক এগিয়ে গেলেন ২০২৬-এর হিসেবে।