হিটলারের উত্থানের শেষ পর্যায়ে এক আগুন লাগানোর ঘটনা ছিল, অনেকেরই মনে আছে। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল রাইখস্ট্যাগ, জার্মানির সংসদ ভবন জ্বলছে। তারপর কী আশ্চর্য যে আগুন ধরিয়েছে তাকেও পাওয়া গ্যালো, সে নাকি এক কমিউনিস্ট, এবং তারপরে দেশজুড়ে কমিউনিস্টদের জেলে পোরা হল, তারপর যারা সামান্যতম সহানুভূতি দেখিয়েছে তাদের, তারপর ইহুদি তারপর গণতান্ত্রিক মানুষজনকে মারা হল, জেলে পোরা হল, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হল। এসব সব্বাই জানেন। তারপর থেকে এই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এক অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক মিথ্যে, এক গুজবকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া। বিজেপি এই কাজ সফলভাবে করেছে। ৩৭০ ধারা আমাদের দেশের মধ্যে এক রাজ্যকে আলাদা করে স্বাধীন করে রেখেছে, আপনারা এই ধারা আছে বলেই কাশ্মীরে জমি কিনতে পারেন না, ইত্যাদি যখন বলছেন তখন অর্ধেক কথা বলছেন না, বলছেন না যে এমনকী এই বাংলাতেও আদিবাসীদের জমি কেউ কিনতে পারে না, বলছেন না যে এই দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে ৩৭১ ধারা রয়েছে যা একই রকম। মানে বলতে চাইছি এরকম মিথ্যে প্রচার, গুজব ছড়ানো দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এক অঙ্গ ছিল বহুকাল। মাঠে ঘাটে জিজ্ঞেস করুন, রামা, শ্যামা, যদু মধুদের অন্তত তিনজন বিশ্বাস করেন যে মুসলমানেরা জনসংখ্যার দিক দিয়ে এমন বাড়ছে যে আর ক’দিন পরেই তারা হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবে। এই গণধারণা কিন্তু ওই আরএসএস-বিজেপির প্রচারের ফলেই সম্ভব হয়েছে, বা ধরুন এই ভারতের প্রতি ১০০ জনের ৬০ জন বলেন, মানেন যে হিন্দি ভারতের রাষ্ট্র ভাষা, যদিও তা ডাহা মিথ্যে, কিন্তু ওই যে প্রচার, তার ফলেই গল্পের গরু অনায়াসে গাছে চড়েছে। কিন্তু আজ সেই মিথ্যে বামেদের মুখে, সিপিএমের মুখে, সিপিএম অনায়াসে ১৫০ গ্রাম বীর্যের তত্ত্বকে হাওয়ায় ভাসিয়ে আন্দোলনে নামে, সেটাই আজকে বিষয় আজকে, আরজি কর, যাদবপুর, এত মিথ্যে কেন?
ধরুন আরজি কর। ঘটনা কি কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল? নিজের কর্মক্ষেত্রে এক ডাক্তার ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে, মহানগরের বুকে। এই ইস্যুই কি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল না? রাশি রাশি মিথ্যে, সুনামির মতো মিথ্যে এনে হাজির করা হল। ১৫০ গ্রাম বীর্য থেকে বাথরুম ভেঙে প্রমাণ লোপাট করা, পেলভিক বোন ভাঙা থেকে গণধর্ষণের সপক্ষে হাজার হাজার মিথ্যে আনা হল।
আরও পড়ুন: Aajke | দেশের বাইরে আর এক দেশ, যাদবপুর, যাদবপুর
এমনও নয় যে তাঁরা মিথ্যেটা জানতেন না, ১০০ শতাংশ জানতেন কিন্তু ভেবেছিলেন মিথ্যে দিয়ে আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলা যাবে। হলটা কী? মানুষ আপাতত সত্যি বললেও বিশ্বাস করছে না। ধরুন যাদবপুর, বিরাট অন্যায় কোনও এক সংগঠনের সম্মেলনে ঢুকে তা বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা, তবুও মন্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় যদি দুজন ছাত্র আহত হয় তাহলে ছাত্ররা, রাজ্যের মানুষ তার প্রতিবাদ করবেন না? প্রসাদজীবী, ভাতাজীবীদের বাদই দিন, এক যুগ ধরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই, মানুষ তার বিরোধিতা করবেন না? কিন্তু সামনে রাখা হল একটা ছবি, যেখানে গাড়ির চাকার তলায় পড়ে আছে এক শরীর, দেখলেই গা শিউরে উঠবে, হ্যাঁ এক প্রচণ্ড অভিঘাত তৈরি হবে, আর সেটা তৈরি করার জন্যই কি এরকম এক ফোটোশপ করা ছবি আমদানি করতে হল সিপিএম বা এসএফআইকে? এর কি কোনও দরকার ছিল? প্রথম অভিঘাতটা সইয়ে নিয়েই মানুষ তো জানতে চাইবে যে ছেলেটির মৃতদেহ কোথায়? কারণ ওইভাবে এক গাড়ির তলায় পড়লে সে হয় সেখানেই মারা যাবে, না হলে হাসপাতালে। খুউউউব কপালজোর থাকলে হাড়গোড় ভেঙে পড়ে থাকবে হাসপাতালে। না, এই দুই অপশনের বাইরে আর কিছুই হতে পারে না। এবং কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হলে এরকম মিথ্যে নিয়ে মাঠে নামা যায়? সেখানে প্রায় প্রত্যেক মিডিয়া ছিল, সামনে পেছন থেকে বহু ফুটেজ আছে, কিন্তু কোথাও এরকম কোনও ছবি নেই, তাহলে এক বিপ্লবী দলের বিপ্লবী মুখপাত্র এই ছবিটাকে তাদের খবরের কাগজের, গণশক্তির প্রথম পাতায় ছাপলেন কেন? এই ২০০ শতাংশ মিথ্যেকে এনে হাজির করে কোন লাভটা তাদের হল? এখন প্রত্যেকে জবাব চাইছে এবং সিপিএম বা এসএফআই-এর কচি নেতারা তোতলাচ্ছেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে গণশক্তি কাগজের প্রথম পাতায় যে ফোটোশপ করা, বানানো, ফেক গাড়িতে চাপা পড়ার ছবি ছাপানো হয়েছিল, তার কারণ কী? এই ছবি ছেপে আবার ওই সিপিএম দলের নেতারা কি নিজেদেরই মুখ পোড়ালেন না? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন?
আন্দোলন সংগ্রাম, লড়াই এক সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই করা হয়, ইতিহাসে সেই আন্দোলন টিকে আছে, সেই আন্দোলন নিয়েই চর্চা হয় যা মানুষের সমাজের রাষ্ট্রের এক সত্যিকে তুলে ধরে। এক ভাষার লড়াই এক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়, এক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই এক গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এই দেড়শো গ্রাম বীর্য বা ফোটোশপ করা ছবিগুলো ডাস্টবিনেই ঠাইঁ পায়, ইতিহাসে তাদের জায়গা হয় না। এটা জানার পরেও আন্দোলনকে হঠাৎই তীব্র করার জন্য সুনামির মতো যারা মিথ্যে বলেন তাঁরা আসলে সেই আন্দোলনের বিরুদ্ধেই কাজ করেন, সেই আন্দোলনের বিপক্ষেই থাকেন।