বাংলার মানুষ জানেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলগ কলেজ মমতাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বিষয় ছিল ‘সামাজিক উন্নয়ন: নারী, শিশু ও প্রান্তিক অংশের উন্নয়ন’। খুব স্বাভাবিকভাবেই মমতার বক্তৃতায় আসে কলকাতায় এখনকার তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের বিনিয়োগের কথা। আর সেই সময়েই সভাঘরের একেবারে পিছন থেকে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেই গুঞ্জন হোক কলরব হয়ে উঠল। দর্শকাসনের বাকিরাও দাঁড়িয়ে পড়েন। এবং এদিন আমরা এক অন্য মমতাকে দেখলাম। হাতেগোনা কয়েক জন পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। মমতা যখন তাঁদের জবাব দিচ্ছেন তখন হাততালিতে ফেটে পড়ছিল সেমিনার হল। অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছেন, যাঁরা গোলমাল করেছেন, তাঁরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বা গবেষক নন। সকলেই বহিরাগত। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়, এটা একটা বিক্ষোভ, এসএফআই এই বিক্ষোভ সংগঠিত করেই শুধু তাও নয়, তাঁরা এই বিক্ষোভের কথা ফলাও করে লিখেছেন তাঁদের সমাজ মাধ্যমে, তাঁদের এক কচি নেতা দেবাঞ্জন দে ফেসবুকে লিখেছেন “টেস্ট পেপারে পড়ে গেছে যাদবপুর, মেদিনীপুর, এসে গেছে অক্সফোর্ড! দৌড় করানো একেই বলে। এসএফআই ইউকে-র কমরেডদের বাংলার ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে সংগ্রামী অভিনন্দন।” মানে এক এসএফআই নেতা বলছেন, তাঁরা মমতা ব্যানার্জিকে দৌড় করাচ্ছেন। বাকি আরও কিছু কচি নেতাদের, কিছু ফেবু সিপিএম অনির্বাণ সেনগুপ্ত অভিজিৎ সেনগুপ্তদের উল্লাস ধরে না, যদিও সেসব দেখতে পাবেন না, কারণ তাঁরা তাঁদের প্রোফাইল ভয়ে লক করে রাখেন। তো যাই হোক, এই ঘটনা ঘটিয়েছে এসএফআই, সিপিএম-এর ছাত্র সংগঠন, তাঁদেরই দাবি তাঁরা মমতাকে দৌড় করাবেন কিন্তু সমস্যা হল এর পরে, সামলাতে পারবেন তো? আর সেটাই আমাদের আজকের বিষয় আজকে। অক্সফোর্ডে যা করলেন, সেটার প্রতিক্রিয়া সামলাতে পারবেন তো কমরেডস?
বহু বছর আগে, সবে সবে তৃণমূল সরকার করেছে, শুরুর দিন থেকেই বদলা নয় বদল চাই বলার পরে এদিকে সেদিকে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও খুব বড় কিছু ঘটেনি আর কমরেডদের ৩৪ বছরের রাজ্যপাট হুউউউস করে চলে যাওয়ার ফলে তাঁরা খানিক বুঝুম্ভুল অবস্থায় ছিলেন। অমিত মিত্র অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়েছিলেন দিল্লিতে, সম্ভবত বিজ্ঞান ভবনে। সেখানেই অমিত মিত্রের ধুতি ধরে টান দিয়েছিল এই এসএফআই-এর নেতারা, প্রতিক্রিয়ায় সেই রাতেই হাজার দেড়েক সিপিএম পার্টি অফিস ভাঙচুর আগুন লাগানো হয়েছিল, এবং সিপিএম যে মানিবাধিকার ইত্যাদিকে মাওবাদী ছক বলত, সেই তারাই মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে কান্না জুড়েছিল। সময় লেগেছিল অনেক। আবার একে একে সেই অফিস ইত্যাদি খুলেছিল। সমস্যা হচ্ছে যে এটাকে কি এক সঠিক গণতান্ত্রিক আবহ বলবেন?
আরও পড়ুন: মমতাকে ছোট করার চেষ্টায় সিপিএম উন্মাদ
তর্ক চলবে, কিন্তু এটা তো ঠিকই যে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ, বা এই ধরনের নোংরামির পরে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল, এবং খেয়াল করে দেখবেন ১৫০০ পার্টি অফিসে আগুন লাগানো, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও অদ্ভুতভাবে একটাও প্রাণহানির ঘটনা অন্তত সেই ক’টা দিনে হয়নি, তার মানে এটা ছিল বুদ্ধবাবুর কথা মেনে কাজ, পেইড ব্যাক ইন হিজ ওন কয়েন, কাঠে কপাটে আচরণ। কাজেই এরকম ঘটনা ঘটানোর আগে অন্তত দেখা তো উচিত যে এর ধাক্কা সামলাতে পারবেন কি না। এই অসভ্যতামোর দরকার কি ছিল? মমতা ব্যানার্জি অক্সফোর্ডে গেছেন, প্রথমে বললেন অক্সফোর্ড থেকে কোনও আমন্ত্রণই নেই, তো আমরা দেখলাম উনি গেলেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অন্যতম কলেজ কেলগ কলেজের কর্তাব্যক্তিরা তাঁকে কলেজ প্রাঙ্গণ ঘুরিয়ে দেখালেন, টিকিট কেটে যেতে হবে, গেছেন মানুষে, সেই প্রোগ্রাম শুরু হল। সেখানেই বিক্ষোভ দেখাতে হবে? বেশ তো সেখানে অনায়াসে কিছু প্ল্যাকার্ড নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন, বিশ্বে মানুষ জেনে যেত আপনারা প্রতিবাদ করতে এসেছেন, আপনাদের পারপাস সার্ভড হত, মমতা ব্যানার্জি মেজাজ হারিয়ে কিছু বললে সেটা হত বোনাস পয়েন্ট। কিন্তু আমরা কী দেখলাম, বিশ্বের মানুষজন কী দেখল? চিৎকার করে এসএফআই-এর ছেলেমেয়েরা সভা বানচাল করার চেষ্টা করলেন আর শ্রোতাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের পরে তাঁরা পালাতে বাধ্য হলেন। আপনারা বিলেতে থাকেন, আগামী ছ’ মাস কি বছর কি সারা জীবন এদেশে, এই বাংলাতে পাও দেবেন না, কিন্তু এখানে যাঁরা আছেন? যারা ক’দিন পরেই ব্রিগেডে আসার ডাক দিয়েছে, আচ্ছা সেখানে যদি তৃণমূলের লোকজন এইভাবেই জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে? সামলাতে পারবেন? সারা রাজ্যে আপনাদের একজন বিধায়ক নেই, একজন এমপি রাজ্যসভার, তিনিও আপাতত হতাশ বিপ্লবী, এইসময়ে একটা ব্যাকল্যাশ ডেকে আনা কি খুউউব দরকার ছিল? ধরুন আপনারা পাড়ার মোড়ে সভা করছেন, সেখানে তৃণমূলের কর্মীরা এসে চিৎকার শুরু করল, মারল না ধরল না, শুধু চিৎকার করল, বা বলল সেলিম সুজন মীনাক্ষীরা যেখানে সভা করবে সেখানে দৌড় করাব, সামলাতে পারবেন? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, গতকাল অক্সফোর্ডে এসএফআই কর্মীদের অসভ্য প্রতিবাদের পরে বাংলাজুড়ে তৃণমূল যদি সিপিএম-এর প্রতিটা সভায় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে তাহলে কী হবে? এইভাবে বিদেশের এক সেমিনার বানচাল করার চেষ্টাকে আপনারা কীভাবে দেখছেন? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
আমাদের দেশের মুনি-ঋষিরা বলে গেছেন নিজের দুর্বল অবস্থায় শত্রুর মোকাবিলা করাটা কোনও কাজের কথা নয়, শত্রুকে হারাতে হলে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা দরকার। কনফুসিয়াস বলে গেছেন সামনে সবল শত্রু দেখলে পালিয়ে গিয়ে নিজের শক্তি বাড়িয়ে লড়াইয়ে ফিরতে হয়। মাও বলেছে শত্রুর দুর্বলতা খুঁজে বার করো, নিজের শক্তিকে সংহত করো। কিউবার লড়াইয়ে চে গ্যেভারা বলেছিলেন শত্রুকে আক্রমণ করার আগে তার পরাজয় নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু আমাদের বঙ্গের কচি নেতারা না পড়েছেন রামায়ণ মহাভারত, না পড়েছেন মাও চে লেনিন। তাঁরা এক আত্মঘাতী কাজ করলেন, যা ক’দিন পরেই নিজেরাই বুঝতে পারবেন।