যাঁরা রামের জন্মতিথি নক্ষত্র জন্মের স্থান ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ জানেন, তাঁদের নিজেদের জন্মদিন নিয়ে মেলা গোলযোগ। কেবল কি জন্মদিন, নিজের জীবনী ইত্যাদিতেও বছর সাল এসব ঘেঁটে ঘ। ধরুন আমাদের নরেন্দ্র মোদিজির কথা, যিনি সারা দেশের মানুষের কাছ থেকে জন্মের কাগজ চান, তোর আছে তো তোর বাবারটা দেখা, এরকম চলছে, সেই তাঁর জন্মদিন দুটো। এখন জানা গেল দিলীপ ঘোষের জন্মদিনও দুটো। এরকম কি কেবল ওঁদেরই? আর কারও নয়? তা কেন? যাঁদের বয়স এখন ৫০-এর উপরে তাঁদের এক বিরাট অংশের মানুষজনের দু’খানা জন্মদিন থাকাটা খুব স্বাভাবিক। কুষ্ঠিতে একরকম, স্কুলে আর একরকম, এরকম হামেশাই পাবেন। কিন্তু তাঁরা এগুলো নিয়ে চিন্তিত নন, নন এনটিটি, যাঁদের সেই অর্থে অস্তিত্বই নেই বা অস্তিত্ব সংকটে, সারাটা দিন চলে যায় পেটের সংস্থান করতে করতে, তাঁদের জন্মদিন নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? কিন্তু যাঁদের সেসব প্রচুর আছে তাঁদের এসব একটার বদলে পাঁচ-সাতটা থাকাও জায়েজ, থাকাই উচিত, জন্মদিন হলেই ফুর্তি ডট কম। ধরুন আমাদের রাজপুত্র অনন্ত আম্বানির কথা। আজ থেকে ৩০ বছর পরে কেউ শুধোল, ভায়া বিয়েটা কবে করেছিলে? সহজ জবাব ২০২৪-এ, সারা বছরই তো বিয়েই করছিলাম। ঠাট্টা থাক, মোদিজির দুটো জন্মদিন আর তাঁর ছোট্টবেলার জীবনীর বয়সের বিষম গোলমালের কথা তো জানতাম, এখন তার সঙ্গে জুড়েছে দিলীপ ঘোষের নাম। কারণ পয়লা আগস্ট দিলীপ ঘোষ গেলেন বিধানসভায়, সেখানে কেক কেটে, হিন্দু মতে, মানে বিশুদ্ধ হিন্দু শাস্ত্রমতে কি কেক কাটা হয়? জানি না, কিন্তু ওখানে কেক কেটে দিলীপ বাবুর জন্মদিন পালন হওয়ার পরেই ভাইরাল হল নির্বাচনের সময়ে ভাইরাল হওয়া দিলু ঘোষের আর এক জন্মদিন পালনের এবং সেই কেক কাটার ছবি, কিন্তু সেটা ছিল ১৯ এপ্রিল। তাইলে কাকা লাভ কার? যারা কেক খেল তাদের? নাকি যাঁর জন্মদিনে কেক কাটা হল তাঁর? সেটাই বিষয় আজকে, মোদি–দিলু ঘোষের জন্মদিন ক’টা?
আগেই বলেছি আমজনতার একটা সময় পর্যন্ত হসপিটাল বার্থ সার্টিফিকেট না থাকার ফলে এসব গন্ডগোল হত। মানে স্কুল থেকেই আর একটা আলাদা জন্মদিন হত, কিন্তু মোদিজিরটা তেমন নয়। ওঁর ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত জন্মদিন ছিল ২৯ অগাস্ট ১৯৪৯, তারপর আর কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগজ ইত্যাদিতে তাঁর জন্মের তারিখ লেখা নেই। অমন যে এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্সের সার্টিফিকেট, সেখানেও নেই। আবার কবে পাওয়া গেল, যখন তিনি গুজরাট মুখ্যমন্ত্রী হলেন, সেখানে কাগজে দেখা যাচ্ছে যে জন্মদিন ১৯৫০-এর ১৭ সেপ্টেম্বর, এক বছর কমে গেছে বয়স।
আরও পড়ুন: Aajke | রুটি নেই? কেক খাও
এর মধ্যে ওঁর কথা অনুযায়ী ওঁর বাবা বেঁচেই নেই, তাহলে করলটা কে? উনি তো তখন চা বিক্রি করতে করতে সন্ন্যাসী হতে হতে আরএসএস-এর প্রচারক হয়ে পাসপোর্ট নিয়ে আমেরিকা ঘুরে এসেছেন, সেখানে বয়স কমে গেল কী করে? জানতে চেয়েছিলেন একজন আরটিআই করে, জানানো হয়েছে এগুলো নাকি নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার, জানানো যাবে না। এবং দিলীপ ঘোষ, নির্বাচনের সময়ে বর্ধমানের ছবি কেক কাটছেন, হাসিমুখ, বধাই হো বধাই হো টাইপস কিন্তু তারিখ হল ১৯ এপ্রিল। আবার পয়লা অগাস্টেই একই দিলীপ ঘোষের জন্মদিন সেই একই কেক কাটিং, এবারে দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু একে অন্যের মুখে কেক গুঁজে দিচ্ছেন। আবার সেই দুটো জন্মদিনের গেরো। তো ওঁর মানে দিলুদার অনুগামীরা জানিয়েছেন, আসলে তিথি অনুযায়ী দিলুদার জন্ম ৫ বৈশাখ, কিন্তু বাংলা আর ইংরিজি তারিখে তো গন্ডগোল হয়, এবারে সেই ৫ বৈশাখ পড়েছিল ১৯ এপ্রিল, আর ইংরিজি জন্ম তারিখ হল পয়লা অগাস্ট। তাহলে বলি, ওঁর জন্মতারিখ যদি একটাই হয়, এবং সেটা যদি ৫ বৈশাখই হয়, তাহলে ইংরিজিতে সেটা ওই এপ্রিল মে-র মধ্যেই ঘুরবে, ছিটকে এসে জুন পেরিয়ে জুলাই হওয়ার কোনও চান্সই নেই। আসলে ভোটের সময় প্রচারের দরকার ছিল, করেছেন। এখন উপর থেকে চাপ এসেছে, তাই আবার কেক খাওয়ানো চলছে। ওই যে বললাম বড়লোকেদের আর বড় বড় লোকেদের জন্ম, বিয়ে, মৃত্যুর আলাদা তারিখ থাকতেই পারে, আর তার পিছনে আসলে নির্দিষ্ট কারণও থাকে। আমরা আমাদের দর্শকদের সোজা প্রশ্নই করেছিলাম, দিলু ঘোষের জন্মদিন বাংলায় ৫ বৈশাখ, যা এবারে ১৯ এপ্রিল, আবার আর একটা জন্মদিন হল পয়লা অগাস্ট, কোন দিনে ওঁকে শুভ জন্মদিন বলবেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আসলে সেই প্রাচীন কাল থেকেই এইসব জন্ম মৃত্যু বিবাহ ইত্যাদির অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরির কাজে লাগানোর প্রথা সব দেশেই আছে। মুঘলদের সময় তো এটা শিল্পের পর্যায়ে গিয়েছিল, তাকে সেই সময় ম্যারেজ পলিটিক্স, রিস্তে কি সিয়াসতও বলা হত। আর সেসবের জন্য এক নবাবের চারটে ছ’টা বিয়ে খুব স্বাভাবিক ছিল, পরবর্তীকালে জন্মদিনে মাফিয়া ডনেরা, গডফাদারেরা ডাকত তাদের অনুগামীদের, বছরে চার পাঁচটা জন্মদিন পালন করা হত। এখন সম্ভবত সেই নিয়ম মেনেই দিলু ঘোষ আর শুভেন্দুর সন্ধি অনুষ্ঠান সারা হল জন্মদিনের আড়ালে। দেখা যাক এই সন্ধি কতদিন টেকে।