কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় খুব ভেবেচিন্তে কিছু করেন, খুব গুরুগম্ভীর মতামত দেন এরকম কি কেউ বলেন? ওনার আচরণে বহুবার দল, দলনেত্রী বিব্রত হয়েছেন, এটাও তো সত্যি। সেই তিনি সংসদ ভবনের সামনে ধনখড় সাহেবকে নিয়ে তেমনই লঘু অবতারণা, চলতি বাংলায় যাকে ভাঁড়ামো বলে তাই করেছেন। সেটা খুব নতুন কিছু নয়, আশ্চর্যেরও কিছুই নয়। কিন্তু আসলের চেয়ে সুদ বেশি, খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি, আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি ইত্যাকার প্রবচনের মতোই আসল ঘটনাকে ঢেকে দিয়ে কল্যাণবাবুর এই স্ট্যান্ড আপ কমেডিই আপাতত জাতীয় এবং বাংলার সংবাদমাধ্যমে ছেয়ে আছে। কেন কল্যাণ অমন করিলেন। আহা পকেটমারটিকে ওইরকম ভাবে কে মারিল? আরে ভাই পকেটমারটি পকেট না মারিলে কেউ ওনার দু’গাছা লোমও ছিঁড়িত না, এটি তো প্রতিক্রিয়া। ক্রিয়া নিয়েও দু’ চার কথা হোক। সংসদ ভবনের সামনে সিঁড়িতে বসে আছেন আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, কেন রে ভাই? ১৯৫২ থেকে সংসদ চলে আসছে, এমন পাইকারি হারে বহিষ্কার কেউ কখনও কি দেখেছে? অটলজি তখন প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বাইরে ওই কালার ক্যানিস্টার নয়, এ কে ফর্টি সেভেন নিয়ে হাজির হয়েছিল টেররিস্টরা, গুলিগোলা চলেছিল। সেবারও সংসদে হল্লা কম হয়নি। যদিও অটল বিহারী বাজপেয়ী বা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৌনিবাবা হয়ে বসে ছিলেন না, তাঁরাও সংসদেই ছিলেন, প্রশ্ন উঠেছিল, জবাব দিয়েছেন। কিন্তু এমন গণহারে সাংসদ বহিষ্কারের ঘটনা তো ঘটেনি। বোফর্স ইস্যুতে, নির্ভয়া ইস্যুতে দিনের পর দিন সংসদ অচল করে রেখেছিলেন বিরোধীরা, বিজেপিও ছিল সেই দলে, কই এমন গণ বহিষ্কার তো হয়নি। এবার হল। তার প্রতিক্রিয়ায় কল্যাণের স্ট্যান্ড আপ কমেডি এবং ধনখড়জির গুসসা। সেটাই বিষয় আজকে, কল্যাণের ভেংচি কাটা আর ধনখড় কা গুসসা।
৮০০ কোটি টাকা খরচ করে নতুন সংসদ ভবন তৈরি করার পরে তার চার স্তরের নিরাপত্তা ভেদ করে অর্গানাইজড টেররিস্টরা নয়, কিছু আইডিয়ালিস্ট নৈরাজ্যবাদী, মাথা গিনতিতে ৬-৭ জন হবে, তারা ঢুকে পড়ল। হাতে রং বোমা, রংবাজি করলো সংসদের ভেতরে, তাদের কাছে আসল বোমা থাকতে পারত, রাসায়নিক গ্যাস থাকতে পারত, তারা আত্মঘাতী দল হতেই পারত। কেবল রংবাজির উপর দিয়ে বিষয়টা বেরিয়ে গেছে। তো সাংসদরা বলছিলেন, প্রশ্ন করছিলেন কী করে এমন হল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সামনে আসুন, সংসদে আসুন আমাদের প্রশ্নের জবাব দিন।
আরও পড়ুন: বিজেপি ৩৫টা আসনের জন্য লড়াই শুরু করেছে, শেষ কততে হবে?
উত্তর এল না, উল্টে ১৪১ জনকে বহিষ্কার করা হল, আজও বহিষ্কার করা হয়েছে আরও দুজনকে। তাঁরা সংসদের বাইরের সিঁড়িতে বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, তা নিয়ে ধনখড় সাহেবের কোনও বক্তব্য শুনেছেন? এই ঘটনা এর আগে কখনও হয়নি, এটা বলেছেন? নির্বাচিত সাংসদরা সংসদ ভবনের সিঁড়িতে বসে আছেন তা নিয়ে উনি দুঃখিত, এমন কথা বলেছেন? না, একবারের জন্যও নয়। কিন্তু ওই সিঁড়িতে বসেই কল্যাণ ব্যানার্জি তাঁকেই ভ্যাঙচাচ্ছিলেন, তাঁর গলা নকল করে বা তাঁর অঙ্গভঙ্গি নকল করে মিমিক্রি করছিলেন, তা নিয়ে তিনি ভারি দুঃখিত, কেননা তিনি দেশের উপরাষ্ট্রপতি। তিনি দেশের উপ না পাপো তা আলোচনার আগে এটাই তো আলোচনা হওয়া উচিত যে দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদের বাইরে কেন? সেসব নয়, আপাতত মুখ্য আলোচনা ধনখড় সাহেব কো গুসসা কিউ আয়া? এখানেই কিসসা থেমে নেই, ওনার এই গুসসা আর ক্রোধ এবং দুঃখ দেখে সমবেদনা জানিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। যিনি সভায় সভায় মিমিক্রি করে বেড়িয়েছেন দিদি ও দিদি, দিদি ও দিদি বলে, একজন জনপ্রতিনিধি, একজন নির্বাচিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রী, একজন মহিলাকে নিয়ে প্রকাশ্য সভায় ওই নোংরা আচরণ যিনি করছেন, তিনি আজ অন্যের আচরণ নিয়ে আহা রে কত দুঃখ পেয়েছেন। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় যা করেছেন তা কোনওভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়, কিন্তু সেটা তো ছিল প্রতিক্রিয়া। তার আলোচনার বহু আগে সংসদীয় গণতন্ত্রের লাশ নিয়ে যে শোভাযাত্রা বেরিয়েছে, বিজেপি দল আর সরকার সেই শেষ শোভাযাত্রায় সামিল হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। আর মিমিক্রি? সংসদের বাইরে সিঁড়িতে নয়, সংসদের মধ্যেই একবার নয় বহুবার মিমিক্রি করেননি আমাদের প্রধান সেবক? নাকি ওই রাষ্ট্রপতি আর উপরাষ্ট্রপতিকে বাদ দিয়ে যত ইচ্ছে অভদ্র আচরণের ছাড় দেওয়া আছে ভারতবর্ষের সংবিধানে? আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, কেবলমাত্র প্রশ্ন তোলার অপরাধে আজ অবধি ১৪৩ জন নির্বাচিত সাংসদকে সংসদ থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, তার প্রতিক্রিয়ায় সংসদ ভবনের সিঁড়িতে বসে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ধনখড় সাহেবকে নিয়ে মশকরা করেছেন, কোনটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত? কোনটা আজ দেশের মানুষের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? শুনুন কী বলেছেন আমাদের দর্শকেরা।
আমাদের দেশের শাসন প্রক্রিয়ার ভিত্তিই হল সংসদীয় গণতন্ত্র। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদে যাবেন, তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সরকার চালাবেন, বিরোধীরা সেই সরকার যাতে মানুষের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে সেদিকে নজর রাখবেন। আজ সেই সংসদীয় গণতন্ত্র আক্রান্ত। বিরোধীমুক্ত এক সংসদ চায় আরএসএস–বিজেপি, তাঁরা আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ধাঁচের শাসন ব্যবস্থা চান, তাঁরা দেশের সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ নন। আর সেই কারণেই সংসদে এখন সার্কাস চলছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিটা ধারণাকে ধ্বংস করার এক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।