প্রথমে পাটনা, পরে বেঙ্গালুরু, তারপরে একটু থমকে মুম্বইয়ের বৈঠকের পরে ইন্ডিয়া জোট নিয়ে কোথাও কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না। কংগ্রেস তখন ব্যস্ত চার রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে, কংগ্রেস তখন ফিরে গেছে আপন মনোভূমিতে, হাতে ঘি এর গন্ধ, নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব লিগ্যাসির দিনগুলোতে। সামনে মোদি, সেটা খেয়ালেই নেই। খেয়াল হল এক ঝটকায়, তিন রাজ্যে হার নয়, বিরাট হার। এক রাজ্যে জয়, কিন্তু সে জয়ের সঙ্গে সংশয় লেগেই আছে মোদি–শাহ জমানায় যেমনটা লেগেই থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যাজিক ফিগারের থেকে মাত্র গোটা পাঁচেক বেশি বিধায়ক নিয়ে এই জমানায় কতটাই বা নিশ্চিন্তে থাকা যায়। সে যাই হোক মোদ্দা কথা হল কংগ্রেসের আপাতত হুঁশ ফিরেছে, স্বভাবতই তাদের মনে পড়েছে ইন্ডিয়া জোটের কথা। এ একদিকে ভালোই হয়েছে, এই চার রাজ্যে কষ্টেসৃষ্টেও তিনটেতে জিতে গেলে এই ইন্ডিয়া জোট হওয়াটা কঠিন হয়ে যেত। সবচেয়ে বড় দল কংগ্রেস বার্গেন করতে নামত, কড়া দরাদরির ফলে জোটে কিছু শরিক সরে যেত, এসব হতই। কিন্তু তিন রাজ্যে হার কংগ্রেসকে বাস্তব অবস্থাটা বুঝতে সাহায্য করেছে অন্যদিকে শরিকদলের নেতাদের সঙ্গে, দলের সঙ্গে আসন বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে যে নমনীয়তা দেখানো উচিত, সেই শিক্ষাও কংগ্রেস পেয়ে গেল। সেই জন্যেই নির্বাচনের ফল ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নার্ভাস কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক ডেকেছিল, কারও সঙ্গে কথা না বলেই। তারপরে কোর্স কারেকশন এবং অতঃপর ইন্ডিয়া জোটের চতুর্থ বৈঠক হয়ে গেল। এসব বৈঠকের নির্দিষ্ট সময়ের আলোচনার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল তার আগে একে অন্যের সঙ্গে বৈঠক, বিভিন্ন নেতাদের সংবাদমাধ্যমের কাছে বিবৃতি এবং পরের দিনে নেতাদের বিবৃতি। সেসব পড়ে, বুঝে, শুনে যেটা আমার মনে হয়েছে তা হল অন্তত ইন্ডিয়া জোটের দিল্লি বৈঠক আদতে এক বড় ঘোড়ার ডিম প্রসব করেছে। এবং আগামী দু’ একটা বৈঠকে যদি এই সাইজের ঘোড়ার ডিম পাড়তে থাকে, তাহলে এই জোটের গঙ্গাযাত্রা মাসখানেকের মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে যাবে। মমতা একদিন আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজধানীতে, গিয়েই বৈঠক সেরেছেন কেজরিওয়ালের সঙ্গে, বৈঠক করেছেন শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে, আলাদা করে কথা হয়েছে অখিলেশ যাদব, রামগোপাল যাদবের সঙ্গে। খেয়াল করুন এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই কংগ্রেসের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়, কিন্তু এঁরা জোটেই আছেন।
আবার খেয়াল করুন বৈঠক শেষ, সাংবাদিক বৈঠকের আগেই বেরিয়ে গেছেন মমতা, অভিষেক, চলে গেছেন লালুপ্রসাদ যাদব, হাজির ছিলেন না নীতীশ কুমার। এবং খেয়াল করুন যা নিয়ে আর কারও মুখেই কোনও কথা শোনা গেল না, তা নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বললেন, বিরোধী জোটের মুখ হলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের জানালেন তিনি এ রাজ্যে কংগ্রেস তো বটেই, এমনকী বামেদের সঙ্গেও আসন সমঝোতায় রাজি আছেন। এছাড়াও জানা গেল মমতা এবং আরও কয়েকজন নেতানেত্রী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আসন সমঝোতা সেরে নেওয়ার একটা ফর্মুলাও বলে দিয়েছেন। ৩০০টা আসনে কংগ্রেস লড়ুক, বাকি ২৪৩টা আসনে লড়বে শরিক দলেরা। এসব তথ্য কিছুটা ঘোড়ার মুখ থেকে, কিছুটা অন রেকর্ড জানা গেছে। তো এত কিছুই হল, কিন্তু আজকে আমাদের চতুর্থ স্তম্ভের শুরুতেই কেন বললাম যে চতুর্থ ইন্ডিয়া বৈঠকে আদতে মস্ত এক ঘোড়ার ডিম পেড়েছে? আসুন এবারে সেই আলোচনায় নামা যাক। ইন্ডিয়া জোটের কথাবার্তা বহুকাল ধরেই চলছিল কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে পাটনাতে জোটের বৈঠক হল ২৩ জুন। তারপর পাঁচমাস কেটে গেছে চতুর্থ বৈঠকে এসেও বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন লড়ার কোনও ফর্মুলার কথা বলে উঠতে পারল না। দিল্লি বৈঠকের শেষে আমরা ঐক্যবদ্ধ, আমরা রাজ্যস্তরে বোঝাপড়া করার চেষ্টা চালাব, আমরা একযোগে প্রচার অভিযানে নামব। এসব বললেন মল্লিকার্জুন খাড়গে। সবটাই ভাসাভাসা কথাবার্তা এবং অন্যদিকে রাজ্যস্তরে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষ ছড়িয়েই যাচ্ছেন নেতারা, তার কোনও বিরতি নেই। অন্তত এই মিটিংয়ে বিরোধী নেতারা এই সিদ্ধান্ত তো নিতেই পারতেন যে আজ থেকে প্রকাশ্যে আমরা জোটের সঙ্গীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করব, এরকম এক সিদ্ধান্তে কতজন সহমত? অন্তত এরকম এক সিদ্ধান্ত তো নিতেই পারতেন যে আমাদের মধ্যে যা সর্বসম্মতভাবে মেনে নেওয়া হবে, প্রত্যেক দল কেবল সেগুলোই মানুষের সামনে রাখবে। ৬টা-৮টা দিন তো ঘোষণা করতে পারত, ৬টা-৮টা শহরের নাম তো ঘোষণা করতেই পারত যেখানে আগামী সভাগুলো হবে।
আরও পড়ুন: ইন্ডিয়া জোটে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন?
১৪১ জন সাংসদকে বের করে দিয়েছে তা নিয়ে দেশজোড়া প্রতিবাদের জন্য ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকের দরকার ছিল কি? সে তো ওই সংসদে বিরোধী দলেরা বসেই সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তার জন্য ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকের কি খুব দরকার ছিল? অন্তত একটা হাইপাওয়ার কমিটি যারা আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা চালাবে, আরেকটা কমিটি যারা একটা কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম তৈরি করবে, একটা কমিটি যারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে, এসব হল? আগের যে কমিটি তৈরি হয়েছিল তারা এর মধ্যে কোন মাঠের ঘাস কাটছিলেন তাও জানা গেল না। সব মিলিয়ে এই বৈঠক থেকে প্রাপ্তি শূন্য, ওই তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম। কিন্তু বাংলার প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা বলার আছে, এখানে কিন্তু ঘুঁটি সাজিয়েই নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমত তিনি যে বিজেপির বিরুদ্ধে এক জোটে আন্তরিকভাবে আগ্রহী তা বোঝানোর জন্য যা যা করার সেটা করে ফেললেন। তিনি বললেন কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতায় তিনি রাজি, মনে করিয়ে দিলেন তাঁদের ২টো জেতা আসন আছে, মানে বুঝিয়ে দিলেন, খুব বেশি হলে গোটা তিনেক আসন তিনি ছেড়ে দিলেও দিতে পারেন, সেটা ওই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখে এবং তিনি প্রয়োজনে এমনকী সিপিএম-এর সঙ্গেও সমঝোতায় রাজি। কেন? কারণ তিনি বা তাঁর দল দেশে এবং এ রাজ্যে বিজেপিকে হারাতে চায়। মানে সেই বাইনারিতে মানুষকে নিয়ে আসা, হয় বিজেপি নয় তৃণমূল। মানুষ বুঝুক যে তিনিই এ রাজ্যে বিজেপিকে হারাতে কতটা আন্তরিক এবং মানুষ জানে তিনিই হারাতে পারেন, অতএব বিজেপি বিরোধী ভোট তাঁর ঝুলিতে আনার ব্যবস্থা তিনি ইন্ডিয়ার বৈঠকে বসেই করলেন। দ্বিতীয় কাজ হল বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিচ্ছিন্ন থাকা যাবে না, থাকাটা সম্ভব নয়। কাজেই এখনও বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের সেই অংশের সঙ্গে সম্পর্ক ঝালিয়ে নিলেন যাঁরা আবার কংগ্রেস বিরোধীও বটে, মানে জোটের মধ্যে আরেকটা অলিখিত জোট, একটা প্রেসার গ্রুপ, প্রয়োজনে এই গ্রুপ থেকে চাপ দেওয়া যাবে। অখিলেশ, কেজরিওয়াল, উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে বৈঠক তো এমনি এমনি হয়নি। তিন নম্বর যে কাজ এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন তা অনবদ্য। অনেক সময়েই এরকম এক অভিযোগ, রটনা হয়েছে যে মমতা প্রধানমন্ত্রী হতে চান, সেই জন্যই বিরোধী জোট নিয়ে তাঁর এত প্রচেষ্টা, কখনও অকংগ্রেসি দলের নেতাদের নিয়ে, কখনও সব বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক নিয়ে তিনি সচেষ্ট, কারণ তিনি নাকি প্রধানমন্ত্রী হতে চান।
এটা তো ঘটনাই যে এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম বিরোধী মুখ, নির্বাচনের পরে বিরোধীদের কাছে আসন সংখ্যা থাকলে তাঁর নাম যে উঠবে না তা তো হলফ করে বলা যায় না। কিন্তু মমতা নিজেই জোটের মুখ, আগামী প্রধানমন্ত্রিত্বের মুখ হিসেবে মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম বলে রাখলেন, আবার সেই একই আত্মত্যাগের কাহিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে হারানোর জন্য সিপিএম-এর সঙ্গে আসন সমঝোতায় রাজি, উনি কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে রাজি এই বার্তা ছড়িয়ে তো গেলেন। আবার তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন বা বলা ভালো জানালেন যে বিজেপিকে হারাতে তিনি আন্তরিক, তিনি এই জোট গড়ে উঠুক তা চান। এ বাংলায় এই বার্তা ছড়িয়ে গেলে ওনার লাভ। এমনিতে কংগ্রেসের জোট না করে আপাতত কোনও উপায় নেই, এ রাজ্যেও কংগ্রেস নেতারা জানেন যে শেষমেশ তৃণমূলের সঙ্গে আসন সমঝোতার চাপ আসবে আর তা মেনেও নিতে হবে। এখানেও মমতা ইন্ডিয়া জোটের বৈঠককে খুব ভালোভাবে ব্যবহার করলেন। সিপিএম-তৃণমূল জোট তো হবে না কিন্তু এখন এ রাজ্যে কোনও কারণে যদি কংগ্রেস-তৃণমূল জোটও না হয় তাহলে মমতা এটাই বলতে পারবেন যে আমি তো চেয়েছিলাম, কিন্তু দেখুন কংগ্রেস এই ঐক্যবদ্ধ লড়াই নিয়ে আন্তরিক নয়। অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গেলেন ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে কিন্তু আদতে এই বাংলার রাজনীতির প্রেক্ষিতে যা যা করার সেটাই করলেন। অন্যদিকে লালুর কোনও বক্তব্য পাওয়া গেল না, নীতীশ কুমারকে তো বিরক্ত মনে হল, অখিলেশ যাদব গেলেন চলে এলেন। সবমিলিয়ে বিরোধী জোটের চতুর্থ বৈঠক মোটের উপর কোনও সদর্থক আশা জাগাতে পারল না। যদিও জোটের প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নেতা, দেশের বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা, সেই সব সাংবাদিকেরা যাঁরা এখনও শিরদাঁড়া বিকিয়ে দেননি, প্রত্যেকেই জানেন গণতন্ত্র, সংসদীয় ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান আজ বিপন্ন। ২০২৪-এ বিজেপি জিতলে এসবের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, তবুও বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার চতুর্থ বৈঠক এক বিশাল অশ্বডিম্বই প্রসব করিল।