শান্তানম কমিটির রিপোর্টের সুপারিশগুলো মেনে তৈরি হয়েছিল সিবিআই সেই ১৯৬৩-তে। আজ সেই সিবিআই-এর নাম সবাই জানে, কিছুদিন আগে পর্যন্তও কিছু হলেই সিবিআই আসছে বলা হত। এখনও বিধানসভাতে বসেই কেউ কেউ হুমকি দেন, ঘরে সিবিআই পাঠিয়ে দেব। কিন্তু সিবিআই বলতে যে এক বিরাট ব্যবস্থা, এক দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা টিম, এক দুরন্ত তদন্তের প্রক্রিয়া কিন্তু নেই, তা অতি ব্যবহারে এবং বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে ক্ষয়ে কার্যত আপনি সিবিআই? পরে একশোটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন থেকে নেমে এখন ভাবলেশহীন ও আপনি সিবিআই বলুন কি চান-এ এসে দাঁড়িয়েছে। মানে আপনার পাড়ার মোড়েই যদি ২৮টা ডন আর ৪৩টা জেমস বন্ড ঘুরে বেড়ায় তাহলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট বিচারের শুনানি চলাকালীন সিবিআইকে খাঁচায় বন্দি তোতাপাখিও বলেছেন। সেদিন থেকে যেটুকু কুলমর্যাদা বাকি ছিল সেটুকুও গেছে। এই মোদিজি এক সময়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, আমাদের পেছনে সিবিআই লেলিয়ে দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ভাবা যায়? স্বয়ং মোদিজি এই কথা বলেছিলেন। এখন অবশ্য এই সিবিআই-এর সেই বোলবালা নেই, আসরে নতুন হিরো ইডি। সিবিআই যদিও তৈরি হয়েছিল দুর্নীতি, সরকারি স্তরে দুর্নীতি ইত্যাদি সামলাতে, তারপরে সিবিআই-এর কাঁধে সবই এসে পড়ে। গুলি চালনা থেকে দুর্নীতি থেকে চুরি পর্যন্ত বিভিন্ন মামলা নিয়েছে সিবিআই, আর সাকসেস রেট? এত কম যে আপনার বাড়ির ছেলেপুলে হলে কান ধরে হিড়হিড় করে স্কুল ছাড়িয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ শেখাতেন। আজ সেই সিবিআই বিষয় আজকে, রবিবারের মধ্যে কিনারা না হলে সিবিআই?
সিবিআই যেমনটা বলছিলাম তৈরিই হয়েছিল এমন মামলাগুলো, অপরাধগুলো সামলাতে যা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্বপূর্ণ, সরকারি স্তরে দুর্নীতি ইত্যাদি দেখার জন্য। কিন্তু হয়ে দাঁড়াল সবখোল চাবি। ধর্ষণ থেকে খুন থেকে রবি ঠাকুরের নোবেল পর্যন্ত সিবিআই-এর আওতায় গেছে। কিছু হলেই বিরোধীরা দাবি করেছেন সিবিআই তদন্ত চাই, কিন্তু তদন্ত হয়ে কিছু বেরিয়েছে? তেমন মামলা হাতেগোনা, বেশিরভাগেরই কোনও কিনারাই করতে পারেননি সিবিআই গোয়েন্দারা।
আরও পড়ুন: Aajke | তদন্ত কি তাহলে ফেসবুকেই হবে?
তো এই আরজি কর ধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবি তোলার আগেই মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, রবিবারের মধ্যে তদন্তের কিনারা না হলে সিবিআই-এর কাছে বিষয়টা তদন্তের জন্য দেওয়া হবে। আর তার আগেই উচ্চ আদালত জানিয়ে দিল, এই মামলার তদন্ত এখন থেকেই করবে সিবিআই। আসলে এটা একটা দারুণ ডিফেন্স মেকানিজম, বিরোধীরা বলার আগেই মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সিবিআই তদন্তের দাবি তুলে দিলেন। রবি ঠাকুরের নোবেল চুরি বাম আমলে, সংগঠিত চক্র না ছিঁচকে চোর, সেটাও স্থির করতে পারেনি তৎকালীন পুলিশ। মমতা ক্রমাগত দাবি করে যাচ্ছিলেন সিবিআই তদন্তের, হল সেই তদন্ত এবং হাতে পেনসিল। তাপসী মালিক হত্যাকাণ্ড, একই হাল, সিবিআই কিছুই বের করে উঠতে পারেনি। এবারে কেবল পলিটিক্যাল স্ট্রাটেজি হিসেবেও সিবিআই তদন্ত চালু করে দিয়ে আসলে রাজ্য সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগাম একটা ক্লিনচিটের বন্দোবস্ত করতে চাইছিলেন। এবং তা পাকেচক্রে এসেও গেল। কারণ তদন্ত শেষের মুখে, যাবতীয় প্রমাণ তথ্য রাজ্য পুলিশ গোয়েন্দাদের হাতে, তাঁদের দক্ষতা নিয়ে এমনিতে কোনও প্রশ্নই নেই যতক্ষণ না শাসকদলের রাজনৈতিক মতপার্থক্য তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে তড়িঘড়ি করে সিবিআই-এর কাছে মামলা গেলে সে মামলার কোনও কিনারাই যে হবে না তা নিয়ে খুব বেশি দ্বিমত নেই। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, রবি ঠাকুরের নোবেল থেকে তাপসী মালিক হত্যা থেকে বহু বহু মামলায় কোনও কিনারাই করতে পারেনি সিবিআই। সেই সিবিআইকে আরজি কর ধর্ষণ-হত্যার দায় দিলে কি আপনি খুশি হবেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সিবিআই কোনও সবখোল চাবি নয়, সব রহস্য তাঁরা আসবেন আর উদ্ধার করে দেবেন এমনও নয়, ওনাদের ব্যর্থতার রেট আপনার পাড়ার সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রের চেয়েও কম। তারাও সাধারণ মানুষ, এমন কিছু বিরাট ট্রেনিং বা বিরাট মেধার ভিত্তিতে সেখানে আছেন এমনও নন। কাজেই ওই যত্রতত্র সিবিআই পাঠিয়ে আসলে বিষয়টাকেই ধামাচাপা দেওয়ার অভ্যেস থেকে বের হয়ে আসার সময় এসে গেছে, সেটা বুঝুন আর বোঝান।