অভয়ার ধর্ষণ আর খুন ঘটেছিল ৯ অগাস্ট, আর মাত্র তার ১০ দিনের মাথায় আমরা কী বলেছিলাম? আসুন একটু মনে করিয়ে দিই। বলেছিলাম, সুনামির মতো ফেক নিউজ আসছে, এবং সে সব যে বেশ খেটেখুটে এক ফ্যাক্টরিতেই তৈরি করা তাও পরিষ্কার। যে যা পারছেন লিখে যাচ্ছেন, যা খুশি। লিখুন, মতামত দেওয়ার অধিকার প্রত্যেকের আছে, থাকাই উচিত, কিন্তু তথ্য দেওয়ার আগে যাচাই করার দরকার নেই? একজন একটা অডিও রেকর্ডিং করলেন, তারপর তা ভাইরাল হয়ে গেল, আমি সোমা বলছি রে, জানিস তো, ওকে না জরাসন্ধের মতো চিরে ফেলা হয়েছে, ব্যস। সেই ভাইরাল ক্লিপ আপাতত উধাও কিন্তু তার বেসিসে প্রশ্ন উঠেছে, ওই চারজন ডাক্তারের ফাঁসি চাই। এক হাফ সাংবাদিক লিখলেন, এই ছবির ছেলেটিকে চেনেন, তাহলে পুলিশকে খবর দিন। কেন? সেসব উহ্য থাকল, বুঝিয়ে দেওয়া হল এই মুহূর্তে এই হল পালের গোদা, তারপর পুলিশের গুঁতো খাওয়ার ভয়ে সেই পোস্ট তিনি তুলে নিলেন, কিন্তু বিষয় আর ছবি ভাইরাল। আরজি করে চিকিৎসক-ছাত্রীকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় এমন বহু তথ্য অনায়াসে ছড়িয়েছে সমাজমাধ্যমে। যার অধিকাংশই ভুয়ো বলে দাবি পুলিশের। ইতিমধ্যেই লালবাজার সমাজমাধ্যমে ভুয়ো তথ্য ছড়ানোর দায়ে শ’ খানেক মানুষজনকে নোটিস পাঠিয়েছে। এবং যেহেতু বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে প্রথম ধারণাটা এটাই ছড়ানো হয়েছে যে পুলিশ নিজেই এই ব্যাপারে জড়িত তাই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও তলানিতে। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক থেকে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, যা ছড়ানো হচ্ছে তার সব কিছু ঠিক নয়। মনোরোগ চিকিৎসকদের দাবি, ‘‘ভুয়ো তথ্যের বিস্ফোরণ ঘটেছে। ভীত সমাজকে এই ভুয়ো তথ্যের ভাণ্ডার আরও আতঙ্কিত করে তুলছে।’’ সমাজমাধ্যমে কয়েক দিন ধরে ঘুরছে তরুণীর সুরতহালের রিপোর্ট। তার পরেই ছড়ায় যে, ঘটনাস্থল থেকে ১৫০ গ্রাম বীর্য, সেমিনাল ফ্লুইড পাওয়া গেছে। সে সবের ভিত্তিতে আরও ছড়িয়েছে যে, নির্যাতিতার ‘পেলভিক বোন’ ও ‘কলার বোন’ ভাঙা হয়, পা মাঝখান থেকে ৯০ ডিগ্রি কোণে চিরে দেওয়া হয়। ঘটনার সময়ে তরুণীর হাত-পা অন্য কেউ চেপে ধরে ছিল। অর্থাৎ, খুনি এবং ধর্ষক একাধিক। এবং এসবে পড়ার, জানার পরে বহু মানুষ পুলিশ প্রশাসন আর সরকারের কাছে জবাব চাইছেন, যা নেই, যা ঘটেনি, তার জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। অতএব সরকার বা প্রশাসনের তরফে বড় জোর বলা হচ্ছে এগুলো ফেক নিউজ, তখন আরও জোরে চিৎকার উঠছে, এড়িয়ে গেলে চলবে না, জবাব চাই জবাব দাও। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, রাশি রাশি ফেক নিউজের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে ধর্ষিতার আর্তনাদ। এসব বলার পরে সেই ঘটনার পর থেকে ৯৮ বার পৃথিবী তার নিজের কক্ষে আবর্তিত হয়েছে। আজ আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে ওই সব প্রচার ছিল আদতে অতৃপ্ত আত্মাদের নবান্ন দখলের কলাকৌশল। আর সেটাই বিষয় আজকে, অভয়ার ধর্ষণ খুন ঢেকেছিল মিথ্যে প্রচারে, তা আজ পরিষ্কার।
বেশ কিছু মানুষ আছেন সেদিন এই প্রচারে ভেসেছিলেন, নেমেছিলেন পথে, ওই পেলভিক বোন কলার বোন ভাঙার তথ্য আর প্রশ্ন নিয়ে। তাঁদের একটা বড় অংশ একান্ত আলাপে বলছেন, না ভাই, এসবে আর নেই, যা সত্যিই হতাশার বর্হিপ্রকাশ আর এই হতাশা আর অবসাদ যে শাসকের ভারি পছন্দের তা তো সবাই জানেন। মানে এরপরে সঠিক কারণেও রাস্তায় নামতে পারতেন এমন লোকজন খানিকটা হলেও তো কমলেন। কিছু আছেন যাঁরা ঘোরের মধ্যে থাকেন, আছেন, এখনও আমি সোমা বলছির প্রতিধ্বনি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর বেশ কিছু মানুষ এই মিথ্যেটা বুঝতে পেরেছেন। যাঁরা দোলাচলে আছেন তাঁদের জন্য দু’ চারটে কথা।
আরও পড়ুন: Aajke | চরম পাল্টিবাজ প্রতিবাদীদের দলেই নাম লেখালেন কালো চশমা রাজ্যপাল
আদত সমস্যাটা তো ছিল রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে, কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে, কলকাতা পুলিশ অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে, এই কথাটাকে প্রমাণ করতে গিয়েই তো যাবতীয় ফেক নিউজকে সুনামির মতো ভাসিয়ে দেওয়া। বিকাশ ভট্টাচার্য বা সিপিএম বা ওইরকম কিছু মানুষজন, কেন জানি না চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এক মহান সিবিআই-এর ছবি আঁকার, যেন সিবিআই-এর হাতে গেলেই টপ করে আসল সত্যিটা বেরিয়ে আসবে, যদিও সিবিআই-এর ট্র্যাক রেকর্ড ঠিক তার উল্টো কথাই বলে। এবার সেই সিবিআই-এর তদন্ত রিপোর্ট আমাদের সামনে। ১১টা নির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁরা ওই অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করেছেন। সেই ১১টা নির্দিষ্ট প্রমাণই কলকাতা পুলিশের কাছ থেকেই তাঁরা পেয়েছেন, সিসিটিভি ফুটেজ থেকে, মোবাইল টাওয়ার লোকেশন থেকে ব্লুটুথ হেডফোন, ডিএনএ মেটেরিয়াল, ছেলেটির জিন্স বা জুতো যাতে মৃতার রক্তের দাগ আছে, মৃতার জামাকাপড়, ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা ছেলেটির পিউবিক হেয়ার, সব, প্রত্যেকটা প্রমাণ ওই কলকাতা পুলিশের কাছ থেকেই পাওয়া যার ভিত্তিতে এই ঘটনার প্রত্যক্ষ অভিযুক্ত হিসেবে সিবিআই ওই সঞ্জয় রায়কে চিহ্নিত করেছে। তাহলে কলকাতা পুলিশ কী আড়াল করেছিল? যদি নাই করে থাকে তাহলে এই মিথ্যেটা রটাল কারা? কোন উদ্দেশ্যে? আর কেবল সেই মিথ্যে রটিয়ে দু’ আড়াই মাস ধরে রাজ্যে এক নৈরাজ্য তৈরি করল কারা? আজ সেই সত্যিটা জানার সময় এসেছে। মানুষ চার অক্ষরের বোকা নয়, মানুষ সব জানে, বোঝে আর বোঝে বলেই শূন্য থেকে মহাশূন্যে ঝাঁপ দিতে চলেছে সেই সব রাজনৈতিক শক্তি। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, যাদের প্রত্যক্ষ মদতে রাশি রাশি ফেক নিউজ ছড়িয়ে, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে ছড়িয়ে দু’ আড়াই মাস ধরে এই বাংলায় এক নৈরাজ্য তৈরি করার চেষ্টা হল, তার নিরপেক্ষ তদন্ত হবে না? বার করা হবে না সেই আমি সোমা বলছির অডিও যে বা যারা ভাইরাল করেছিল তাদের? শুনুন সাধারণ মানুষ এ নিয়ে কী বলেছেন।
এখনও পর্যন্ত যা যা প্রমাণ আমাদের হাতে আছে তা বলছে, এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ অভিযুক্ত একজন, ওই সঞ্জয় রায়। এই ঘটনা একজনই ঘটিয়েছে, অবশ্যই সেখানে সিকিউরিটির অভাব তাকে এই সাহস জুগিয়েছে, অবশ্যই এক দাগী ক্রিমিনাল প্রকৃতির ছেলে কী করে সিভিক ভলান্টিয়ার হয়ে ওঠে তা তদন্তের বিষয়। অবশ্যই আরজি কর কেন, প্রতিটা মেডিক্যাল কলেজে যে দুর্নীতি তার তদন্ত হওয়া উচিত। অবশ্যই মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কিন্তু এই ঘটনার তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশ যত তাড়াতাড়ি প্রত্যক্ষ দোষীকে চিহ্নিত করেছে, যত সঠিকভাবে প্রমাণ ইত্যাদি জড়ো করেছে তা প্রশংসার দাবি রাখে বইকি। যাঁরা সেদিন শিরদাঁড়া হাতে গিয়েছিলেন লালবাজারে এবং তা রেখে এনেছেন তাঁরা এই বিচার প্রক্রিয়ার পরে আবার নিজেদের পিঠ সোজা রেখে তা ফেরত নিতে যাবেন কি? সেই প্রশ্ন তো উঠবেই।