২৪ ঘণ্টা পরে রাজ্যের ৬ আসনে উপনির্বাচন, আরও একবার তার হিসেব নিকেশ নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির। আগেই বলেছি, টানা তিন মাস ধরে চলতে থাকা আরজি কর ধর্ষণ খুনের বিচার চেয়ে আন্দোলন, ডাক্তারদের সিসিটিভি আর রেস্টরুমের জন্য আন্দোলন, নারী সুরক্ষার দাবিতে, লিঙ্গসাম্যের দাবিতে আন্দোলন আর দীর্ঘ সময় ধরে ডাক্তারদের কর্মবিরতি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই উপনির্বাচন কেউ চাক বা না চাক এক রেফারেন্ডামের চেহারা নিক, শাসকদল তো সেটাই চাইছে। ৬–০ গোল দেওয়ার পরে তৃণমূল নেতা আর কর্মীরা জোর গলায় হেঁকে বলবেন, বলেছিলাম মানুষ আমাদের সঙ্গে। অন্যদিকে কোনও মতে একটা আসনে জিতে মুখরক্ষার লড়াইয়ে নামা বিজেপি এই আন্দোলনের শুরুয়াতি পর্বেই বুঝে ফেলেছিল, এ আন্দোলন তাদের হজম হবে না, কাজেই তারা এই উপনির্বাচনের আগে থেকেই ভোটই হবে না, ও তো গায়ের জোরে জিতবে, এরা তো হুমকি দিয়ে ভোট করাবে এসব গান গাইতে শুরু করে দিয়েছেন, ওনারা নাকি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম অমিত শাহ, ওনারা ভুলেই মেরেছেন। এবং বামফ্রন্ট, রাজ্যে ৬টা আসনে ২৪ ঘণ্টা পরে ভোট, গণশক্তি খুলে দেখুন, প্রথম পাতায় সে নির্বাচন অন্তত হেডলাইনে নেই। সিপিএম ৬-এর মধ্যে একটাতে লড়ছে, একটা আসনে আরএসপি, বাকি দুই আসনে ফব, এক আসনে আইএসএফ আর অন্যটাতে সিপিআইএমএল লিবারেশন। কিন্তু এই আসনকে এক রেফারেন্ডামের দিকে নিয়ে যাওয়ার, একটা আসনেও কোনও চেষ্টাই নেই বামেদের, বরং দান ছেড়ে দিয়েছে এটা বলাই ভালো। তবুও এই নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ আছে, তাই আবার এই নির্বাচনই বিষয় আজকে, ৬ আসনে উপনির্বাচন, ফলাফল কী হবে?
দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাওয়া যাক। হাড়োয়া আসনটা ২০১১তে তৃণমূল ছিনিয়ে নেয় সিপিএম-এর কাছ থেকে খুব সামান্য ভোটে, সেবারে তৃণমূল জিতেছিল ১১০০ ভোটে, পেয়েছিল ৪৫.৭০ শতাংশ ভোট, কিন্তু তারপরে এই আসনে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে। ২০১৬তে ৫৬.৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে হাজি নুরুল ইসলাম জিতেছিলেন, সিপিএম পেয়েছিল ৩৫.১৯ শতাংশ ভোট, বিজেপি সেবারে ৫.৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০২১-এ আবার হাজি নুরুল ইসলাম, ভোট বেড়েছিল তৃণমূলের, ৫৭.৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন হাজি নুরুল ইসলাম, সিপিএম আইএসএফ-কে সমর্থন করেছিল, আইএসএফ পেয়েছিল ২১.৭২ শতাংশ ভোট আর বিজেপি ১৬.৯৩ শতাংশ ভোট।
আরও পড়ুন: Aajke | তিন মাসের আন্দোলন ইত্যাদি সামলে মমতা অপ্রতিদ্বন্দ্বী
হাজি নুরুল ইসলাম লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোর ফলে এই আসনে আবার পুনর্নির্বাচন, এবং এর মধ্যে হাজি নুরুল ইসলাম মারাও গেছেন, এবারে তৃণমূলের প্রার্থী শেখ রবিউল ইসলাম। আইএসএফ সমর্থন পেয়েছে বামফ্রন্টের, তাদের প্রার্থী পিয়ারুল ইসলাম, বিজেপির বিমল দাস। ৬টার মধ্যে মাত্র এই একটা আসনে বাম সমর্থিত প্রার্থী জমানত বাঁচাতে পারবে তার কারণ এই আসনে প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলমান ভোটের এক অংশ আইএসএফকে সমর্থন করে। এই ভোটে এটাও বোঝা যাবে যে আইএসএফ তাদের জনভিত্তি ধরে রাখতে পেরেছে নাকি সেখানেও ধস নামছে। এরপরের আসন নৈহাটি, অর্জুন বধ করে পার্থ ভৌমিক এখন লোকসভাতে, একদা সিপিএম-এর দুর্গ ছিল এই নৈহাটি আসন, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন রণজিৎ কুন্ডু, সেই তিনবারের বিধায়ককে হারিয়ে আসন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন পার্থ ভৌমিক, নেতা, অভিনেতা। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি আর কাজের মানুষ হিসেবে জিতেছেন তিনবার, আর সিপিএম ২০২১-এ জমানতও হারিয়েছে, দু’ নম্বরে উঠে এসেছে বিজেপি। এবারে এই আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সিপিআইএমএল লিবারেশনকে, এখন এটাই দেখার যে লিবারেশন কি জমানত বাঁচাতে পারবে? ক’দিন আগে পর্যন্ত তীব্র সমালোচনাই কেবল নয়, লিবারেশন বা তাদের নেতৃত্বকে নিয়ে যথেষ্ট কটুকথা বলেছে সিপিএম, তাদের কর্মী সমর্থকদের ভোট ট্রান্সফার হয় কি না সেটাও দেখার। আর হেরে যাওয়া অর্জুন কি জমি দখলে হাত দেবে নাকি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে সেটাও দেখার। তবে তৃণমূলের জয় নিয়ে এক ছটাক সন্দেহ কারও নেই। মেদিনীপুরের আসন ছিল জুন মালিয়ার কাছে, টলি পাড়া থেকে মেদিনীপুর, বিধায়ক হওয়ার পরেও কিন্তু জুন মালিয়া সেইভাবে লাইম লাইটে আসেননি, বলা ভালো খুব লো প্রোফাইলে নিজেকে রেখেছেন, এবারে তো সাংসদ। মেদিনীপুরও সিপিআই-এর কাছ থেকে তৃণমূলের কাছে এসেছিল সেই ২০১১তে, এই আসন ছিল সিপিআই-এর দুর্গ, ২০২১-এ সিপিআই পেয়েছিল ৫.৪৩ শতাংশ ভোট, বিজেপি ৪০.৫১ শতাংশ ভোট আর তৃণমূল ৫০.৭২ শতাংশ ভোট। এবারে বিজেপির ভোট কি একটু বাড়বে? তৃণমূলের জুন মালিয়া আর এবারের প্রার্থী সুজয় হাজরার দ্বন্দ্বে কি বিজেপির জয় সম্ভব? না, জয় সম্ভব নয়, কিন্তু সামান্য হলেও তৃণমূলের ভোট কমতে পারে। তালডাংরাতে তৃণমূলের অরূপ চক্রবর্তী ছিলেন বিধায়ক, এখন সাংসদ। এই আসন সেই ১৯৮৭ থেকেই সিপিএম-এর হাতে, ২০১১তেও সিপিএম এই আসনে জিতেছে আর ২০২১-এ জমানত খুইয়েছে, দু’ নম্বরে বিজেপি। এবারে বিজেপি বাঁকুড়া লোকসভায় হেরেছে, দলের মধ্যে চরম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তৃণমূল এই আসনে ভোট বাড়াবে। সিপিএম এই আসনে প্রার্থী দিয়েছে, কিন্তু জমানত বাঁচাতে পারবে? মনে হচ্ছে না। এবারে সিতাই, এখানেও তৃণমূলের বিধায়ক জগদীশ চন্দ্র বাসুনিয়া লোকসভাতে দাঁড়িয়ে জিতেছেন। এই আসন ছিল কিন্তু আদতে কংগ্রেসের, ২০১৬ থেকে এখানে তৃণমূলের রমরমা। কংগ্রেস গত ২১-এর নির্বাচনে পেয়েছিল ১.৬৬ শতাংশ ভোট। এবারে এই আসনে বামেদের প্রার্থী ফরোয়ার্ড ব্লকের অরুণকুমার বর্মা, কংগ্রেসও প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু লড়াই বিজেপির সঙ্গে। অনায়াসে জিতবে তৃণমূল। এরপরের আসন মাদারিহাট, যেদিকে নজর সবার। কারণ এই আসন ২০২১-এ জিতেছিলেন মনোজ টিগগা, এবারে সাংসদ হয়েছেন, জন বার্লাকে সরিয়ে ওনাকে সাংসদ করানো ইস্তক জন বার্লা অন্য সুরে গাইছেন। এবারে দুটো ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক, জন বার্লা প্রচারে নেই, বরং তাঁর তৃণমূলে যোগদানের খবর আসছে, উনি তা জোর গলায় খণ্ডনও করছেন না। দুই, গতবারে ওই অঞ্চলে বিজেপিকে জেতাবার জন্য গোর্খা জনজাতির নেতা বুদ্ধিমান লামা জান দিয়ে কাজ করেছিলেন, এবারে তিনি কলম চিহ্ন নিয়ে নির্দল প্রার্থী, পিছনে হাত আছে জন বার্লার, তিনি একটা বড়সড় ভোট কাটলে বিজেপির বিপদ। কিন্তু ২০২১-এ বিরাট ভোটে জিতেছিলেন মনোজ টিগগা, প্রায় ২৯ হাজার ভোটে, অতটা ব্যবধান মুছে কি তৃণমূল জিতে যাবে। প্রশ্নের উত্তর অত সহজ নয়। যদিও উপনির্বাচনের ফলাফল শাসকদলের দিকে ঝুঁকে থাকে আর জন বার্লার অনুপস্থিতি কতটা প্রভাব ফেলে, তৃণমূল রাজ্যসভা সদস্য প্রকাশচিক বরাইক কতটা ভোট ম্যানেজ করতে পারেন, চা বাগানের শ্রমিকদের কত ভোট তৃণমূলের ঘরে আসবে এবং নির্দল প্রার্থী বুদ্ধিমান লামা কত ভোট পাবেন? তার উপরে এই আসনের ফলাফল নির্ভর করছে। আমরা আবার এই ৬টা আসনে মানুষের কাছে সরাসরিই প্রশ্ন রেখেছিলাম, কে জিতছে আপনার আসনে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অনেকেই আমরা মনে করেছিলাম যে দীর্ঘ ৯০ দিনের উপরে চলতে থাকা উই ওয়ান্ট জাস্টিস বা জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বামেরা ধীরে ধীরে হলেও এ রাজ্যের তৃণমূল বিজেপি বাইনারি ভেঙে তৃতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসবে। এরকম আশা অবশ্য অনেকেই লোকসভা নির্বাচনের সময়েও করেছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন কারণেই বামেরা ক্রমশ শক্তি হারাচ্ছে, তাদের ঘুরে দাঁড়ানো, জমি উদ্ধার তো দূরস্থান, যা সামান্য কিছু ছিল তাও হারাতে বসেছে বামেরা আর সেটা তৃণমূলের কাছেও খুব একটা সুখের সংবাদ নয়, কারণ এর ফলে বিজেপি ক্রমশ ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাচ্ছে। এ রাজ্যে তৃণমূলের সবথেকে ভালো কাম্য রাজনৈতিক পরিবেশ হল বামেদের খানিক ঘুরে দাঁড়ানো আর কংগ্রেস তৃণমূলের জোট। আগামী নির্বাচনী আসরে সেদিকেই নজর থাকবে প্রত্যকে রাজনৈতিক মহলের।