নমস্কার আমি অদিতি, শুরু করছি কলকাতা টিভির আর নতুন নয়, ইতিমধ্যেই ৬৫টা এপিসোড হয়ে গেছে,হাজির আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে, সাদা কালো। একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, সুখের কথা বোলো না আর, বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি।
হ্যাঁ, সেই কবে আচ্ছে দিন-এর খোয়াব দেখিয়েছিলেন আমাদের চায়ওয়ালা কাম চৌকিদার, সে আচ্ছে দিন এখন এক মরীচিকা মাত্র। মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি আর দেশজোড়া হনুমান নৃত্যের মাঝখানে আমজনতা সত্যিই অসহায়। ৭০ শতাংশ শ্রমজীবী, কারখানার শ্রমিক, বা খেতমজুরের আয় রিয়েল টার্মস-এ কমছে। এদিকে শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য থেকে রোজকার বাজার যেন দুঃস্বপ্ন, কাজেই সুখ যে নেই তা নতুন করে বলার নেই। ওদিকে যাদের ধরাবাঁধা মাইনে আছেও, তাদের বড় অংশের চাকরি আগামিকাল থাকবে কি না কেউ জানে না, তাদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে ঠোকাঠুকি এখন সংঘর্ষ হয়ে উঠেছে, কাজেই সে তল্লাটেও সুখ অধরা। হ্যাঁ, সুখ আছে বটে সেই ১০ শতাংশ মানুষের, অন্তত মেটিরিয়াল হ্যাপিনেস যাকে বলে, তবে শুনেছি সেখানেও নাকি বেজায় গরমিল, সেখানেও প্রথম দ্বিতীয়, তৃতীয়ই কেবল নয়, আরও চাই, আরও দাওয়ের কলরব সেখানেও এক অসুখ। কাজেই দেশে যে সুখ নেই, তা তো জানাই ছিল, কিন্তু নতুন করে জানা গেল। হাতে এসেছে হ্যাপিনেস ইনডেক্স – ২০২৫। হ্যাপিনেস ইনডেক্স বা সুখের সূচক হল একটা হিসেব, যেটা দেখায় কোন দেশের মানুষ কতটা সুখী। এটা ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট থেকে আসে। এখানে মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয়, “তোমার জীবনকে ০ থেকে ১০-এর মধ্যে কত নম্বর দেবে?” ০ মানে সবচেয়ে খারাপ জীবন, আর ১০ মানে সবচেয়ে ভালো জীবন। ২০২৫ সালের রিপোর্ট ২০ মার্চে বেরিয়েছে, যেটা অক্সফোর্ডের ওয়েলবিইং রিসার্চ সেন্টার, গ্যালাপ, আর জাতিসংঘ মিলে তৈরি করেছে। গ্যালাপ ওয়ার্ল্ড পোল নামে একটা জরিপে প্রতি দেশের ১,০০০ জন করে মানুষের কাছে প্রশ্ন করা হয়। ২০২২ থেকে ২০২৪-এর তিন বছরের গড় হিসেব নিয়ে ১৪৭টা দেশের র্যাঙ্কিং করা হয়। শুধু জীবনের মানের গড় নম্বর দিয়ে স্থান দেওয়া হয়। তবে সুখ কেন বাড়ে বা কমে, সেটা বোঝার জন্য ছয়টা জিনিস দেখা হয়, দেশের টাকার পরিমাণ (GDP), পরিবার-বন্ধুদের সাহায্য, সুস্থ থাকার সময়, জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, দান করার মনোভাব, সরকারে দুর্নীতির ধারণা। বুঝতেই পারছেন ওই ঢপের জিডিপি বাদ দিলে আমাদের অবস্থাটা ঠিক কোথায়। ২০২৪ সালে ভারত ১৪৩টা দেশের মধ্যে ১২৬ নম্বরে ছিল, স্কোর ছিল ৪.০৫৪। ২০২৫-এ একটু ভালো হয়ে ১১৮ নম্বরে উঠেছে। তবু ভারতের সুখ এখনও কম, অনেক পড়শি দেশের থেকেও পিছিয়ে। চীন ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে, তারা ৬৮ নম্বরে। তাদের টাকা বেশি, চিকিৎসার ব্যবস্থা ভালো। পরিবারের সাহায্য আর জীবনের আয়ুও সুখ বাড়ায়। তবে স্বাধীনতা কম সেটা তো আমরা জানি। নেপাল ৯২-এ দাঁড়িয়ে, মানে আমাদের থেকে আগে। তাদের টাকা কম হলেও পরিবার আর সমাজের সাহায্য বেশি। এমনকী পাকিস্তান, ওই ডামাডোলের মধ্যেও আমাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে, তারা ১০৯-এ আছে। আসলে পাকিস্তানের হানাহানি কাটাকাটি এখনও শহর আর শহরতলি ঘিরে, বিস্তীর্ণ গ্রামীণ এলাকাতে তাদের নিজস্ব সমাজ কাঠামো নিয়ে তারা খুশি। হ্যাঁ, বাংলাদেশ কিন্তু সামান্য পিছিয়েছে, আপাতত র্যাঙ্কিং ১৩৪, দারিদ্র, চিকিৎসার অভাব, আর বন্যার মতো সমস্যা আর রাজনৈতিক অবস্থার এক ডামাডোল তাদের সুখ কেড়ে নিয়েছে। শ্রীলঙ্কা ভারতের ঠিক নীচে, ১৩৩-এ। সম্প্রতি টাকার সমস্যা আর রাজনৈতিক ঝামেলায় তাদের সুখ কমেছে। আগে তারা ভালো ছিল। মায়ানমার ভারতের নীচে, ১২৬ নম্বরে। সেখানে যুদ্ধ, সেনার শাসন, আর মানবাধিকারের সমস্যা সুখ কমিয়েছে। তবে স্কোর ভারতের কাছাকাছি। এবারে চলুন বিষয়টাকে সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে দেখা যাক।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | গলা টিপে মারবেন দিলীপ ঘোষ
হ্যাঁ, বিশ্বে সুখ কোথায়? কাদের হাতে? শীর্ষে কারা? ফিনল্যান্ড (৭.৭), ডেনমার্ক (৭.৬), আইসল্যান্ড (৭.৫), সুইডেন (৭.৪) এরা উত্তর ইউরোপের দেশ। এদের সামাজিক সাহায্য, রাষ্ট্র সমাজের অনেক বেশি দায় নেয়, বেকারত্ব নেই বললেই চলে, আর দুর্নীতি কম। এই দেশগুলোতে রাজনৈতিক বিরোধ কম, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিরোধ নেই বললেই চলে, কাজেই সুখ সেখানে এসেছে এই বসন্তে। অবাক করা তথ্য হল মেক্সিকো আর কোস্টা রিকা এবার প্রথম ১০-এ উঠে এসেছে। কিন্তু আমেরিকা ২৪ নম্বরে নেমে গেছে, এটা তাদের সবচেয়ে কম স্থান। তরুণদের মধ্যে অসুখ বাড়ছে বলেই নাকি এটা হয়েছে, সেখানে নাকি কিশোর, যুবক, তরুণদের বিরাট অংশই অস্থিরতায় ভুগছে, তাদের একটা বিরাট অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সবচেয়ে কম সুখী কোন দেশ? আফগানিস্তান এক্কেবারে শেষে, হ্যাঁ ধর্মীয় মৌলবাদ সমাজের সুখ কেড়ে নেয়। এদিক থেকে দেখতে গেলে যে সব দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে, সেখানেই সুখ উড়ে গেছে চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে। এই রিপোর্ট কী বলছে?
২০২৫ সালের এই রিপোর্টে বলছে যারা একা খায় তাদের সুখ ৪.৯, আর যারা পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে খায় তাদের ৫.৫-৫.৬। মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা আর পরোপকার করা সুখ বাড়ায়। ১৯ শতাংশ তরুণের কোনও সামাজিক সাহায্য নেই, যেটা ২০০৬ থেকে ৩৯ শতাংশ ছিল। এটা দেখায় সমাজে একসঙ্গে থাকা কত জরুরি। ধর্ম, জাত আর চূড়ান্ত আর্থিক বৈষম্যের ফলে মানুষের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, অসুখ বাড়ছে। কিন্তু সেসবের মধ্যে সামাজিক বিভেদ, যা সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে তৈরি হয়, যা ধর্ম আর জাতপাতের বিভেদের ফলে তৈরি হয়, সেটাকে রুখে দিতে পারলেই অনেকটা সুখ এসে যাবে মানুষের জীবনে, হ্যাপিনেস ইনডেক্স সেই কথাই বলছে।