যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। কিছু বলার আগেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই গানটার কথা মনে পড়ে গেল, হেসে নাও – এ দু’দিন বই তো নয়, কার কী জানি কখন সন্ধে হয়। আগে নিউজ চ্যানেল তো নিউজ মানে খবরের জন্যই দেখত, এখন নিউজ চ্যানেল আপনি অনায়াসে হাসতে ইচ্ছে হলেও দেখতেই পারেন, খবর দেখে আপনার হাসি পেতে পারে, কেবল হাসি নয় অট্টহাসিও হেসে ফেলতেই পারেন। যেমন এই সেদিন দেখছিলাম মহাকুম্ভে নাকি গোপনে পুতিন আর ট্রাম্প চান করে গেছেন, ইসলামিক দেশগুলো তাই দেখে নাকি ভীত, আগুনে জ্বলছে আমেরিকা, হাউহাউ করে কাঁদছেন ট্রাম্প, মোদিজি তাই দেখে আগুন সামলানোর জন্য হেলিকপ্টার পাঠিয়েছেন, আমেরিকাতে মুসলমানদের ব্যান করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং এগুলো ছোটখাটো চ্যানেলে নয়, বিশাল বড় চ্যানেলে যাঁদের বাংলা ভার্সনের ক্যাপ্টেন আর একটু হলেই বাংলাদেশ দখল করে নিচ্ছিলেন।
এসব খব শুনে রাগ হওয়ার থেকে আমার হাসিই পায়, কারণ আসলে তো এগুলো খবর নয়, মাইনে করা চাকরবাকরদের প্রোপাগান্ডা। কিন্তু সে সবের মধ্যেই কিছু খবর থাকে যা অনাবিল হাসির। তেমনই গতকাল এক খবরের শিরোনাম ছিল মমতা নে ব্যান্ড বজা দিয়া। মানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যান্ড বাজিয়ে দিয়েছেন। এমনিতে বলে রাখি এই ব্যান্ড বজা দিয়া কথাটা হিন্দির এক বাগধারা, আমাদের বাংলার যেমন আছে কাঁথায় আগুন লাগানো, সেই সমগোত্রের। কাজেই খুব একচোট হেসে নিয়ে তারপর খবরটাতে মন দিয়েছিলাম। ২৬ জানুয়ারি উপলক্ষে রাজভবনে অনুষ্ঠান ছিল, অতিথি অভ্যাগতদের সামনে ব্যান্ডে বিভিন্ন গানের সুর তোলা হবে, দেশাত্মবোধক গান, এমনটা বহুকালের প্রথা। আমাদের কলকাতা পুলিশের ব্যান্ড আছে তারা বেশ দক্ষ এই কাজে। তো দেখা গেল, না, তাঁদের জায়গা নেই, তাঁরা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন শুকনো মুখে, তাঁদের জায়গাতে বিএসএফ-এর ব্যান্ড হাজির। ও আমার দেশের মাটির জায়গাতে ও মেরে বতন কে লোগো, খুব স্বাভাবিক। এদিকে আমাদের রাজ্যপালের নামের শেষে বোস লেগে থাকলেও তাঁর কাজেকর্মে সেই বোসের ছিটেফোঁটাও আমরা দেখিনি। উনি তো মাঝখানে কলকাতা পুলিশকেই ব্যান করেছিলেন ওনার রাজভবনে, সবটাই সিআইএসএফ-এর হাতে এখনও, রাজ্য সরকারে আস্থা নেই, রাজ্য পুলিশে ভরসা নেই। এখন তা ছড়িয়েছে এমনকী ব্যন্ডের প্রোগ্রামে।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | সইফের ঘরে বাংলাদেশের শরিফুল ইসলাম? সত্যিটা কী?
এবার আসুন বিষয়টা আর এক দিক থেকে দেখা যাক। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অবশ্য শেষ পর্যন্ত ওই কলকাতা পুলিশ ব্যান্ড সুর শুনিয়েছে, মহামহিম রাজ্যপালও সেই সুর শুনতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু আসলে এটা একটা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। মোদিজি ক্ষমতায় আসার আগে রাষ্ট্রপতিকেও চিঠি লিখে এই রাজ্যপাল পদে বসে থাকা মানুষজন যে আসলে দিল্লিতে বসে থাকা সরকারের পেটোয়া, তারা যে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু তা জানিয়েছিলেন। দাবি করেছিলেন এমন রাজ্যপালের যাঁরা আদতে রাজনীতির লোক নন, কিন্তু ক্ষমতায় এসেই রাজ্যে রাজ্যে নিজের দলের কেবল নয় আরএসএস ঘনিষ্ঠদের রাজ্যপাল করেছেন, নিজের পেটোয়া কিছু আমলাদের রাজ্যপাল করেছেন যাঁরা প্রতি পদে পদে রাজ্য সরকারকে হেয় করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন। পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল তার ব্যতিক্রম নয়। উপাচার্য নিয়োগই বলুন বা বিধায়কদের শপথগ্রহণ, প্রতিটি বিষয়েই রাজ্যপাল রাজ্যের নির্বাচিত সরকার, নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে অপদস্থ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, রাজভবনকে বিজেপির দফতর বানিয়ে তোলা হয়েছে আর সেসব মানুষের চোখের সামনেই করা হচ্ছে। রাজ্যপাল একটি দুধেভাতে পদ ছাড়া কিছুই নয়, বহুবার এই পদ বিলুপ্ত করার কথা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রে শাসকদলের অতি অতি বৃদ্ধ ইত্যাদিদের অবসরকালীন সুবিধে দেওয়ার জন্য এ পদ অ্যাপেন্ডিক্স-এর মতো থেকে গেছে। কিন্তু বিপদ হল কখনও সখনও সেই রাজ্যপালের সুখে থাকতে ভূতে কিলোনোর রোগ হয়।
কেরালা, তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ সর্বত্র রাজ্যপালেদের ছবি একই, তাঁদের নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়েই তাঁরা চলেছেন। যদি রাজ্যের রাজ্যপাল নিজেই জানিয়ে দেন যে রাজ্যের পুলিশ কলকাতা পুলিশ কোনও কাজের নয়, তাঁদেরকে এমনকী রাজভবনের সুরক্ষার জন্যও রাখা যায় না, তাহলে রাজ্যের মানুষের কাছে কোন মেসেজটা পাঠানো হয়? অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য, ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর তথ্য বলছে সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে অপরাধ কম যে মেট্রো শহরে তার নাম কলকাতা। সুরক্ষার দায় তো ছেড়েই দিন, রাজ্যের রাজ্যপাল মনে করেন বা মনে করানোর চেষ্টা চালান যে এমনকী কলকাতা পুলিশের ব্যান্ডও সেই মানের নয় তাই তিনি ডেকে আনেন বিএসএফ-এর ব্যান্ডকে। ধন্যবাদ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, এত কিছুর মধ্যেও তাঁর চোখে পড়েছে কলকাতা পুলিশের ব্যান্ড বাজনদারেরা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের বাজাতে দেওয়া হয়নি। তিনি কেবল প্রতিবাদ করেছেন তাই নয়, সেই বাজনদারদের এনে বাজানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, নিজে সেই বাজনা শুনেছেন এবং ওই কালো চশমা রাজ্যপাল মহামহিম বোসকেও দাঁড়িয়ে সেই বাজনা শুনতে বাধ্য করেছেন, এবং সেই জন্যই গতকাল মমতা নে ব্যান্ড বজা দিয়া হেডলাইন শুনে আমার খুব তৃপ্তি হয়েছে। হ্যাঁ, দিদিমণি আপনি রাজ্যের স্বার্থে এমন ব্যান্ড বাজাতে থাকুন।