যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দু’টো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা; যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন, আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। মাত্র ক’মাস আগে লোকসভার নির্বাচনের ফলাফল হাতে আসার পরেই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সেই উন্মাদনা আমরা দেখেছি। কে হেরেছে, কে জিতেছে বোঝা যাচ্ছিল না। আসলে ‘অবকি বার ৪০০ পার’-এর সেই মহা বাওয়ালের পরে ২৪০ তো একরকম হারই ছিল। কিন্তু এখন ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন সেই হার কি ইন্ডিয়া জোটের জন্য হয়েছিল? মহারাষ্ট্রে মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি তো আগেই ছিল, বিহারেও ছিল মহাগটবন্ধন। বাকি কোথাও কেউ কাউকে কি এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়েছিল। বাংলাতে কং, সিপিএম, তৃণমূল ঘমাসান লড়াই, কেরালাতে কং সিপিএম সাপে নেউলে লড়াই, রাহুল গান্ধীর প্রতিদ্বন্দী তো ছিলেন এক বাম প্রার্থী। কিন্তু সেই খেওখেয়ির মধ্যে দেশের রাজধানীতে এক জোট হয়েছিল। চূড়ান্ত কংগ্রেস বিরোধিতার রাজনীতি থেকেই উঠে আসা আম আদমি পার্টি আর কংগ্রেসের মধ্যে অন্তত আসন ভাগাভাগি হয়েছিল। কিন্তু ভোটের ঠিক আগে কেবল ক্ষমতা দখলের জন্য সেই চালাকি মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল। ৭ টা আসনে ৭ টাই পেয়েছিল বিজেপি, ৫৬-৫৭% ভোট পেয়ে। তো সেটা যে এক মস্ত চালাকি ছিল সেটা প্রমাণ করতেই বিধানসভাতে কংগ্রেস আর আম আদমি পার্টি মুখোমুখি দাঁড়াল কেবল নয় একদল অন্যদলকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণও করলো। ইন্ডিয়া জোটের এটাই হল আদত জোট ধর্ম।
সিপিএম বাংলায় তৃণমূলকে বলে, বিজেমূল; কেরালাতে কংগ্রেসকে বলে, বিজেপির বি-টিম; কংগ্রেস কেরালাতে সিপিএম-কে বলে, বিজেপির ছুপা দোস্ত, ডিসগাইজড ফ্রেন্ড; বাংলায় তৃণমূলকে কংগ্রেস বলত, দিদি মোদি সেটিং হ্যায়, এটা কমরেড অধীর কমরেড সেলিমের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। এই বাংলার দিদিমণি কংগ্রেস, সিপিএম আর বিজেপিকে জগাই, মাধাই, গদাই বলেন, আমরা জানি। দিল্লিতে আপ কংগ্রেসকে বলে, বংশানুক্রমিক শাসন; কংগ্রেস আপকে বলে, এক নম্বরের দুর্নীতিবাজ। মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস সাভারকার বিরোধী, তাঁদের বন্ধু শিবসেনা সাভারকারের নামে একটা কথা শুনলেও রেগে যান। আচ্ছা বলুন তো এরপর বিজেপির কি খুব বেশি কিছু করার দরকার পড়ে? কিন্তু মানুষ বুঝেছিল বিজেপির হাতে ৪০০ সাংসদ থাকলে তারা সংবিধানের গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করে ছাড়বে। মানুষ বিজেপিকে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও দেয় নি। কিন্তু বিজেপি ২৪০-এ থেকে যেতেই ইন্ডিয়া জোটের আনন্দ দেখে কে? যেন বিজেপি হেরেই দিয়েছে, রাহুল গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | ট্রাম্প সাহেবের ইচ্ছেগুলো
তো মে মাসের পরে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লি, বাংলা তামিলনাড়ু বাদ দিয়ে সমস্ত উপনির্বাচনে বিরোধীদের যাকে বলে ধুয়ে দিয়েছে বিজেপি। খেয়াল করে দেখুন সেই থমকে যাবার পর থেকেই আরএসএস-এর সক্রিয়তা বেড়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ হয়েছে, এই বাংলাতেও সরসংঘপ্রধান এসে ঘাঁটি গাড়ছেন, তাঁরা বকলমে নির্বাচন পরিচালনা করবেন, এমনটা নাকি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব নিয়ে পরে একদিন আলোচনা হবে, কিন্তু আজকের আলোচনা দিল্লির নির্বাচন, নির্বাচনের সময়ে যে কংগ্রেস আপ-কে চোর চোট্টা, অকর্মণ্য বলেছিলেন, ফলাফলে তারা শূন্য পাবার পরেও কি সেটা বলা বন্ধ করেছে? ঘন্টা। সন্দীপ দিক্ষিত নাকি কাছের লোকজনদের বলেছেন, “আই হ্যাভ ডন মাই জব, নাউ আই ক্যান গো ফর অ্যা স্লিপ পিসফুলি।” রাহুল বলেছেন, “এই হারের পরেও আমাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই থাকবে।” কংগ্রেসের আড়কাটিরা পঞ্জাবে আপ কে ভাঙার কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। উল্টোদিকে কেজরিওয়াল কংগ্রেসই যে বিজেপির সঙ্গে মিলে তাঁকে হারাল, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। লেগে যা লেগে যা নারদ নারদ।
এবারে আসুন একটু অন্যদিক থেকে কথাটা আলোচনা করা যাক। এরকমটাই কি স্বাভাবিক ছিল না? ইন্ডিয়া জোট প্রায় সবটাই কি একধরণের চালাকি নয়? মানুষকে এক ধরণের বোকা বানানোর জন্য তৈরি খুড়োর কল নয়? পুরোটাই কি স্রেফ ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়? একদমই তাই। কিন্তু বলতেই পারেন যে সংসদীয় গণতন্ত্রের মানেই তো তাই, মানুষকে বুঝিয়ে ভোট পেয়ে ক্ষমতা দখল করতে হবে। হক্কের কথা বলেছেন কর্তা, বচ্চে লোগ তালি বাজাও। মানুষকে বুঝিয়ে ভোট পেতে হবে, মানুষকে বোকা বানিয়ে নয়। এই কেজরিওয়াল অ্যান্ড কোম্পানির প্রত্যেকে, হ্যাঁ প্রত্যেকে- যোগেন্দ্র যাদব থেকে প্রশান্ত ভূষণ থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল থেকে আশুতোষ, কুমার বিশ্বাসেরা তো কংগ্রেসের দুর্নীতি আর অপশাসনের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছিলেন ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত। যেই বিজেপি ক্ষমতায় এল, অমনি কংগ্রেসের সব দোষ গঙ্গা যমুনাতে ধুয়ে গেল? এই সিপিএম সেদিন ব্রিগেডের মাঠে জনসমাবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলেছিল উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে, না হলে সরকার ফেলে দেব, ফেলার চেষ্টা করেও পারেন নি, সেটা আলাদা কথা। আমেরিকার কাছে যে দল দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছিল, তারা কি আবার তা কিনে সিপিএম এর কাছে জমা রেখেছে? দুটো যুক্তি এর পরেই আসবে জানি, ১) বিজেপি আরও বড় শত্রু। ২) সময়ের দাবি মেনেই বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলে বলুন না বিজেপিইই যদি সবচেয়ে বড় শত্রু হয় তাহলে নিজেদের মধ্যে ভাদ্রের কুকুরের মত ঝগড়া চালিয়ে যাওয়ার মানে কী? সময়ের দাবী মেনেই যদি ঐক্য করতেই হয় তাহলে পুরনো অভিযোগগুলো নিয়েও তো দু চারটে কথা বলতে হবে। এ ওকে বিজেপির বন্ধু বলছেন, ওধারে বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটে গিয়ে দাঁত কেলাচ্ছেন। আসলে পাবলিককে এনারা বোকা ভাবেন, ভাবেন যা বোঝাবো তাই বুঝে নেবে ওরা।
সেই কবে ১৯৭৪-এ ‘রোটি’ নামে একটা ছবি হয়েছিল, মনমোহন দেশাই এর ছবি। অভিনয়ে রাজেশ খান্না, মুমতাজ, জিতেন্দ্র, আসরানি, ওম প্রকাশ। গান লিখেছিলেন আনন্দ বকশি, সুর ছিল লছমিকান্ত পেয়ারেলাল-এর, গেয়েছিলেন কিশোর কুমার। গানটা ছিল, “Ae babu ye public hai public / ye jo public hai ye sab jaanti hai, public hai, aji andar kyaa hai aji baahar kyaa hai, andar kyaa hai baahar kyaa hai, ye sab kuchh pahchaanti hai, public hai ye sab jaanti hai, public hai, ye jo public hai ye sab jaanti hai” গানটা শুনেছেন সবাই, মানেও বুঝেছেন সবাই, থুক্কুড়ি, সবাই নয়, রাহুল কেজরিওয়াল বোঝেন নি, বোঝেন নি বলেই এই হাল।