যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। সাতসকালে উঠেই আমরা আমাদের ইচ্ছের ঝুলি নিয়ে বসি, আজ চা নয় কফি খাব, আজ আমার জলখাবারে ময়দার লুচি আর ফুলকপি দেওয়া সাদা সাদা আলুর তরকারি চাই, কেবল ক’টা কালোজিরে দেখা যাবে আর একটা লঙ্কা ভাসবে তাতে। এরকম ডিটেলে আমাদের ইচ্ছেগুলো জাহির করি আমরা, সে ইচ্ছে কখনও ধরা দেয়, কখনও বা ফড়িং হয়ে উড়ে চলে যায়। সে ইচ্ছের কিছুটা সম্ভব, সাধ্যের মধ্যে আর কিছুটা হল একটা ফুল কোর্স ডিনার শাহরুখের সঙ্গে, এই ধরনের উইশফুল থিঙ্কিং। তো আমরা সেসব করতেই পারি, কারণ আমাদের ইচ্ছেগুলো তো নিছকই ইচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্প সাহেবের ইচ্ছেগুলো? তিনি হলেন দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর দেশের প্রধান, তাঁর হাতে ডলার, তাঁর হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারার মারণাস্ত্র, তাঁর হাতে সিআইএ, দুনিয়ার দেশে দেশে তাঁদের কত শত তাঁবেদার, কত মিডিয়া আর কলামনিস্টকে টাকা দিয়ে পোষা আছে। তো তিনি যদি ইচ্ছের কথা বলেন তাহলে তা তো আমাদের গদা, পচা, সান্টা, মন্টাদের ইচ্ছে হবে না, তার মানেই আলাদা।
তিনি বলেছেন, মানে তাঁর ইচ্ছে হয়েছে আমার গ্রিনল্যান্ড চাই। বোঝো কাণ্ড। তাঁর ইচ্ছে হয়েছে সব ইললিগাল ইমিগ্রান্টস মানে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেবেন, তো তারা অবৈধ কে ঠিক করবে? কেন? ওনার প্রশাসন। মানে উনিই পুলিশ উনিই বিচারক, খেল খতম, পয়সা হজম। ওনার ইচ্ছে হয়েছে পানামা ক্যানেলটাও চাই। ওনার ইচ্ছে মেক্সিকো–আমেরিকার সীমান্ত ঘেঁষে ৭ ফুট লম্বা পাঁচিল তুলে দেবেন আর সেই পাঁচিলের খরচ নেবেন মেক্সিকোর থেকেই। ওনার ইচ্ছে হয়েছে তাই বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা থেকে উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন, ওসব ফালতু মানবাধিকার ইত্যাদিতে ওনার কোনও আস্থাই নেই। চেয়ারে বসেই জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ সমেত বিভিন্ন দেশে যে সাহায্য যেত, তা আজ থেকে বন্ধ, তাঁর ইচ্ছের ঠেলায় বহু প্রান্তিক মানুষ, দরিদ্র মানুষের মাথায় হাত। ওনার ইচ্ছে হয়েছে তাই উনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছেন, ওটা নাকি চীন বকলমে চালায়। মানে নানান ইচ্ছে, ওনার মনে হচ্ছে, উনি বলছেন। এক ট্রিলিওনেয়ার ব্যবসায়ী ইলন মাস্ককে বসিয়েছেন সরকারি কিছু দায়িত্বে তো তিনি সেসব করার আগে লন্ডনে টিউব রেল স্টেশনের বাইরে বাংলা হরফ দেখে বেদম চটে গেছেন, বাংলা কেন? হোয়াই বাংলা? আর ট্রাম্প সাহেব তো অধুনা বাংলার কার্যনির্বাহী সরকারের প্রধান ইউনুস সাহেবের নাম শুনলেও চটে যান। সব মিলিয়ে ট্রাম্প সাহেব, তাঁর সরকার, তাঁর দফতরের লোকজনদের ইচ্ছের এই বহর দেখে আমাদের অনেকেই ভাবছেন এ কোন উন্মাদের প্রলাপ? এ তো আজ পানামা চায় কাল কলকাতার বন্দর পশু ঢাকার রমনা ময়দান চেয়ে বসবে।
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলে তৈরি হবে নতুন বাংলাদেশ
এবারে আসুন এই পাগলপন্থী নিয়ে একটু আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যাক। ম্যাডনেস বলছেন তো, কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখতে পাবেন দেয়ার ইজ অ্যা সলিড প্যাটার্ন ইন দিস ম্যাডনেস। এই পাগলামির মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ছক আছে। প্রতিটা সিদ্ধান্তের পিছনে ট্রাম্প সাহেবের এক পরিকল্পনা আছে। আপনি বিরোধিতা করতেই পারেন, আপনি বলতেই পারেন যে এটা হতে দেওয়া যায় না, কিন্তু ওনার দেশের মানুষজনের কাছে উনি একটা নতুন দিশা নিয়ে দাঁড়াতেই এই সব বলছেন বা করছেন। গত বেশ কিছু বছর ধরে, এমনকী এর আগে ট্রাম্প সাহেবের যরকার যখন ছিল তখনও আমেরিকার অর্থনীতির বেশ কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছিল যা বাইডেন আসার পর ফেটে বেরিয়েছে। বাড়তে থাকা বেকারত্ব গ্রাস করছিল আমেরিকাকে, সোশ্যাল সিকিউরিটির ভাঁড়ার কমছিল, ফান্ড নেই তাই বহু সুযোগ সুবিধে কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল, আর অনাবশ্যক যুদ্ধ ইত্যাদির ফলে অনর্গল টাকা খরচ হচ্ছিল। কিন্তু সেরকম কোনও কলোনিও তৈরি হচ্ছিল না যা আমেরিকাকে সুবিধে দেবে। এগুলো মাথায় রেখেই ট্রাম্প সাহেব প্রথম যে কাজটা করতে শুরু করেছেন যেখানে আমেরিকার স্বার্থ নেই সেখানে দান খয়রাত বন্ধ। পানামা খালের জন্য টাকা জুগিয়েছিল আমেরিকা, এবার তা ফেরত চাই, এটা একটা হুমকি যা দিয়ে তিনি দর কষাকষি শুরু করবেন। একই কথা গ্রিনল্যান্ড নিয়েও, কেবল গ্রিনল্যান্ডের খনিজ তেলের ভাণ্ডারই নয়, গ্রিনল্যান্ড হাতে পেলে পুরো আর্কটিক সাগরের উপরে নজরদারি থাকবে আমেরিকার। এমনিতেই এখন গ্রিনল্যান্ডের উত্তরে একটা আমেরিকান সেনাঘাঁটি রয়েছে। এই যে অবৈধ অভিবাসন, মানে তাদেরকে ঘাড় ধরে হাতে শেকল পরিয়ে যুদ্ধ জাহাজে পাঠানোর ব্যবস্থা, কেন? এগুলো হলো দেশের বেকার যুবকদের কাছে একটা মেসেজ, এদের জন্য চাকরি পাচ্ছিলে না, এবারে পাবে। আসলে ট্রাম্প আমেরিকাকে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে তৈরি করতে চাইছেন, এক প্রবল ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যে আপনার প্রতিটা ব্যাপারেই নাক গলাতে পারবে, কিন্তু আপনি তার নাগালও পাবেন না। ট্রাম্প সাহেবের এই পাগলামোকে খানিক সেয়ানা পাগলামি বললেও ভুল হবে না কারণ পৃথিবীর প্রত্যেক উগ্র দক্ষিণপন্থী নেতা আদতে এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চায়, ট্রাম্প সাহেব তার অন্যথা নন।
কিন্তু সমস্যা হ্যাজ, সমস্যা আছে, এসব যদি আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে হত, তাহলেও একরকম ছিল। এখন উল্টোদিকে চীনের উত্থান, নতুন প্রযুক্তিতে তাদের হই হই করে এগিয়ে যাওয়া, রাশিয়ার সঙ্গে এক ধরনের আঁতাঁত, আগামী দিনে এক শিবির তৈরির চেষ্টা আমেরিকার এই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার পক্ষে আরও বিপজ্জনক, তখন এই ট্রাম্প সাহেবও বুঝবেন, দুনিয়াতে তাঁরাও বন্ধুহীন হয়ে চলতে পারবেন না। এই রাশিয়া চীন অক্ষের অগ্রগতি আটকাতেই মানবাধিকার থেকে শুরু করে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি থেকে অনুন্নত দেশে সাহায্য পাঠানোর কথা তাঁদের ভাবতেই হবে। আফটার অল এমনি এমনিই তো সেসব দান ধ্যান করতেন না, তার যথেষ্ট জিওপলিটিকাল, ভূরাজনৈতিক কারণও ছিল। আমাদের এখন বসে বসে দেখার সময়, কখন আমাদের ট্রাম্প সাহেবের এই উৎকট ইচ্ছেগুলোকে বাদ দিয়ে বাস্তববুদ্ধি জেগে ওঠে।