Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | ডাবল ইঞ্জিন সরকার, বিজেপির হাতিয়ার    

Fourth Pillar | ডাবল ইঞ্জিন সরকার, বিজেপির হাতিয়ার    

Follow Us :

ডাবল ইঞ্জিন সরকার হলে রাজ্যের উন্নয়ন, বিকাশ হবে দ্রুত, মোদিজি এটাই বলেন নির্বাচনী সভায় সভায়, বিজেপি বলে, অমিত শা বলেন। এ এক নতুন তত্ত্ব যা বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরেই হাজির হয়নি, ইন ফ্যাক্ট ২০১৯-এ জিতে আসার পরেই এই ডাবল ইঞ্জিন সরকারের তত্ত্ব ছড়ানো হয়েছে খুব সুচতুরভাবে। যুক্তিটা খুব সোজা, দিল্লিতে এবং রাজ্যে যদি একই দল সরকারে থাকে, তাহলে রাজ্যের উন্নতি বেশি হবে। কী করে? অন্য কোনও দলের সরকার থাকলে কেন হবে না? যুক্তিটা কী? চলুন যুক্তিটা আমাদের চায়ওয়ালা কাম চৌকিদারকে নিয়েই সাজানো যাক। নরেন্দ্র মোদি ২০০১ অক্টোবর থেকে ২০১৪ মে মাস পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ওনার দাবি, এরই মধ্যে গুজরাত এত বিকশিত হয়েছে যে তা সারা দেশের কাছে এক মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে, গুজরাত মডেল। যদিও এই দাবি অন্তঃসারশূন্য, তবুও তর্কের খাতিরেই মেনে নেওয়া যাক, ২০০১ অক্টোবরে ক্ষমতায় এসে ২০১৪, মানে ১৩ বছরে মোদিজি গুজরাতের এত উন্নতি করেছেন যে তা দেশের সামনে এক মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তো এই ১৩ বছরের হিসেব বলছে, তিন বছরের কিছু কম সময়ে দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী আর ৯ বছর, মানে সিংহভাগ সময় জুড়েই ক্ষমতায় ছিলেন মনমোহন সিং। দিল্লিতে তখন ইউপিএ সরকার, যখন নাকি মোদিজির কথায় গুজরাত হু হু করে বিকাশের পথে চলেছে, উন্নয়ন ঝরে ঝরে পড়ছে। তাহলে উন্নয়ন আর বিকাশের জন্য ডাবল ইঞ্জিন সরকার প্রয়োজন, সেই যুক্তি কি দাঁড়ায়? এ প্রশ্ন মোদিজিকে করা যাবে না, এখন গাছে আম পাকছে, এখন একটাই প্রশ্ন আপনি আম চুষে খান, কেটে খান না চেটে খান? তাহলে রাজ্যের উন্নয়নের শর্ত ডাবল ইঞ্জিনের সরকার তো হতে পারে না, তাহলে এই ডাবল ইঞ্জিনের কথাটা বাজারে বিজেপি, মোদি–শাহ ছাড়লেন কেন? সেটা কি হুমকি, মানুষের কাছে একটা মেসেজ যে আমাদের ভোট দিন, না হলে উন্নতি হবে না নয়, উন্নতি হতেই দেব না। টাকা আটকে রাখব, নানান অছিলায় প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখব। এমনকী গরিব মানুষেরা কাজ করেছেন কিন্তু টাকা পাচ্ছেন না এই রাজ্যে, এরকম একটা অবস্থা তৈরি করে দেব। অতএব বিজেপিকে ভোট দিন, কোট আনকোট উন্নয়নের দরজা খুলে যাবে? রাজ্যের মানুষ ট্যাক্স দেবেন, রাজ্যের মানুষের শ্রমে তৈরি হবে সম্পদ, কেন্দ্র এক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, বিচারবুদ্ধি দিয়ে সেই সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থা করবেন, এটাই তো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। তার বদলে বিজেপি, মোদি–শাহ যেটা করছে তাকে অত্যন্ত নিম্নস্তরের ষড়যন্ত্র বললেও কম বলা হয়। 

তাহলে দুটো জিনিস আমরা আলোচনা করলাম, প্রথম হল এই ডাবল ইঞ্জিন সরকার এক হাস্যকর তত্ত্ব যার পেছনে কোনও যুক্তিও নেই, যার সমর্থনে কোনও তথ্যও নেই। দ্বিতীয়টা হল আসলে এই তত্ত্ব বিজেপি মোদি–শাহের আমদানি করা এক তত্ত্ব যা আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিরোধী এক ষড়যন্ত্র। এবার আসুন, মানুষ কি সেটা মেনে নিচ্ছে? ২০১৯-এর পর থেকে রাজ্যে রাজ্যে যে নির্বাচন হয়েছে তা সামনে রেখে আলোচনা করলেই সত্যিটা বেরিয়ে আসবে। দিল্লিতে নির্বাচন হল ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০। ৫৩.৭ শতাংশ ভোট আর ৬২টা আসন পেল আপ, বিজেপি পেল ৩৮.৫১ শতাংশ ভোট আর ৮টা আসন। মানুষ ওই ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্ব মেনে নেয়নি। এরপরে ২০২০-র অক্টোবরে নির্বাচন হল বিহারে। নীতীশ–বিজেপি জোট পেল ৩৭.২৬ শতাংশ ভোট আর আসন ১২৫টা। বিহারে সেবার তৈরি হয়েছিল মহাগটবন্ধন, আরজেডি, কংগ্রেস, সিপিআইএমএল লিবারেশন, সিপিএম আর সিপিআই মিলে পেল ৩৭.২ শতাংশ ভোট আর ১১০টা আসন। মানে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি। নীতীশ-বিজেপি জোট সরকার সেবারই পড়ে যেত যদি না আসাদউদ্দিন ওয়েইসির দল ৫টা আসন জিতে ১.০৩ শতাংশ ভোট না কাটত। তার মানে বিহারেও ওই ডাবল ইঞ্জিন তত্ত্ব খাটেনি। এবার চলুন ২০২১-এ যাওয়া যাক। ২০২১-এ নির্বাচন হল অসম, কেরল, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু আর আমাদের বাংলাতে। আসুন হিসেবটা দেখে নিই। বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ পেল ৪৪.৫১ শতাংশ ভোট আর ৭৫টা আসন। সম্মিলিত বিরোধী মহাজোট ৪৩.৬৮ শতাংশ ভোট এবং ৫০টা আসন। মানে বিজেপি জিতেছে, এনডিএ জিতেছে ঠিক, কিন্তু তাদের ডাবল ইঞ্জিন সরকারের তত্ত্ব কি জিতেছে? হিসেব বলছে, বিরোধী মহাজোট দেড় লক্ষের কিছু বেশি ভোট পেলে হিসেব এক্কেবারে উলটো হতেই পারত। দিল্লিতে মোদি আর রাজ্যেও বিজেপি সরকার হলেই উন্নয়ন হবে রাজ্যের সমান সমান সংখ্যক মানুষ তাতে সায় দিয়েছে এবং দেয়নি। এবার চলুন কেরলে। সিপিএম-এর নেতৃত্বে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট পেয়েছিল ৪০.৩৯ শতাংশ ভোট আর ৯১টা আসন। কংগ্রেসের নেতৃত্বে সংযুক্ত গণতান্ত্রিক মোর্চা পেয়েছিল ৩৭,৬৬ শতাংশ ভোট আর ৪০টা আসন। বিজেপি পেয়েছিল ১১.৩০ শতাংশ ভোট আর কোনও আসন পায়নি। কেরলের মানুষ ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্ব নেয়নি। পুদুচেরিতে এনডিএ ১৬টা আসন পেয়েছিল ৪৩.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, ইউপিএ পেয়েছিল ৩৭.৯ শতাংশ ভোট আর ৯টা আসন। হ্যাঁ, যুক্তি মেনে নিলে পুদুচেরি ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের তত্ত্ব মেনেছে। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র নেতৃত্বে সেকুলার প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পেয়েছিল ৪৫.৩৮ শতাংশ ভোট, ১৫৯টা আসন। এআইডিএম-কের নেতৃত্বে জোট পেয়েছিল ৩৯.৭২ শতাংশ ভোট আর ৭৫টা আসন। বিজেপি এই জোটেই ছিল, ৪টে আসন পেয়েছিল। মানে তামিলনাড়ুর মানুষ ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের তত্ত্বে সায় দেয়নি। এবার বাংলার ফলাফল সব্বাই জানেন, এখানেও গলা ফাটানো হয়েছিল ডাবল ইঞ্জিনের সরকার নিয়ে। ৪৮.০২ শতাংশ ভোট আর ২১৫টা আসন নিয়ে তৃণমূল আবার ক্ষমতায় ফিরেছিল, বিজেপি ৭৭টা আসন আর ৩৭.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বাম-কং-আইএসএফ জোট ১টা আসন আর ৪.৭১ শতাংশ ভোট নিয়েই দৌড় শেষ করেছিল। না, বাংলা ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্ব মেনে নেয়নি। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির হনুমান ভক্তি এবং দু’ চারটে কথা    

২০২২-এ গুজরাত, মণিপুর, উত্তরাখণ্ড, গোয়া, পঞ্জাব, হিমাচলপ্রদেশ আর উত্তরপ্রদেশে ভোট হয়েছিল। ২০২২-এর এই নির্বাচনগুলোর মধ্যে গুজরাত, মণিপুর, উত্তরাখণ্ড, গোয়া আর উত্তরপ্রদেশ এই ডাবল ইঞ্জিন সরকারের তত্ত্বতে সিলমোহর দিয়েছে আর হিমাচলপ্রদেশ আর পঞ্জাব সেই ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপর ২০২৩ ত্রিপুরা, মেঘালয় নাগাল্যান্ডেরর ভোট। ত্রিপুরাতে তিপ্রা মথা যারা বাম আর বিজেপির বিরোধিতা করেই নির্বাচনে নেমেছিল তারা ১৯.৭ শতাংশ ভোট নিয়ে নিজেরা ১৩টা আসন পেলেও ১৮টা আসনে বিজেপিকে জিততে সাহায্য করে। মানে তাদের ভোট কাটার ফলেই বিজেপি জিতেছিল। তিপ্রা মথা না থাকলে বিজেপি জোট ১৫টা আসনও পেত না আর বাম-কং-তিপ্রা মথা জোট হলে বিজেপি জোট ৩-৪ টে আসনও পেত না। এ রাজ্যের নির্বাচন বলে দেয় আর যাই হোক এই রায় ডাবল ইঞ্জিন সরকারের পক্ষে নয়। আর মেঘালয়ে বিজেপির ২ জন নির্বাচিত হয়েছেন, নাগাল্যান্ডে ১২ জন, ৫ বছর আগে ঠিক এটাই ছিল বিজেপির আসন সংখ্যা। কাজেই উত্তর পূর্বাঞ্চলে মিলিজুলি সরকার তৈরি হয়েছে ঠিক, কিন্তু তা ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্বকে মেনে এমন কথা বলা যাবে না। এরপর এই কর্নাটকের ভোট, ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্বকে ছুড়ে ফেলে দিয়েই জিতেছে কংগ্রেস দল। 

তার মানে ১৮টা রাজ্যে ভোট হয়েছে, ১২টা রাজ্যের রাজনৈতিক দল, মানুষ ওই ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্বকে মেনে নেয়নি আর ৬টা রাজ্যের মানুষ মেনে নিয়েছে। অন্তত সংখ্যাতত্ত্বের হিসেব সেই কথাই বলছে। হ্যাঁ, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় বলার আগে ভেবে দেখুন ১৮টা রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নির্বাচনে বিজেপির জয় কতটা? নরেন্দ্র মোদি গেলেই মানুষ দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছে, অবস্থাটা কি তেমন? এক্কেবারেই নয়, বরং উল্টো। আসলে ২০১৯ এর নির্বাচনে পুলওয়ামাই ছিল এক ইস্যু, যা ক্রমশঃ ফিকে হয়েছে আর আজ তো সেই পুলওয়ামার প্রশ্নে কাঠগড়াতে বিজেপিই দাঁড়িয়ে আছে। এই ১৮টা রাজ্যের মধ্যে বড় রাজ্য বলতে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতেই বিজেপির বিরাট জয়, উত্তরাখণ্ড আর অসম কান ঘেঁষে জিতেছে তারা। বিহারে জোট করে যে জোট নেই। রইল কেরল, তামিলনাড়ু, বাংলা, হিমাচলপ্রদেশ, পঞ্জাব, কর্নাটক, যেখানে বিজেপি প্রবলভাবেই হেরেছে। এই সংখ্যাই বলে দেয়, না রামমন্দির, না ৩৭০ ধারা, না ডাবল ইঞ্জিনের সরকার, কোনওটাই আসলে বিজেপির জয়ের কারণ নয়, বিজেপি হারছে দেশের ক্রমশঃ নীচে নামতে থাকা অর্থনীতির জন্য, বেকারত্বের জন্য, মূল্যবৃদ্ধির জন্য, নিম্ন মধ্যবিত্ত আর গরিব মানুষের জীবনের ন্যুনতম চাহিদা না পূরণ করার জন্য। সেই একই কারণেই আগামী চার রাজ্য এবং তারপরের ২০২৪-এর লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি বেশ কয়েক কদম পিছিয়েই আছে, আরও পিছিয়ে পড়বে।  

 

 

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments