কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: সিংহের মুখ নিয়ে বিতর্ক। বিতর্ক সিংহের শরীরের ভঙ্গিমা নিয়েও। সারনাথের ঐতিহাসিক স্তম্ভের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি সরকারের সেন্ট্রাল ভিস্তার তুলনা উঠে এসেছে রাজনৈতিক বিতর্কে। ভারতের জাতীয় প্রতীকে দেখা এশিয় সিংহের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি পূজিত সিংহের মিল এবং অমিল কতটা? তা নিয়ে শুরু হয়েছে চাপানউতোর। প্রশ্ন উঠেছে মৌর্য্য রাজা অশোকের হাতে তৈরি সিংহের রূপ কীভাবে বদলে গেল প্রধানমন্ত্রী মোদি জমানায়? কেনই বা বদলের প্রয়োজন হল?
শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন খবরের শিরোনামে। জনতার রোষ, বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে কলম্বোর রাজপথে। টিভি স্টেশনের দখল নিয়েছে সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভকারীরা শাসকের সাধের সুইমিংপুলে সাঁতার দিয়েছেন। প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়া এসে পড়েছে ভারতেও। এ দেশেও কি কখনও এরকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে?
ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে রাজাপক্ষে পরিবার কীভাবে শ্রীলঙ্কার সিংহাসন দখলে নিয়েছিল। কীভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পিঁপড়ের মত পিষে মেরেছিল অসংখ্য তামিল সাধারণ মানুষকে। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী দেশে কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল? যাই হোক শ্রীলঙ্কার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষেরা ধরে নিয়েছিলেন দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ শেষে দেশে সুশাসন ফিরবে। শেষপর্যন্ত তা হল কি?
সিংহের কথায় ফিরে আসা যাক। সেন্ট্রাল ভিস্তার সিংহের কথায় যেমন তেমনই শ্রীলঙ্কার পতাকার সিংহের কথাতেও। শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকার দিকে চোখ রাখলেও এক সিংহের দেখা মিলবে। যে সিংহ তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে। পতাকার একদিকে রয়েছে গেরুয়া এবং সবুজ রঙের আয়তক্ষেত্র। ২০০৯ সাল রাজাপক্ষ পরিবার শ্রীলঙ্কার ক্ষমতায় আসে। ওই বছরই ডানপন্থী উগ্র-জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধসাধুদের একটি দল আত্মপ্রকাশ করে। দলের নাম সিংহলা রভায়া সংক্ষেপে এসআর। যেমন ভারতীয় জনতা পার্টি সংক্ষেপে বিজেপি। নতুন পার্টির পতাকাটি দেখতে হয় অনেকটা শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকার মতো। সেখানেও এক সিংহের উপস্থিতি। তরবারি হাতে সেই সিংহ অনেক বেশি আগ্রাসী। অনেকটা সেন্ট্রাল ভিস্তার হাঁ-করে দাঁত বের করা সিংহের মতো। এসআর পার্টির পতাকায় স্বস্তিকা চিহ্নের সরব উপস্থিতি। যে চিহ্ন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পতাকাকে মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় দেশভক্তির আগে অন্ন, শিক্ষা, বাসস্থান সব তুচ্ছ।
আরও পড়ুন- PM Modi: মোদির টুইস্ট, অশোকস্তম্ভের সিংহের রূপবদল কার নির্দেশে? নিন্দার ঝড়
২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাদের দেশে অনেকগুলো বড় পরিবর্তন এসেছে। জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া হয়েছে। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগেই সেই মন্দিরের দরজা সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। দেশের কোথায় কোথায় সম্ভাব্য মন্দির ছিল সেগুলোর তালিকা তৈরি করে আইনি লড়াইয়ের নামে ধর্মান্মোদনার নকশা আঁকা শুরু হয়েছে। দিল্লির রাজপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক যুদ্ধজয়ের স্মারক। অমর জ্যোতি জওয়ানের মশাল। আমিষ-নিরামিষের তরজায় প্রাণ গিয়েছে অসংখ্য সংখ্যালঘুর। নতুন সংসদ ভবন সেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরি হচ্ছে। যার খরচ প্রায় সাড়ে তেরো হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। যে সেন্ট্রাল ভিস্তাতেই নতুন সিংহের আবির্ভাব। যে সিংহ অনেক বেশি আগ্রাসী। অনেক বেশি হাঁ-মুখ বের করা দাঁতাল।
আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে যে কোনও দেশের মানুষই রাস্তায় নেমে পড়েন। সাধারণ মানুষের রান্নাঘরে উনুন নিভে গেলে সেই ক্ষোভের আঁচ গিয়ে পড়ে রাজতন্ত্রে। শাসকের মানদণ্ডে। আইনের শাসন ভেঙে পড়ে। শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকট সেই সত্যকেই ফের একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। দেশভক্তির আফিম সেখানে ধোপে টেকেনি। নরেন্দ্র মোদির সরকার হয়ত বা সারনাথ সিংহের শৌর্য্যে বিশ্বাসী না। সে হয়ত বা শ্রীলঙ্কার এসআর পার্টির সিংহের মতোই আগ্রসনে বিশ্বাসী। তাই সে পূজিত হন রাষ্ট্রনায়কের হাতে। বিশেষ একটি ধর্মের আচার মেনে।
টি এস এলিয়টের ‘হলো ম্যান’ কবিতাটি মনে করা যাক।
Between the idea
And the reality
Between the motion
And the act
Falls the shadow
লংকা খেতে চাষ করত কিশোরী জামলো মকদম। লকডাউনের পর বাড়ি ফেরার তাগিদে হাঁটতে শুরু করে। জামলোর হাঁটা শেষ হয়নি। তার আগেই খিদে চেপে মারা গিয়েছে। সিংহের হাঁ-মুখের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে হিংস্র আগ্রাসী দাঁত।