গতকাল সর্বোচ্চ আদালত কিছু কথা বলেছেন যা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং আমরা প্রথমে অবাকই হয়েছিলাম, যে এত ঘটনা ঘটছে তারমধ্যে থেকে কেবল এই আরজি করের ঘটনাকে বেছে নিয়ে আদালত বসানোর পিছনের কারণটা কী? তো মুখ্য বিচারপতি প্রথমেই সেই কনফিউশন দূর করেছেন, তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন যে এই ঘটনাকে সামনে রেখেই তাঁরা আসলে দেশ জুড়েই ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা, তাঁদের কাজের পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত। দেশের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়ভার যাঁদের উপরে, যাঁরা এই ক’দিন আগেই করোনার মতো যুদ্ধ জয় করেছেন আমাদের জন্য, তাঁদের উপরে হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছড়ানো হয়েছে, কিন্তু তাঁদের রাতে শোওয়ার বন্দোবস্ত হয়নি, তাঁদের টয়লেটের বন্দোবস্ত হয়নি। মহিলা ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আলাদা টয়লেট, আলাদা রেস্টরুম নেই, এবং তাঁদের বিস্তারিত আলোচনাতে এসব যে কেবল আরজি করের সমস্যা তাও নয়, তাঁরা গোটা দেশের একটা ছবি সামনে তুলে ধরতে চান, গোটা দেশের প্রেক্ষিতেই কিছু পদক্ষেপ নিতে চান আর তাই একটা ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স টিম গঠন করা হল, যাঁরা সারা দেশের হাসপাতালে, স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তারদের সুরক্ষা নিয়ে এক সমীক্ষা চালিয়ে কী কী করা জরুরি সেটা জানাবেন। এদিকে আমাদের আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারেরা সুরক্ষিত নয় বলেই তাঁদের কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানে সিআরপিএফ মোতায়েন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা অনুরোধ জানিয়েছেন যে কর্মবিরতি তুলে নিন। আর এই রায়ের মধ্যেই তিন বিচারপতির বেঞ্চ থেকে নির্দেশ দেওয়া হল, ২২ তারিখে কলকাতা পুলিশকে জানাতে হবে ১৪ অগাস্ট রাতে আরজি করে ভাঙচুর কেন হয়েছিল? কারা করেছিল? আর সিবিআইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে ওই ২২ তারিখেই তাদেরকে এই হত্যা আর ধর্ষণের তদন্তে কী পাওয়া গেল তা জমা দিতে হবে।
এমনিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা যে টাস্ক ফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন তা যদি সত্যিই কাজ করে তাহলে অনেক এমন তথ্য বেরিয়ে আসবে যা এই মুহূর্তে মোদি সরকারের কাছে খুব স্বস্তির হবে না। ২০২৪-এ দেশের মোট জিডিপির ১.৯ শতাংশ খরচ করা হবে স্বাস্থ্য খাতে, এরমধ্যেই রয়েছে স্বাস্থবিমা, গ্রামীণ হাসপাতাল, বিভিন্ন পরিবার পরিকল্পনার প্রকল্পগুলো এবং রয়েছে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়ে তোলার বাজেট। উন্নত দেশের চেহারাটা একবার দেখুন, অস্ট্রিয়া ৯.৩ শতাংশ চেক ৯.১ শতাংশ, জার্মানি ৮.৫ শতাংশ, আইসল্যান্ড ৮.৬ শতাংশ, আমেরিকা ১৯.৭ শতাংশ, ইউকে ১০.৯ শতাংশ এবং তার সঙ্গেই মাথায় রাখুন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়সখা আম্বানির সম্পদ আমাদের দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ আর দেশের ১৪০ কোটি জনগণের জন্য বরাদ্দ ১.৯ শতাংশ। কাজেই যা যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এইসব ছবিগুলোও সামনে আসুক। কেন ডাক্তারদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা নেই, কেন কেউ মারা গেলে ওই ডাক্তারদেরকেই গিয়ে মৃতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হয়? কেন মহিলা ডাক্তারদের আলাদা রেস্ট নেওয়ার জায়গা নেই, টয়লেট পর্যন্ত নেই অথচ মাথার উপরে যে ফকির প্রধানমন্ত্রী বসে আছে তাঁর প্লেন কেনা হয়েছে ৮৪০০ কোটি টাকা দিয়ে, ওনার কেবল সিকিউরিটির খরচ প্রতিদিন ১.৬২ কোটি টাকা। উনি ৩৬৫ দিন ঘরে বসে থাকলেই ১০০০টা টয়লেট হয়ে যাবে। এসব আসুক সামনে, তারপর না হয় ওই দফা এক দাবি এক নিয়ে পথে নামা যাবে।
আরও পড়ুন: হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, কলকাতা পুলিশ, সিবিআই, বিচার চাই, শাস্তি চাই
কিন্তু সেসব তো পরের কথা, এই তো কমিটির ঘোষণা হল, এরপরে কমিটির জন্য ব্যয়বরাদ্দ ঘোষণা হবে, তারপর কতদিনে তাঁরা সারা ভারতের ডেটা জোগাড় করে তাঁদের রিপোর্ট দেবেন, তারপরে তো বাকি কথা। কিন্তু যে দুটো আপাতত জরুরি কাজ তা হল কলকাতা পুলিশকে জানাতে হবে ওই ১৪ আগস্ট রাতে কারা ভেঙে ছিল ব্যারিকেড, কারা ঢুকেছিল আরজি করে? কারা ভাঙচুর চালিয়েছিল তা তদন্ত করে জানাতে বলেছেন বিচারপতিরা, তা ওই ২২ অগাস্টেই মানে আগামিকাল জানাতে হবে। ওনারা একটা তদন্তের রিপোর্ট দেবেন, বেশ কিছু অ্যারেস্ট হয়েছে, দু’ চারটে বলির পাঁঠাকে পদত্যাগও করতে বলা হয়েছে, সেসব তো কাগজে লিখে খামে পুরে তাঁরা জমা করবেন। সমস্যা সিবিআই-এর, বিরাট সমস্যা, কারণ তাদের এই তদন্তের ভার দিয়েছে কলকাতা উচ্চ আদালত। কেন? কারণ বিকাশ ভট্টাচার্য থেকে কৌস্তুভ বাগচি থেকে শুরু করে বেশ কিছু আইনজীবীরা আদালতে গিয়ে বলেন, হুজুর এরা আসলে তদন্ত করছে না, এরা আসলে তদন্তের নাম করে আসল যে অপরাধী তাকে আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই যে অপদার্থ রাজ্য পুলিশ প্রশাসন এরা আসলে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ধ্বংস করার কাজ করছে, ৪ দিন হয়ে গেছে এখনও আসল অপরাধীর গায়ে হাতই পড়েনি, মৃতার বাবা মা ও অসন্তুষ্ট, কাজেই এই তদন্তের ভার সিবিআইকেই দেওয়া হোক। এ সেই ১২ তারিখের কথা। তো বিচারপতি তদন্তের ভার সিবিআইকে দিলেন। তাহলে সিবিআইকে কী কী প্রমাণ করিতে হইবে?
প্রথম হল এই ঘটনার মূল অভিযুক্তকে খুঁজে বের করা যা ওই বিদগ্ধ জ্ঞানী আইনজ্ঞদের মতে এই সঞ্জয় রায় তো নন, ইনি তো ছোট প্লেয়ার, বড় প্লেয়ারকে খুঁজে বার করতেই হবে। দুই হল কলকাতা পুলিশ যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ ধ্বংস করার কাজে নেমেছিলেন, কাজেই সেই চেষ্টার দু’ একটা নমুনাও তাদের দিতে হবে। এবং এর সঙ্গে নাকি বিরাট র্যাকেট জড়িয়ে, দুর্নীতি জড়িয়ে, সেসব ঢাকার জন্যেই এই ধর্ষণ আর হত্যা, তা তদন্ত করে বের করতে হবে। বের করতে হবে ওই ঘর ভেঙে আসলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রমাণ লোপাটের ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিলেন, বের করতে হবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এই বিরাট দুর্নীতি চক্রের মাথা ইত্যাদি ইত্যাদি। এদিকে ঘটনা ঘটার ৪ দিনের মধ্যে কলকাতা পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করেছিল, নাম সঞ্জয় রায়, তার ফেসবুকে সে আর-ও-ওয়াই লেখে অতএব তাকে খামোখা রাই বলতে যাব কেন? তো সেই সঞ্জয় রায় আবার সিভিক পুলিশ, তার ব্লু টুথ স্পিকার সে ঘটনাস্থলে ফেলে গিয়েছিল, তার দেহে যে সব আঁচড় ইত্যাদির দাগ ছিল তার নমুনা নেওয়া হয়েছে। মেয়েটির ভিসেরা আছে, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া রক্ত, চুল ইত্যাদির নমুনা আছে, সেই ডাক্তারের দেহ থেকে কিছু ফ্লুইড রাখা আছে। এখন এগুলোর ফরেন্সিক টেস্ট, ডিএনএ রিপোর্ট ইত্যাদি আসলে বিষয়টা প্রায় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
কিন্তু সেখানেই সিবিআই-এর সবথেকে বড় অসুবিধে, তদন্তের আগেই যে দাদাবাবুরা অনেক কিছু ঠিক করে দিয়েছেন। মানে ধরুন ফেলুদা এলেন তদন্ত করতে তাঁকে যদি বলেই দেওয়া হয় যে মগনলাল মেঘরাজই আসল ভিলেন, তাহলে তদন্তে কেবল ওই মগনলাল মেঘরাজের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করলেই খেলা খতম, পায়রা উড়ে যাবে। কিন্তু এখানে তো কেস আলাদা, এক অদৃশ্য ভিলেনকে দেখানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে সে বা তারা নাকি আসলি ভিলেন, কিন্তু গত সাত দিন পার করে সিবিআই-এর আটদিনের তদন্তে অবস্থাটা ন যযৌ, ন তস্থৌ, যেখানে ছিল এক্কেবারে সেখানেই আছে। উল্টে চারিদিক থেকে এতবার বলা হয়েছে যে এই সঞ্জয় রায় আসলে কিসসু করেনি, একে ফাঁসানো হয়েছে, শুনলাম এখন সে নিজেও নাকি এই কথা বলা শুরু করেছে। হতেই পারে যে তার উকিল তাকে এই কথা বোঝানো শুরু হয়েছে, কারণ তার উকিল তো কাঠগড়ায় রাজ্যের এক বিধায়ককে দাঁড় করাবে, যিনি আগেই বলেছেন যে এই সঞ্জয় রায় আহা গো, সে এক বলির পাঁঠা, শাস্তি তো হওয়া উচিত পালের গোদার, যে এই পাপকে লোকাতে চাইছে। সে অবশ্য পরের কথা, এখন আগামিকাল মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে গিয়ে এই সিবিআই কী বলিবেন? মুখ তো পুড়বেই, কিন্তু তারপরেও কী বলবে এই সিবিআই? কারণ ৪ দিনের তদন্তের মাথায় যা তথ্যপ্রমাণ কলকাতা পুলিশ দিয়েছিল, এক্কেবারে সেটাই এখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে। মিনিট টু মিনিট ওই সঞ্জয় রায়ের ম্যাপিং হয়েছে, এই হত্যার আগের তিন-চারদিন সে কোথায় গেছে, কী করেছে, কার সঙ্গে কথা বলেছে, কোন ব্রথেলে গেছে, কার সঙ্গে ঝগড়া করেছে, কোথায় শুয়েছে, সব ম্যাপিং করার পরে সিবিআই যা জেনেছে আর ৪ দিনের মাথায় কলকাতা পুলিশ যা জেনেছিল তার মধ্যে তো ফারাক নেই। কাজেই হয় এবার সিবিআইকে কিছু বানাতে হবে, মানে ওই সঞ্জয়কে দিয়ে বলাতে হবে সে ওই ঘরে যাওয়ার আগেই ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, এরকম একটা কিছু সিবিআই-এর তরফে তাদের পেয়ারের ঘণ্টা বাজনদারদের খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাতেও বিপদ রয়েছে, কারণ সাক্ষ্যপ্রমাণ সবই তো বদলাতে হয়, আর অতটা সম্ভব নয়, এবং ওই যে প্রমাণ লোপ, তা নিয়েও কোনও তথ্য নেই সিবিআই-এর কাছে। কাজেই তাদের ২২ তারিখে গিয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বলতে হবে, হুজুর এই তো এই যে আমাদের তদন্তের হাল, সেই কুমিরছানাটাকে বের করে দেখাতে হবে। সেই মুহূর্তে এ বঙ্গের সেই পক্কমাথার রাম-বাম আইনজ্ঞরা তাকিয়ে থাকবেন। প্রধান বিচারপতির জিভের ধার একটু বেশিই, তিনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন, তাহলে এই আটটি দিনে আপনারা কোন কম্মটি করিলেন? হ্যাঁ, ফাপরে পড়েছে সিবিআই, ফাটা বাঁশে আটকেছে, না না, যেটা ভাবছেন সেটা নয়, ল্যাজ, মোটা ল্যাজখানা আটকেছে।