যে কোনও স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কাটাছেঁড়া করলে কতগুলো কমন এজেন্ডা পাওয়া যাবে, একই ধরনের ব্যবহার, একই ধরনের ফতোয়া, একই ধরনের কাজকর্ম। তাদের মতাদর্শ এক্কেবারে বিপরীত হতেই পারে, তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। ধরুন হিটলারের জমানা, আপনি আজও সেই জমানার ইতিহাসে কোনও কিছুরই সম্পূর্ণ তথ্য পাবেন না, নেই। জনসংখ্যা থেকে শিল্প, ইহুদি সংখ্যা থেকে কৃষির কোনও পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ নয়। এয়ারফোর্সে কতগুলো এমন বোমারু বিমান আছে যা উড়তে সক্ষম? যুদ্ধের এক্কেবারে শেষ পর্যায়ে এসে হিটলারের প্রশ্ন, এবং উত্তর নেই বা যা বলা হচ্ছে তার ১০ শতাংশও কার্যকরী ছিল না। উল্টোদিকে তথাকথিত কমিউনিস্ট রেজিম, সে স্তালিন হোক আর পোল পট হোক, আপনি কোনও সঠিক তথ্য পাবেন না। কত লোককে স্তালিনের সরকার শ্রমশিবিরে পাঠিয়েছিল? রাশিয়ার মহাফেজখানায় এ নিয়ে এত স্ববিরোধী তথ্য আছে যে আসল সংখ্যা জানাই যাবে না কোনও দিন। কৃষি উৎপাদন নিয়ে ভূরি ভূরি মিথ্যে কথা। পোল পট তো বাদই দিলাম, কোনও তথ্যই নেই। একইভাবে আপনি সাদ্দাম বা গদ্দাফির সময়েও ওই তথ্যের অভাব দেখবেন। অন্যদিকে খারাপ হোক ভালো হোক ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া জুড়ে যে আপাত গণতান্ত্রিক কাঠামো আছে তার প্রায় সব তথ্য আপনি বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে বসে পেতে পারেন। ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টস নেই? আছে। কিন্তু সাধারণ তথ্য সবটাই পাবলিক ডোমেনে রাখা আছে। আমাদের দেশে ৮০ সাল থেকে এই তথ্যের ভাণ্ডার প্রায় খুলে দেওয়া হয়, তার আগেও নিয়ম করে জনগণনা হয়েছে, তার রিপোর্ট পাবলিক ডোমেনেই রাখা আছে, বিভিন্ন ডেটা ব্যাঙ্ক, ধরুন বেকারত্ব নিয়ে, কৃষি উৎপাদন বা শিল্প উৎপাদন নিয়ে পাওয়া যেত অনায়াসেই। এর পরে রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট আসায় তা আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে। আসলে গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই তো এই স্বচ্ছতা, সবাই যদি নাই জানল হচ্ছেটা কী, হয়েছেটা কী তাহলে আর গণতন্ত্র কোন কামে লাগবে?
কিন্তু এক উল্টোরথ চালু হয়ে গেল ১৫-১৬-১৭ সাল থেকে, এখন সেটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি বেকারত্ব নিয়ে কিছু বলতে চান? আপনার কাছে শেষ ডেটা ২০১৬-১৭ সালের। আপনার জনগণনার তথ্য ২০১১ সালের। মানে সরকার জানেই না যে দেশের মানুষের সংখ্যা কত, এদিকে বিকাশ আর উন্নয়নের ঢাক বাজিয়েই যাওয়া হচ্ছে ক্রমাগত। ১০ বছর পর পর জনগণনা হয়েছে নিয়ম করে। ২০১১ থেকে আর হয় না, এ যেন খানিকটা সেই রকমের, বাবা মা জানেনই না ক’জন সন্তান, কতজনের খাবার লাগবে অথচ একগাল হেসে বলছেন, আমার বাচ্চারা পেট পুরে খেয়েছে। এবারে যে প্রশ্নটা আপনি করতেই পারেন সেটা হল এই জনগণনা না করলে লাভ কার? কেন করাচ্ছে না এই সরকার? তার প্রধান কারণ হল দেশজুড়ে তাদের মিথ্যে প্রচারের বেলুনগুলো ফেটে যাবে, মানুষ প্রতিদিন প্রশ্ন করবেন, মিথ্যে বলছেন কেন? মাঝেমধ্যেই রব ওঠে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে, ওই জেলাতে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, সারা দেশেই নাকি হু হু করে বাড়ছে, এবং এইসব প্রচার শুনে সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত, তাঁদেরও অনেকের ধারণা আর ক’দিনের মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে চলে যাবে। হিন্দু খতরে মে হ্যায়। ভাবুন একবার পুরোদস্তুর নবাবি শাসন দেখেছে এই বাংলা, তখন হিন্দু খতরে মে ছিল না। ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত মুঘল সম্রাটের শাসন দেখেছে গোটা দেশ, ৩০০ বছরে হিন্দু বেঁচে ছিল, তাদের মন্দির ছিল, পুজো পাঠ ছিল, রামচরিত মানসের মতো ধর্মগ্রন্থ লেখা হয়েছে, তখন হিন্দু খতরে মে ছিল না, ইন ফ্যাক্ট আমরা তো বছর সাত আট আগে এই হিন্দু খতরে মে হ্যায় তো শুনিনি। এইসব তথ্য ছড়ানো সহজ হয়ে যায় যদি আসল তথ্যটাই সামনে না আসে। কোত্থেকে জানলেন যে মুর্শিদাবাদের মুসলমান জনসংখ্যা বাড়ছে? কেন? হোয়াটসঅ্যাপে এসেছে, প্লেন অ্যান্ড সিম্পল অ্যানসার। এই একই প্রচার কর্নাটকে, ওল্ড মাইসুরু রিজিয়ন নাকি চলে গেছে মুসলমানদের হাতে, অথচ নির্বাচনে ওই অঞ্চলে জিতেছে বিজেপি জোট। একই প্রচার মহারাষ্ট্রে, মুসলমান বাড়ছে, বহিরাগত বাড়ছে। যদি বাড়েও তা জানব কী করে? যদি কমেও তাহলেই বা জানব কী করে? মোদি–শাহ সরকার জনগণনা করাচ্ছেই না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | প্রতিটা রাজ্যেই বিজেপিতে ধুন্ধুমার
২০২৫-এ জনগণনা হবে? কোনও চান্সই নেই, এবারের বাজেট বরাদ্দ দেখুন, মানে জনগণনা এক বিরাট ব্যাপার, প্রচুর টাকা লাগে, বাজেটে এবারে ১৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, ২১-২২-এ এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৭৬৮ কোটি টাকা। ২০০১-এর ৮৪তম সংবিধান সংশোধনী বিলে বলা হয়েছে যে জনগণনা না হলে ডিলিমিটেশন সম্ভবই নয়, আবার নারী আসন সংরক্ষণ বিলে সাফ বলা আছে ডিলিমিটেশন হবে, তারপরে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ হবে। ওদিকে বিহারে আপাতত এনডিএ-র শরিক নীতীশ কুমার জাতিগত জনগণনা করিয়েছেন, কাজেই এবারে জনগণনার আগে এটাও একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত যা এই মোদি-শাহ সরকারকে নিতেই হবে যে তাহলে কি পরবর্তী জনগণনার সঙ্গে জাতিগত জনগণনাও হবে? বিজেপির কাছে সেটা এক বিশাল সমস্যা। কারণ জাতিগত জনগণনা তো বিরোধীরা চাইছেন, ওনার জোটের শরিকরা চাইছেন। কিন্তু ওই জাতিগত জনগণনা করালেই এমন এক ছবি বেরিয়ে আসবে যা সরকারের কাছে আত্মহত্যার শামিল হবে। কারণ এই জাতিগত সমীক্ষা বলে দেবেই যে দেশের পিছড়ে বর্গদের সংখ্যা ৬৮-৬৯ শতাংশ, কাজেই যার সংখ্যা যত তার চাকরি তত, যিসকি জিতনি, উসকি উতনি, এই স্লোগান উঠবে। আর তা মানতে গেলেই বিজেপির যে রক সলিড ১৫-১৬ শতাংশ রাজপুত ব্রাহ্মণ সমর্থন আছে, তা চুরমার হয়ে যাবে। তারচেয়ে বিজেপি জনগণনার মতো এক আবশ্যিক বিষয় নিয়ে চুপ করে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিজেপি আপাতত বালির মধ্যে মাথা গুঁজে বাইরের ঝড়কে না দেখার চেষ্টা চালাচ্ছে। পারবে না। আর একবার জনগণনা সামনে এসে গেলে মুসলমান জনসংখ্যা নিয়ে ওদের অপপ্রচার বন্ধ হয়ে যাবে।
আচ্ছা কেবল কি জনসংখ্যা? না, কৃষি উৎপাদন থেকে এমপ্লয়মেন্ট, মানে চাকরি আর বেকারত্বের হিসেব, সবটাই এখন ধোঁয়াশায় ঢাকা, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক এমপ্লয়মেন্ট-এর হিসেব দিচ্ছে, যা মিথ্যে বললে কম বলা হয়। বলা হল আমাদের ৫৬.৫ কোটি ওয়ার্কফোর্স আছে, মানে যাঁরা কাজ করছেন বা করতে পারেন, এবং তাতে নাকি মাত্র ৩.২ শতাংশ বেকার, মানে ১৮-২০ লক্ষ বেকার আছেন। ভাবা যায়? দেশের ৮৫ কোটি মানুষকে যে সরকার ফ্রিতে র্যাশন দিচ্ছে, তাদের মাত্র ১৮-২০ লক্ষ বেকার, বাকিরা সব্বাই কাজ করছেন। হিসেব? ৪৫ শতাংশ কৃষিতে, ১১.৪ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে, ২৮.৯ শতাংশ সার্ভিস সেক্টরে, মানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ট্যুরিজম, হোটেল ইত্যাদিতে, ১৩ শতাংশ নির্মাণ, কনস্ট্রাকশনে। বাকি ওই ৩.২ শতাংশ বেকার, মানে দেশের বেকার সংখ্যা ওই ১৮-২০ লক্ষ, সরকারি হিসেব, তাই বলছে। এরা উন্মাদ নয়, এরা শয়তান। অন্য হিসেব বলছে বেকারত্ব গত ৪৫ বছরের মধ্যে রেকর্ড ছুঁয়েছে। ওঁরা প্রথমেই বলে দিলেন বেকার? কই? কোথায়? কীভাবে বলতে পারছেন? কারণ যাবতীয় ডেটা সোর্স বন্ধ। মোদি–শাহের জমানাতে এটাই এক নতুনত্ব, প্রথমে ডেটা সোর্সগুলোকে বন্ধ করো, সঠিক তথ্য জোগাড়ের সংস্থাগুলোকে বন্ধ করো, তারপরে মিথ্যে সেট অফ লাইজ, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে ছড়াতে থাকো। সারা দেশের এক করুণ চেহারা আমাদের সামনে, সেখানে দাঁড়িয়ে সরকারি তথ্যে জানানো হচ্ছে বেকার আছে মাত্র ১৮-২০ লক্ষ? এরপর নজর দিন কৃষি উৎপাদনে, সেখানে বিরাট ঘাপলা চলছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা কবে চোখ দেবেন জানা নেই। দেশের মধ্যে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা কত? খাদ্যশস্যের চাহিদা কত? কতটা সরকারি গুদামে জমা হচ্ছে, তার দাম কত? কত বিদেশে যাচ্ছে, তার দাম কত? কোনওটারই হিসেব এক জায়গাতে নেই, আর এই তথ্য লোপাটের আড়ালে কিছু ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা মুনাফা কামাচ্ছেন, গুদামে পচা আনাজ জমা হচ্ছে, তা খালাসের নাম করে ভালো আনাজ চলে যাচ্ছে বাজারে। হিসেব নেই। আসলে যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা গোপন রাখা হয়, সে দেশে বাকি তথ্য গোপন রাখা হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু চাকা তো ঘুরেছে, তা মাথায় রেখেই বিরোধীরা দুটো তথ্যভাণ্ডার নিয়ে সরব হতে পারে যা দেশজুড়ে মানুষের সমর্থন পাবে। এক হল সম্পূর্ণ সেনসাস, যেখানে জাতিগণনাও করতে হবে। দুই হল দেশে চাকরি আর বেকারত্বের এক সম্পূর্ণ ডেটাবেস এখনই তৈরি করতে হবে। আগামী দিনে এই দুই দাবি বিজেপিকে বেকায়দায় ফেলবে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।