ক’দিন ধরে বাজার গরম ছিল কী নিয়ে? খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ববি হাকিমের গোলমেলে বক্তব্য, চোপড়ার জেসিবির ক্যাঙারু কোর্টে মহিলা পেটানো, জয়ন্ত সিং ওরফে জায়ান্ট সিংয়ের প্রাসাদ, জামাল ইত্যাদি ইত্যাদি। একের পর এক ঢেউয়ের মতো, তার মধ্যে জুড়েছিল ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাই। সবে সবে বিজেপির বিরাট হার এবং তৃণমূলের বেশ ভালো জয়ের পরে সুরটা কাটছিল বার বার। মানুষের কাছে এই সব খবর কেবল যাচ্ছিলই না, রাস্তায় মাঠেঘাটে তা নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছিল। পণ্ডিতেরা সেই রেশ ধরে ২০২৬-এর অ্যান্টি ইনকমব্যান্সির হিসেব কষছিলেন। যদিও রাজনীতি বিজ্ঞান বলে যে, অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোটকেও একটা জায়গাতে এনে জড়ো করার জন্য একটা শক্তিশালী বিরোধী দলের বা জোটের দরকার হয়। কাজেই আছে সরকার বিরোধী হাওয়া, কিন্তু তা কি কাজে লাগবে, না খানিক এলোমেলো হাওয়া হয়ে তা হারিয়ে যাবে কোন সুদূরে। কিন্তু যাই হোক খবরের কাগজের প্রথম পাতা সরকার আর তৃণমূল দলের কাছে স্বস্তিদায়ক ছিল না। কিন্তু আজ? সেসব জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলা ভাগ, জেলা ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, রাজ্য বিজেপি নেতারা এক বলছেন, পরক্ষণে তা গিলছেন আর সেসবের মধ্যে চাঙ্গা তৃণমূল। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, বাংলা বিভাজনের কথাবার্তা কি তৃণমূলকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাল?
সংসদীয় রাজনীতির এ এক মজা। অনেক সময়েই রাজ্যের দেশের সরকার, ক্ষমতাসীন দল থালায় করে লোপ্পা ক্যাচ তুলে দেয় বিরোধীদের জন্য, আবার কখনও বেশ প্যাঁচে পড়ে থাকা শাসকদলকে না জেনে না বুঝেই বেশ খানিকটা অক্সিজেন জুগিয়ে দেয় বিরোধী পক্ষ। প্রথমটার উদাহরণ হল সপ্তম বাম সরকার এবং সিপিএম। ২৩৫ জন বিধায়কের সমর্থন, দল তখনও রাজ্যে শেষ কথা। হঠাৎ মরিবার হল তার সাধ, একগাছা দড়ি হাতে অশ্বত্থের ডালে ঝুলে পড়ল সেই সরকার।
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু কি ক্রমশ একলা হয়ে পড়ছেন?
দল ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিল আর এখানে কৃষকদের চার ফসলা জমিতে টাটার ন্যানো ফ্যাক্টরি করার সিদ্ধান্ত নিল। ইউপিএ-তে খানিক চাপ তৈরি করে পিছনে সরে এলে এ রাজ্যে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হত না, বাম সরকার পড়ত না, আর সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামের হঠকারিতা না করলেই সরকার থেকে যেত। ২০১১-তে মানুষ মমতার পক্ষে ভোট দেননি, দিয়েছিলেন বাম সরকার, সিপিএম-এর বিরুদ্ধে। ঠিক সেইভাবেই মধ্যপ্রদেশে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যখন প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া, তখন কমলনাথের নেতৃত্বে রাজ্য কংগ্রেস হিন্দু হয়ে ওঠার চেষ্টায় নেমে পড়ল। আমও গেল, ছালাও গেল। সেই একই ঘটনা এখানেও। সবেমাত্র রাজ্যস রকারের বিরুদ্ধে এক প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া উঠতে শুরু করেছে, অনন্ত মহারাজ বললেন কোচবিহারকে বাংলা থেকে আলাদা করতে হবে, সুকান্ত বললেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে উত্তরবঙ্গকে, গৌরীশঙ্কর ঘোষ মুর্শিদাবাদকে বাংলার ম্যাপ থেকে বার করতে বলছেন, বহরমপুরের বিজেপি বিধায়ক, মুর্শিদাবাদ মালদাকে বার করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করতে বলছেন। এদিকে শুভেন্দু বলছেন এগুলো কোনওটাই নাকি দলের স্ট্যান্ড নয়। এবং লুফে নিয়েছে তৃণমূল, লুফে নিয়েছেন মমতা, বাংলা ভাগ করতে এলে দেখিয়ে দেব, চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, এত সস্তা? আসুন না, ভাগ করতে। এবং রাজ্যের তৃণমূল কর্মীরা উজ্জীবিত, আয় শুভেন্দু, হয়ে যাক একহাত বলে তাঁরাও মাঠে নেমে পড়েছেন, এবং এটা চলবে। দৃশ্যতই বঙ্গ বিজেপি ব্যাকফুটে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে বিজেপি দলের বিভিন্ন নেতাদের বাংলাকে ভাগ করার যে প্রস্তাব তা কি আসলে তৃণমূলের খানিকটা সুবিধে করে দিল না? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
এক সবল বিরোধী পক্ষ গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত, কিন্তু হেরে গেলেই নিজের জেলা ভাগ করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কথা যাঁরা ভাবেন তাঁরা সবল নন, উল্টে রাজ্যের মানুষদের কাছে তাঁরা বিশ্বাসযোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেন। বিজেপি সেই ভুল খেলা খেলতে নেমেছে আর স্বাভাবিকভাবেই তার সবটা সুবিধে তৃণমূল দল পাবে, তাদের এখন থেকে ২০২৬ পর্যন্ত কাজ হবে বিজেপিকে বাংলা বিরোধী, বাংলাকে টুকরো টুকরো করতে চায় এরকম এক দল হিসেবে মানুষের কাছে তুলে ধরা, বাকিটা? বাকিটা মানুষ করে নেবে। এক বড়সড় প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়াকে ব্যবহার না করে বিজেপি তৃণমূলের পালে হাওয়াটা ঠেলে দিল।