আশির দশক থেকেই কেন্দ্রীয় বাজেটের রমরমা বাজার। মানে বাজেট হচ্ছে, তাই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বাজেট বক্তৃতার লাইন মাঠেঘাটে বাজারে ঘুরছে। এসব আশির দশকেই শুরু। একটা তো বড় কারণ হল এনডিটিভি-র প্রণর রায় আর তাঁর টিম। রীতিমতো বাজেট বোঝানো হত। রাজনৈতিক নেতারাও মন দিয়ে শুনতেন সেই আলোচনা আর বিশ্লেষণ। আর তারপর থেকেই রেল বাজেট আর জেনারেল বাজেট ঘিরে এক উৎসাহ তৈরি হল। তার আগে বাজেটের যে অংশ নিয়ে মানুষের উৎসাহ ছিল, এখনও আছে তা হল, ট্যাক্স ছাড় আর নতুন কর বা পুরনো কর বৃদ্ধি। প্রতিটা বাজেটে সিগারেটের উপর কর বাড়ানো হত, এটাই ছিল নিয়ম, যা এক উচ্চতায় পৌঁছনোর পরে খেয়াল করুন বন্ধ হয়ে গেছে। আয়করে ছাড় বা নতুন ঘোষণা ছিল এবং এখনও সেটাই বাজেটের মুখ্য আকর্ষণ। মোদ্দা কথা হল বাজেটের কদর বেড়েছিল, কিছু এলিটদের মধ্যে আটকে থাকা বাজেট হয়ে উঠেছে এমনকী মধ্যবিত্ত মানুষজনের চর্চার বিষয়। এবং সেই বাজেট আবার যদি নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সরকার হয়ে উঠবে কল্পতরু। ঘাটতি? হোক না ঘাটতি, যদি জিতে আসি তাহলে সামলে নেব, যদি নাই জিতি তাহলে সামলাবে বিরোধী দল, এটাই ছিল মনোভাব। কাজেই নির্বাচনের আগে বাজেটের দিকে একটু বেশিই নজর থাকে। এবারেও ছিল। কিচ্ছু নেই, ট্যাক্স ছাড় নেই, আয়করের নতুন কোনও স্ল্যাব বা কোনও সেভিংস স্কিম জুড়ে কিছু ছাড়, কিচ্ছু নেই। নেই সেরকম কোনও মনমোহিনী পরিকল্পনার ঘোষণা।
থুড়ি একটা আছে, সোলার বিদ্যুৎ পরিকল্পনা, যেখানে ৩০০ ইউনিট করে বিদ্যুৎ ফ্রি পাবেন দেশের এক বিরাট অংশের মানুষ। কিন্তু এটাও বাসি, এমনিতেই আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখন একটাই নাম, নরেন্দ্র মোদি, এয়ারপোর্ট উদ্বোধন নরেন্দ্র মোদি, জাহাজ বন্দর উদ্বোধন নরেন্দ্র মোদি, সড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন নরেন্দ্র মোদি, ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে সবুজ ঝান্ডা দেখিয়ে নতুন ট্রেনের উদ্বোধনে নরেন্দ্র মোদি, বিদেশ মন্ত্রক থেকে কৃষি মন্ত্রক বা যে কোনও মন্ত্রকের গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা নরেন্দ্র মোদির। ঝট করে জিজ্ঞেস করলে বহু দফতরের মন্ত্রীর নাম কেউ বলতেই পারবে না। তো এই সোলার বিদ্যুতের পরিকল্পনার কথা ২২ তারিখে রামমন্দির উদ্বোধনের পরে সেদিনের ভাষণেই মোদিজি বড় করে ব্যাখ্যা করে জানিয়ে দিয়েছেন, কাজেই সেটাও নতুন নয়। একটা নতুন কোনও ঘোষণা নেই এই বাজেটে, যে বাজেট বক্তৃতার দু’ মাসের মধ্যে দেশে নেমে আসবে নির্বাচন। একটু খেয়াল করে দেখুন ২০১৯-এর বাজেটের ঘোষণাগুলো। যা নিয়ে আজও মোদিজি বাওয়াল করেই যাচ্ছেন, সেই পিএম কিসান যোজনা ২০১৯ -এ ভোটের আগে ঘোষণা করা হয়েছি। কেবল তাই নাকি, সেই বাজেটে সেই সময়কার অর্থমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল আয়করের ছাড়ের কথাও বলেছিলেন, মনরেগার বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল। মানে ২০১৯-এ ভোটের আগে বাজেট পেশ করার সময়ে বিজেপি নির্বাচনে জেতার জন্য সেই বাজেটের কিছু ঘোষণা দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছিল। জনমোহিনী বাজেট পেশ করেছিল, ঘাটতি বাজেট ছিল তো বটেই, বড়সড় ঘাটতি ছিল, এবার কিন্তু ফিস্কাল ডেফিসিটও বাড়েনি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কংগ্রেসের ন্যায় যাত্রা, বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া
তার মানে খুব পরিষ্কার যে এবারে এই বাজেট করার আগে বিজেপি তার নির্বাচনী ভবিষ্যৎ নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয়, বিজেপি ধরেই নিয়েছে বিজেপি জিতবে। আগে নির্বাচনের বছরে বাজেট অন অ্যাকাউন্ট পাশ করানো হত, নতুন সরকার এসে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পাস করাত, পরবর্তী সময়ে ইন্টারিম বাজেট পেশ করা হয়। তো গতকালের ইন্টারিম বাজেটে আগেই যেরকম বললাম নতুনত্ব কিছুই নেই, বাজেট জনমোহিনী নয়। কিন্তু তা বলে এমনও নয় যে এই বাজেট বক্তৃতার আগে বিজেপি সরকার, মোদিজি বা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ভুলেই গিয়েছিলেন যে সামনেই নির্বাচন আছে। প্রতিটা ছত্রে নতুন ভারতের কথা আছে, ২০৪৭-এর মধ্যে এক বিকশিত ভারত গড়ে উঠবে এমন কথাও আছে। এই বাজেটে সোশ্যাল জাস্টিস আর সেকুলারিজমের কথাও আছে, কিন্তু তার ব্যাখ্যা একেবারে আলাদা। নির্মলা সীতারামন তাঁর বক্তৃতাতে বলছেন, আমরা সামাজিক ন্যায় মানে একটা বা দুটো বা নির্দিষ্ট জাতির কথা বলি না, আমরা বলছি সমাজের দেশের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য ন্যায়ের কথা। আর যখন প্রত্যেকটা দেশের মানুষের কথাই বলছি তখন তার মধ্যেই আছেন দেশের মুসলমান জণগন, কাজেই আমাদের বাজেট বা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক ন্যায় এবং ধর্মনিরপেক্ষতার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। জেএনইউর প্রাক্তন ছাত্রী নির্মলা সীতারামন সোশ্যাল জাস্টিস এবং সেকুলারিজমের এই নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে এক নতুন আবহ তৈরি করতে চাইলেন এবং অবশ্যই তা আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে। সোশ্যাল জাস্টিসের ভিত্তিতে কাস্ট সেন্সাস কেবল করাই নয়, তার রিপোর্টও বার করে দিয়েছেন নীতীশ কুমার, তিনি এখন এনডিএতে। অন্যদিকে একমাত্র কর্নাটকেই কাস্ট সেন্সাস হয়েছে সেই কবেই, নির্বাচনে জেতার আগেই কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার রিপোর্ট বার করবে, এখনও বের হয়নি।
মোদিজি কেরালাতে গিয়ে কংগ্রেসের খ্রিস্টান ভোটে ভাগ বসানোর জন্যই একগুচ্ছ খ্রিস্টান নেতাদের নিয়ে সামনের সারিতে বসিয়েছেন। অন্যদিকে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পশমিন্দা মুসলমানদের বিভিন্ন আর্থিক সাহায্যের কথা বলে নিজেদের দিকে আনার চেষ্টা করছেন। সেই সেকুলারিজমের কথা শোনা গেল বাজেট বক্তৃতায়। শোনা গেল আশা, বিকশিত ভারত, কনফিডেন্স, আমাদের গর্বের ভারত, বিশ্ব জুড়ে ভারতের এই এগিয়ে যাওয়া এই অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সেলিব্রেট করা হচ্ছে ইত্যাদি কথাবার্তা জুড়ে ছিল আমাদের এবারের ইন্টারিম বাজেটে। মানে কাজের কথা নয়, ছিল রাজনৈতিক কথাবার্তা, মনমোহিনী বাজেট নয়, ছাড়ের বাজেট নয় কিন্তু বিশাল এক স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা হল। এই ইন্টারিম বাজেট ছিল এক জাদুকরের চমক, চমকে যাবেন কিন্তু আসলে কিচ্ছুই নেই। ধরুন এই বাজেটে বেকারত্ব নিয়ে একটা কথাও নেই, সযত্নে তা এড়িয়ে গেছেন নির্মলাজি। গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্ব ছুঁয়েছে ৮.৭ শতাংশ, তথ্য কার? সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি। তাদেরই তথ্য হল মানুষ ৪৫.৪ শতাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কম কিনছে। মানে আগের বছরে ১০০ টাকার জিনিস কিনলে এবারে সে কিনেছে ৫৫ টাকার জিনিস। মানে চাহিদা কমছে। এসব কথা বাজেটে নেই।
গ্রাজুয়েশন করেছে এমন জনসংখ্যার ৩৯.৮ শতাংশ বেকার, পোস্ট গ্রাজুয়েটদের ৩৬.২ শতাংশ বেকার। না, নির্মলাজি এসব কথা বলেননি। আয় এবং বৈষম্যের কথা বলেননি, বলেননি যে ক’দিন আগে রয়টারের সমীক্ষা জানাচ্ছে ৮৫ শতাংশ মানুষের রোজগার হয় বাড়েইনি, নয় কমেছে। বলেননি যে অতি দরিদ্র, সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ মানুষজনের ২০১৫–২০১৬র তুলনায় রোজগার কমেছে ৫২ শতাংশ। বলেননি যে সবচেয়ে বড়লোক, উপরে থাকা সেই ২০ শতাংশ মানুষের রোজগার বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এত বিরাট উন্নয়ন অথচ কেন ৮০ কোটি মানুষকে এখনও ফ্রি রেশন দিয়েই যেতে হয় তার কারণ নির্মলাজি তাঁর বাজেট বক্তৃতাতে বলেননি। বিশ্ব আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে স্বাগত জানাচ্ছে, আমাদের এই উন্নয়ন আর বিকাশে তারা দারুণ খুশি, দে আর সেলিব্রেটিং আওয়ার গ্রোথ? তাহলে ইউপিএ আমলে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ছিল জিডিপির ৩.৬ শতাংশ, এখন কেন সেটা কমে ১ শতাংশ? আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে তারা যদি এতই খুশি তাহলে তাদের বিনিয়োগ অন্য দেশে যাচ্ছে কেন? এখানে কমে যাচ্ছে কেন? ভিয়েতনামে এই সময়ের মধ্যেই এফডিআই ৪.৫ শতাংশ হয়েছে। নির্মলা সীতারামন এসব চেপে গেছেন, বলেননি যে গত আর্থিক বছরের প্রথম ভাগে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের দেশে মাত্র ১০.১ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই এসেছে যা নাকি ২০১৭ পরে সবথেকে কম।
বিশাল করে জনধন পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, বলাই হল না যে ২০ শতাংশ জনধন অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ৫০ শতাংশে কোনও টাকাই নেই, একটা করে পাশবই পেয়েছেন, কী হবে? কোন মুড়ি ভাজা যাবে তা দিয়ে? স্বচ্ছ ভারত? ৬০ শতাংশ টয়লেটে জলই নেই? স্বচ্ছতা কীসের? ২০১৯-এ ভোটের আগে বিরাট ঢাক বাজিয়ে পিএম কিসান চালু করা হয়, ১১.৮ কোটি কৃষক সেই প্রকল্পের আওতায় ছিল। আজ? মাত্র ৩.৭৮ কোটি কৃষক সেই সুবিধে পাচ্ছেন? কেন? বাকিরা বড়লোক হয়ে গেছে? নাকি উবে গেছে? জানাননি আমাদের অর্থমন্ত্রী। উজ্জ্বলা যোজনার ৯.৬ শতাংশ মানে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ প্রথম ফ্রি গ্যাস সিলিন্ডার শেষ হওয়ার পরে একবারও গ্যাস সিলিন্ডার কেনেননি, কিনতে পারেননি। ১১.৩ শতাংশ মাত্র একবার কিনেছেন, তারপর থেকে বন্ধ। কাজেই জ্বলছে কাঠ ঘুঁটে। মুদ্রা যোজনা, বিরাট প্রকল্প, ব্যবসা করতে চাইলে সরকার ঋণ দেবে, ৮৩ শতাংশ ঋণ ৫০ হাজার টাকার। সব্বাই জানে এগুলো অনাদায়ী ঋণ হয়ে পড়ে থাকবে, ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা সম্ভব নয়। এদিকে এই ঋণ নিলেই সরকারিভাবে সে আর বেকার নয়, মানে আসল বেকারত্ব কত বেশি সেটা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হবে যার হদিশ এই বাজেটে নেই। আমাদের দেশের ঋণ বাড়ছে, বিরাটভাবে বাড়তে থাকা এই ঋণ, চরম বেকারত্ব আর জ্বালানির দাম বৃদ্ধি অর্থনীতিকে কোন তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে তার হদিশ দিলেন না আমাদের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। আসলে এই বাজেট ছিল সত্যিকে চেপে রাখার বাজেট, যাবতীয় উদ্বেগজনক তথ্যগুলো চেপে দিয়ে বড় বড় বুকনির বাজেট। আমরা এই মুহূর্তে হাঙ্গার ইনডেক্স, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টা দেশের মধ্যে ১১১। দেশজোড়া মানুষের পেটে খিদে, আর আমাদের সরকার আমাদের দেখাচ্ছেন সবকা সাথ সবকা বিকাশের স্বপ্ন।