না, বিজেপি বোকা নয়, বিজেপি এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই রাজনীতিটা করছে। ২০১৪-র আগের বিজেপি আর ২০১৪-র পরের বিজেপি এক নয়। তাদের কাজের ধরনধারণ এক নয়, সাংগঠনিক কাঠামো এক নয়, তাদের বিভিন্ন দলের সঙ্গে সম্পর্ক এক নয়। তারা খুব দ্রুত নিজেদের বদলেছে আর সেই বিরাট পরিবর্তন তাদেরকে আপাতত অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। মনে হচ্ছে এক অপরাজেয় অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে, যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই তাদের জয়পতাকা দেখতে পাচ্ছি। প্রতিটা স্ক্রু, প্রতিটা পার্ট মসৃণভাবেই কাজ করছে, প্রত্যেকের নিজের নিজের দায়িত্ব আছে, সেই দায়িত্বের বাইরে কেউ যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হল যার যে রোল, সে কেবল সেই স্ক্রিপ্টটুকুই জানে, সে জানে তাকে কী করতে হবে, কী বলতে হবে। সে জানেই না পুরো গল্প, সে জানে না কোন চরিত্রে কে কী রোলে আছে। কাকে কখন টেনে নেওয়া হবে, কাকে কখন এনে হাজির করা হবে এই বিরাট নাটকের কুশীলবরা জানে না। জানেন নিশ্চয়ই নরেন্দ্র মোদি, সম্ভবত পুরো গল্প, পুরো চিত্রনাট্য জানেন আর হাতে গোনা কিছু মানুষ। বলছি মিলিয়ে নেবেন, এমনকী আদিত্যনাথ যোগীর উচ্চতার মানুষও সবটা জানেন না। প্রায় এক রোবটিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, যেখানে প্রশ্নাতীত আনুগত্য নিয়েই লোকজন কাজ করে যাচ্ছেন, ফল পাচ্ছেন। একটা প্রশ্ন না করেই সুনীল বনসল চলে গেলেন অযোধ্যা। হ্যাঁ, সুনীল বনসলের মতো সাংগঠনিক নেতা, দায়িত্বে আনা হল এই বাংলায়, তিনি এসে সবে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছিলেন তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল অযোধ্যায়, বদলে এলেন মঙ্গল পান্ডে। যিনি গেলেন তিনি কোনও প্রশ্ন করলেন না, যিনি এলেন তিনিও কোনও প্রশ্ন করলেন না। এটা হল ২০১৪-র পরের বিজেপি। কী ভাবছেন, তাঁরা ২০২৪ নিয়ে খুব ব্যস্ত? নিশ্চয়ই ব্যস্ত, কিন্তু তাঁদের একটা বিরাট অংশ কাজ করছে আগামী কেরালা বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে, তাদের একটা বিরাট অংশ কাজ করছে এই বাংলার আগামী বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে। আজকের বিজেপির যে নেতাকর্মীদের আপনি দেখছেন, সেটাও আইসবার্গের উপরের অংশ। এক বিরাট বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে তলায়, বিরাট বিরাট দায়িত্ব নিয়েই কাজ করছে, সবাই তাঁদের হদিশও রাখে না। যেমন ধরুন নরেন্দ্র মোদির এক নিজস্ব টিম আছে, কারা আছে সেখানে? কতজন আছে সেখানে? কার কী দায়িত্ব? কতজন জানেন? সংবাদপত্রে কতটা লেখা হয়েছে?
এ রাজ্যেই দেখুন, দিলীপ ঘোষ, পরিসংখ্যান বলছে তিনি সবচেয়ে সফল রাজ্য সভাপতি, তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজ্য দফতরে বসার জায়গাটুকুও নেই, অথচ তিনি ওনার কাজ করে যাচ্ছেন। আর কোথাকার কে করিম, রাজ্য রাজনীতিতে মমতার ছায়া ছাড়া ম্যাগনিফায়িং গ্লাস নিয়ে যাকে খুঁজতে হবে, বা তার থেকেও হাস্যকর মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন কবীর কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন। এটাই হল বিজেপির মোদি এডিশন, ২০১৪-র পরে বিজেপি। দেশজুড়ে পরিকল্পনা চলছে, একইরকম? না। বিভিন্ন রাজ্য তাদের অবস্থান, সেখানকার রাজনীতি, সেখানের মানুষের চাহিদা সব হিসেব নিকেশ করে আলাদা আলাদা ডোজ। একবার দক্ষিণ থেকে উত্তর করে খানিক ভাবমূর্তি ফিরেছে তাই এবার পূর্ব থেকে পশ্চিমে হাঁটা দিলেন রাহুল গান্ধী, কংগ্রেসের ন্যায় যাত্রা। মাথাতেও নেই যে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে এক নির্বাচনী জোট যার কক্ষে, এক্কেবারে মধ্যে রয়েছেন তাঁরাই। কাজেই এবারের যাত্রাতে শরিক দলগুলোকে হাজির করতে হবে, হাজির না করা হলে এই যাত্রার শেষে বেরিয়ে আসবে ইন্ডিয়া জোটের কঙ্কাল। না, মাথাতেও নেই যে অসম বাংলা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রতে ইন্ডিয়ার শরিকদের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে, তাদেরকেও এই যাত্রাতে শামিল করতে হবে। না হলে প্রতিটি রাজ্যেই প্রশ্ন উঠবে সেখানকার শরিক দল নেই কেন? এবং আদতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে জন্ম নেওয়া এই আঞ্চলিক দলগুলো আবার সিঁদুরে মেঘ দেখবে, তারা তো ঘরপোড়া গরু, মাথায় ঘুরবে, এইভাবে কংগ্রেস কি তাদের ভিত্তি কেড়ে নিতে চাইছে। হচ্ছেও তাই। বিহারে ঢুকলে যদি সেখানে লালু হাজির হতেন, তাহলে বিজেপির বিরুদ্ধে এই যাত্রা কার্যকর হত, বাংলায় আসার পরে যদি এই যাত্রায় মমতাকে শামিল করা হত তাহলে এই যাত্রা বিজেপি বিরোধী মানুষজনের কাছে একটা আশার আলো হয়ে দাঁড়াত। তা না করে রাহুলের ভ্যানে শতরূপ ঘোষ, ওদিকে মাত্র দু’ তিন দিন আগেই ঘোষণা হয়েছে রাহুল গান্ধী ওয়াইনাদ থেকেই দাঁড়াবেন, মানে কেরালাতে বাম-কংগ্রেস মুখোমুখি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | আমাদের সংবিধানে রামায়ণ আছে, রাম-সীতা আছে
এখানে নিজেদের ৭৫টা বিধায়ক আছে, দলের নেতাকর্মীরা তীব্র নীতীশ বিরোধী। সম্রাট চৌধুরি বলেছিলেন নীতীশকে না সরিয়ে পাগড়ি খুলব না, সেই পাগড়ি পরেই তিনি নীতীশের মন্ত্রিসভায় উপমুখ্যমন্ত্রিত্বের পদে শপথ নিলেন। বড় দল হয়েও, কেন্দ্রে ক্ষমতায় থেকেও বিজেপি মহারাষ্ট্রের নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিশকে একটা দল ভাঙিয়ে আনা নেহাতই জেলার নেতা শিন্ডের উপমুখ্যমন্ত্রী করে রেখেছেন। কেবল তাই নয় সেই উপমুখ্যমন্ত্রিত্বও আবার ভাগ করে নিতে হচ্ছে ক’দিন আগে চোর বলা অজিত পাওয়ারের সঙ্গে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের দিকে তাকান, কোথায় বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া? কোথায় রমন সিং? কোথায় শিবরাজ সিং চৌহান? কোনও কথা? একটাও বেচাল কমেন্ট? সব্বাই রাজি, খুশি, মেনে নিলেন? হয় কখনও? কিন্তু একটা কথা বলার সাহস হয়নি কারও। কিছু ভেবে বন্দি সঞ্জয় কুমারকে তেলঙ্গানা নির্বাচনের সময় দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছিল, আবার তাঁকেই আনা হয়েছে, জে পি নাড্ডা পিঠে হাত রেখে বলছেন আমাদের লক্ষ্য ১০টা আসন। বন্দি সঞ্জয় কুমারকে সরানোর পরেও তিনি একটা কথা বলেননি, আনার পরেও নয়। এদের কথা তো বাদই দিলাম, রামমন্দির আন্দোলনের মাথায় বসে থাকা বিনয় কাটিহার ঘরে বসেই কাটালেন ২২ জানিয়ারি, ঘরেই ছিলেন জোশি, আদবানি। টুঁ শব্দটুকুও নেই। রাজনাথ সিংয়ের মতো নেতা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকেন। অন্যদিকে তরুণ রাহুল গান্ধীর টিম রাহুলের একে একে নিভিছে দেউটি। শেষ উইকেট মুরলী দেওরার ছেলে মিলিন্দ দেওরা। কেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া থেকে মিলিন্দ দেওরাররা চলে যাচ্ছেন? কারণ তাঁরা রাজনীতিবিদ, ফিলানথ্রপিস্ট নন, সমাজসেবা করতে আসেননি। ক্ষমতা চান, পদ চান, রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস সেই ক্ষমতায় আসার ক্ষীণ আশাটুকুও দেখাতে পারছে না।
তরুণ কংগ্রেসের তরুণ নেতাদের দেখানো হচ্ছে ক্ষমতার সিঁড়ি, বিরোধী দুর্নীতিবাজ নেতাদের দেখানো হচ্ছে ইডি আর সিবিআই-এর ভয়। তার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেস এবং অবিজেপি অন্য দলের বহু ভুলের সুযোগ নিচ্ছে বিজেপি, মানুষের কাছে এমন কিছু ইস্যু রাখছে, রাখতে পারছে যা আগেই এক সমাধানে আনতে পারত কংগ্রেস বা অবিজেপি দলগুলো। যেমন ধরুন ৩৭০ ধারা, এ নিয়ে আগেই ভাবা যেত, এর সঙ্গে ৩৭১ ধারার প্রায় একই ব্যবস্থা যা উত্তর পূর্বাঞ্চলে আছে তা নিয়ে ভাবা যেত। কংগ্রেসের সময়েই সিবিআইকে খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট, সেই তোতাপাখিকে বিজেপি বাজপাখি করার পরে বিরোধীদের হুঁশ ফিরেছে। একটা নয় অজস্র দানবিক আইন তৈরি হয়েছে কংগ্রেস আমলেই, সে আইন বাম ডান সব সরকার ব্যবহার করেছে, আজকে তার সিলেক্টিভ ব্যবহার করছে বিজেপি, এই তো? নকশালদের এনকাউন্টারে মারেনি কংগ্রেস আমলে পুলিশ? ইসলামিক টেররিস্ট মারার জন্য এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট তৈরি হয়েছিল কাদের আমলে? দিল্লিতে বুলডোজার চালিয়েছিল কারা। এখন সেগুলোই নিয়ম করে হচ্ছে, এই তো? সেদিনও অজস্র মানুষকে বিনা বিচারে জেলে পোরা হয়েছিল, মোদি জমানাতেও আরও বেশি করে হচ্ছে। তালাক নিয়ে আইন আগে আনা যেত না? শাহ বানো মামলার সময় সত্যি কথাটা বলা যেত না? খোরপোশ মামলায় সমর্থন দেওয়া যেত না? এখনই ইউনিফর্ম সিভিল কোড নিয়ে আলোচনা শুরু করা উচিত নয়? তা নিয়ে বিরোধীদের মতামত কী? কেউ জানে না। মোদি সরকার বিল আনার পরে হেডলেস চিকেনের মতো ঘোরাফেরা করবে। এবং এই ইস্যুগুলোকে মানুষের সামনে রেখে শতবর্ষের জঞ্জাল সাফ করার আড়ালে এক হিন্দু রাষ্ট্র, এক জাতি এক ভাষা, এক ধর্মের স্লোগানকে আনার চেষ্টা করবে বিজেপি, এটাই তো স্বাভাবিক। এই অশ্বমেধ যাত্রার বিপরীতে কেবল রাহুল গান্ধীর ইমেজ বিল্ডিংয়ের জন্য এক ন্যায় যাত্রা দিয়ে কি খুব একটা কিছু করা সম্ভব? আর আগের যাত্রার সঙ্গে এই যাত্রার তফাতটাও তো বুঝতে হবে। কেরালা, তামিলনাডু, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, সেখানে কংগ্রেসের একটা জনভিত্তি আছে। এবারের যাত্রায় সেটা তো নেই।
বিহারে কংগ্রেসের ভোট কত শতাংশ? বাংলাতে একজন এমএলএ-ও নেই, উত্তরপ্রদেশে এমএলএ এক জন, এমপি একজন? কী নিয়ে যাত্রা হবে? এ কি যাত্রাপালা নাকি? শরিক দলের সঙ্গে কথা বলে তাদের নিয়ে একসঙ্গে ন্যায় যাত্রা করা যেত না? লোক হাসানো এতটাই জরুরি ছিল? যে সময়ে মোদিজি রামমন্দির উদ্বোধন করে সেই নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছেন, সেই সময়ে রাহুল গান্ধী সোনিয়া গান্ধীর দিল্লির আবাসের বাগান থেকে বিটার অরেঞ্জ তুলে কীভাবে মার্মালেড তৈরি করতে হয় সেটা বোঝাচ্ছেন, সেই ভিডিও আপলোড করছেন। কাদের জন্য? বিজেপির এক বিরাট যোগাযোগ আছে বিরোধী শিবিরেও, কারা তারা জানি না, কিন্তু আছে। সব মিলিয়ে এক ঝাঁ চকচকে তেল চুকচুকে মেশিনের পাশে এক ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিরোধী দল এবং তাদের সবচেয়ে বড় অংশ হল কংগ্রেস। তাঁরা কী করছেন জানেন না, কী করবেন জানেন না। ফলে উল্লসিত আরএসএস-বিজেপি ২০২৪ নয়, তারও পরের নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে। তাহলে প্রশ্ন করতেই পারেন এটাই কি আমাদের ভবিতব্য? এভাবেই কি চলবে? তাই হয় নাকি? এক হিন্দুরাষ্ট্রই যদি মানুষের চিরকালীন সমর্থন পেতেই থাকত তাহলে নেপালের হিন্দুরাষ্ট্র ভেঙে অন্য সরকার এল কী ভাবে? তালাক, মসজিদ, মন্দির, সিএএ, ৩৭০ ধারা ইত্যাদি ইস্যুতে মানুষ ভেসে যেতেই পারে, কিন্তু তারপর মানুষের মাথা আছে, পেট আছে, তার বিবেচনা বোধ আছে, একটা সময়ের পরেই মূল প্রশ্নগুলো সামনে আসবেই। কোথা থেকে নেতৃত্ব তৈরি হবে, কে নেতৃত্বে আসবেন তা ঠিক করবে মানুষ। ইতিহাস বড় নির্মম, তাই রাজছত্র ভেঙে পড়ে, রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে, জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে। এই ফ্যাসিস্ট রাজত্বে তথাকথিত বিরোধীরা অর্বাচীন হতেই পারেন, মানুষ অর্বাচীন নয়।