লোক হাসানো বলে একটা কথা আছে, আমাদের দেশ বা রাজ্য রাজনীতিতে সে কথার মানে প্রায় রোজ বোঝা যায়। রাজনীতি যে একটা সিরিয়াস চর্চা, তা আমাদের রাজ্যের রাজনীতি দেখলে মনেই হয় না। এমন নয় যে সারা দেশে বিষয়টা খুব আলাদা, তা নয়। কিন্তু সারা দেশে লোকে হাসলেও পিছনে একটা বড়সড় রকমের হিসেব থাকে, পাওনাগন্ডার হিসেব, কোটি কোটি টাকার হিসেব, স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। ধরুন হরিয়ানাতে মেয়রের আসন নিয়ে নির্বাচন। চণ্ডীগড় কর্পোরেশনে কংগ্রেস আপ-এর মোট কাউন্সিলরের সংখ্যা ২০, বিজেপির ১৪, অকালি দলের ১ আর ওখানকার নিয়ম অনুযায়ী সাংসদের ভোট একটা। মানে কালিদের ভোট পেলেও বিজেপির পক্ষে ১৬টার বেশি ভোট নেই, কিন্তু বিজেপির প্রার্থী জিতে গেল। কংগ্রেস আপের সমর্থনে ভোটের ব্যালটে ডাবল টিক ইত্যাদির জন্য বাতিল হল ৮টা ভোট, অতএব কংগ্রেস আপ ১২, বিজেপির প্রার্থী ১৬, জিতে গেল তারা। লোকে হাসল। কারা দিল দুটো টিক? পেছনে কী কী আছে বলার দরকার নেই। ক’দিন আগে যাকে না সরিয়ে পাগড়ি খুলবে না বলেছিলেন বিহারে বিজেপির নেতা সম্রাট চৌধুরি, তিনি এখন সেই নীতীশের উপমুখ্যমন্ত্রী। লোকে হাসছে কিন্তু পিছনের খেলার উপাদান নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। সংযুক্ত কংগ্রেস বিজেপি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে যিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি এখন বিজেপির জোটসঙ্গী, লোকে হাসছে, কিন্তু কারণ জানা। বাংলায় কিন্তু তেমন নয়। ইন্ডিয়া জোট, সেখানে বসে আলোচনা হচ্ছে, সিপিএম আছে, কংগ্রেস আছে তৃণমূল আছে। জোটও আছে। কিন্তু মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, সিপিএম-এর জন্যই তাঁরা এ রাজ্যে জোট করবেন না। ধরুন মাত্র গতকাল রাহুল গান্ধীর গাড়ির কাচ ভেঙে চুরমার। মাথা ন্যাড়া কৌস্তুভ বাগচী থেকে বহরমপুর কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী পর্যন্ত অ্যাজিটেটেড, হওয়ারই কথা। ওদিকে বিজেপি খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। লোকও হাসছে। পেছনে কী? আজ সেটাই বিষয় আজকে, ইট ছুড়ে কারা ভাঙল রাহুল গান্ধীর গাড়ির কাচ?
গতকাল সাতসকাল থেকেই খবরের দুনিয়া সরগরম, রাহুল গান্ধীর গাড়ির কাচ ভেঙেছে। একটা ভিস্যুয়াল ভাইরাল হল, রাহুল এবং অধীর গাড়ির পেছনে ভাঙা কাঁচের জায়গাটা দেখছেন। ব্যস, মাথা ন্যাড়া কৌস্তুভ বাগচি সুযোগ বুঝে মাঠে, এই সুযোগ ছাড়ে নাকি। বলেছিলাম, এবার বুঝুন তৃণমূলের সঙ্গে জোট? এই তৃণমূল বিজেপির বি টিম, আমাদের নেতা রাহুল গান্ধীর গাড়ির কাঁচ ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই অধীর চৌধুরি মাঠে, মুখে নাম না নিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিলেন রাজ্য সরকার তৃণমূলের, তাদের অসহযোগিতা পদে পদে, তার রাহুল গান্ধীর ন্যায় যাত্রাকে বাধা দেওয়ার জন্য হাজার একটা চেষ্টা চালাচ্ছে।
আরও পড়ুন: রাজ্য পুলিশ কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে? তাদের অতিসক্রিয়তা কি সরকারের চোখে পড়ে না?
কিছুক্ষণ পরেই কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব টুইট করলেন, এক মহিলা নাকি হঠাৎ করে রাহুল গান্ধীর গাড়ির সামনে এসে যায়, সাডন ব্রেক দিতে হয়, যার ফলে গাড়ির পেছনের উইন্ড স্ক্রিন ভেঙে যায়। ওদিকে রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভাল খোরাক পেয়েছেন, ছাড়বেন কেন? বোমা, দোদমা ফাটাচ্ছেন। এমন সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন যে রাহুল গান্ধীর গাড়ির কাচ নাকি বাংলার সীমানাতে ঢোকার আগেই ভেঙেছিল, এটা নাকি বিহার বিজেপির কাজ, এই ঘটনার নিন্দাও করলেন। বাদ থাকেন কেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ, তিনি জানালেন এসব নাটকবাজি করে লাভ নেই, তৃণমূল এসবের সঙ্গে জড়িত নয়। এবং আজ সকালে গণশক্তি বেশ বড় করেই রাহুলের গাড়ির কাচ ভেঙেছে এই খবরটা ছেপেছে, সব্বার বক্তব্য আছে, কিন্তু কংগ্রেসের ওই বক্তব্যটাই নেই যেখানে এটাকে এক দুর্ঘটনা বলা হচ্ছে। একঘর মজা এবং লোক হাসানো। কিন্তু বলতে পারবেন না যে এর পিছনে কোনও বিরাট খেলা আছে, এটা ছিল নির্মল খোরাক। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো খেলে যাচ্ছে। এসএফআই যেদিন ওয়াইনাদে রাহুল গান্ধীর অফিস ভেঙে চুরমার করেছিল সেদিন কি গণশক্তিতে খবরটা ছিল? যেদিন কংগ্রেসের ন্যায় যাত্রার গাড়ি আটকে দিয়েছিল হিমন্ত বিশ্বশর্মার পুলিশ প্রশাসন সেদিন বিজেপি কি কিছু বলেছিল? এবং মজার কথা হল কংগ্রেসের তরফে এটা যে একটা দুর্ঘটনা তা বলে দেওয়ার পরেও অধীর চৌধুরী বা বাংলা কংগ্রেসের তৃণমূল জোট বিরোধী অংশ এখনও সেই একই কথাই বলে চলেছেন। প্রত্যেকে আসলে নিজেদের রাজনীতির কথা, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি নিয়েই ব্যস্ত। লোক হাসছে। কিন্তু বিজেপি বাদ দিয়ে প্রত্যেকের মুখ পুড়েছে, কারও হুঁশ নেই। এই প্রশ্নই আমরা আমাদের দর্শকদের করেছিলাম, রাহুল গান্ধীর গাড়িতে ইট মেরেছে তৃণমূল, বলছে কংগ্রেস, বলছে সিপিএম, ইট মারা নিয়ে নাটক হচ্ছে বলছে তৃণমূল, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলছে এটা দুর্ঘটনা। এই গোটা ঘটনা কি বিজেপিকেই খানিক সুবিধে করে দিল না?
রাজনীতিতে সব সম্ভব, কিন্তু একটা বিশেষ সময়কালে কী সম্ভব নয় সেটাও সবাই জানে। আমরা তো জানিই যে এই বাংলাতে সিপিএম-তৃণমূল জোট হওয়া এই মুহূর্তে অসম্ভব, পরে সব কিছুই হতে পারে। কেউ কি ভেবেছিল যে কংগ্রেস সিপিএম জোট হবে? কিন্তু নাই বা হল জোট, একে অন্যের বিজেপি বিরোধিতার জায়গাটা তো মেনে নিতেই পারেন। সিপিএম বলতেও পারে যে এরপরেও দুর্নীতির প্রশ্নে আমাদের পক্ষে তৃণমূলের সঙ্গে জোট বাঁধা সম্ভব নয়, সেটা বিশ্বাসযোগ্যও হত আবার জাতীয় প্রেক্ষিতে কেন ইন্ডিয়া জোটে দুই দল আছে তাও পরিষ্কার হত। কিন্তু এ রাজ্যে কংগ্রেসের অবস্থান আরও গোলমেলে, আচ্ছা যদি সত্যিই অধীরবাবু মনে করেন যে তৃণমূলের কর্মীরা রাহুল গান্ধীর গাড়ির কাচ ঢিল মেরে ভেঙেছে, তাহলে আদৌ এই জোট কেন? আর দলের রাজ্য সভাপতি বলছেন ঢিল ছুড়ে কাচ ভাঙা হয়েছে, পরমুহূর্তে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলছেন দুর্ঘটনা, এভাবে লোক হাসানোরই বা দরকার কী?