পুলিশ তুমি যতই মারো মাইনে তোমার একশো বারো। সেই কবেকার স্লোগান। আজকের পুলিশ অবশ্য ১১২ টাকা মাইনে পায় না, কিন্তু পুলিশ থেকে গেছে পুলিশেই। ব্রিটিশ আমল থেকে যে স্ট্রাকচার তৈরি হয়েছিল তা এখনও বিলকুল একই থেকে গেছে। পুলিশ জানে হুকুম তামিল করো বুম বুম বা। ব্রিটিশ আমলে হুকুম এলে হুকুম তামিল করা ছিল প্রথম শর্ত, কিন্তু পরবর্তীকালে শাসকের মন বুঝে কাজ করাটা হয়ে দাঁড়াল কাজের আবশ্যিক শর্ত, ব্যস সেই থেকেই পুলিশ তুমি যতই মারো মাইনে তোমার একশো বারো স্লোগানের উৎপত্তি। বিপ্লবীয়ানার সামান্যতম গন্ধ লেগে আছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে, কাজেই সেখানে চোখ রেখেছে গোয়েন্দা পুলিশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শাসকদলের রাজনৈতিক নেতা বা মিল মালিক আর বড় জোতদার জমিদারদের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়াল এই পুলিশ বাহিনী। এবং ক্রমে ক্রমে তাঁদের দলদাস হয়ে ওঠা। যে দল যখন ক্ষমতায় এসেছে পুলিশ তখনই তার চাটুকারিতায় নেমেছে আর বিরোধীদের ঠান্ডা করেছে লাঠি দিয়ে হাজতে পুরে, গুমখুন করে। হাজার মানবাধিকার আন্দোলন আমাদের দেশের পুলিশকে সংবিধান মেনে আইন মেনে কাজ করার কোনও পথে নিয়ে যেতে পারেনি। উল্টে পুলিশ মানবাধিকারের কথা বলা মানুষজনকেও কখনও নকশাল, কখনও মাওবাদী বলে জেলে পুরেছে। সব জমানাতে এই পুলিশ একই থেকে গেছে। কী বাম কী ডান সব জমানাতেই পুলিশ আইন মেনে নয় শাসকদলকে তাদের নেতাদের খুশি করার জন্যই রাস্তায় নেমেছে, বেআইনি কাজ করেছে। সেটাই বিষয় আজকে, রাজ্য পুলিশ কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে? তাদের অতিসক্রিয়তা কি সরকারের চোখে পড়ে না?
আজ নয়, যেদিন থেকে বইমেলা শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই বইমেলাতে বই বিক্রি হয়েছে, খাবার বিক্রি হয়েছে, এর পাশাপাশি গিটার হাতে গান গেয়েছে বিভিন্ন দল, ব্যক্তি। বিভিন্ন পলিটিক্যাল গ্রুপ তাদের বই বিক্রি করেছে, সবাই স্টলে বসে করেছে এমনও নয়, অনেকেই হাতে করে বই নিয়ে বিক্রি করেছে। সমসাময়িক রাজনীতির প্রভাব বইমেলাতে পড়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ হয়েছে, মিছিল হয়েছে। আর হবে নাই বা কেন? বই পড়া তো কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বই শিক্ষার অঙ্গ, শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা বিপ্লব আনে কি না জানি না কিন্তু এক বোধের জন্ম তো দেয়। পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটাকে উসকে দেয়, সত্যি মিথ্যে বোঝার শক্তি দেয় আর সবচেয়ে বড় কথা নির্বাক হয়ে থাকার বদলে সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ে নিজের মতামতকে বলার সাহস জোগায়।
আরও পড়ুন: আজকে (Aajke) | গান্ডু – শুভেন্দু অধিকারি
কাজেই বইমেলাতে এই আলোচনা, তর্ক বিতর্ক, কিছু প্রতিবাদ, কিছু মিছিল, কিছু স্লোগান সব জমানাতেই ছিল। কিন্তু বইমেলা করনেওলাদের চিরটা কালই এসব নাপসন্দ, কারণ এতে নাকি তাঁদের বিজনেস মার খায়। সরকারও এত লোকের সমাবেশে কিছু মানুষের এই প্রতিবাদকে সহ্য করতে পারে না। অতএব দলদাস পুলিশ বইমেলাতেও তাঁদের শান্তিরক্ষার নামে কখনও লাঠি চালায়, কখনও গ্রেফতার করে, কখনও জেলে পোরে। এবারেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বেশ মনে আছে বাম আমলে বইমেলাতে বুদ্ধবাবুর নির্দেশেই পুলিশ এমনকী সাংবাদিকদেরও লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিল। মানবাধিকার কর্মীদের সে আমলেও গ্রেফতার করা হয়েছিল, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর বা লালগড় আন্দোলনের সময়ে বইমেলাতে প্রায় রোজ এই একই ছবি আমরা দেখেছি, পুলিশ ঘুরছে যাতে মিছিল না হয়, স্লোগান না ওঠে। নিয়ম মেনেই এই জমানাতেও ছবিটা একই রয়ে গেছে। কারা মিছিল করছিল? আরএসএস-বিজেপির ফ্যাসিস্ট প্রচারের বিরুদ্ধে থাকা লোকজন মিছিল করছিলেন, তাতে ছাত্ররা ছিল, বাচ্চাদের স্টলেও পুলিশ চলে গেল। গত দু’দিন ধরে ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব কি সরকার জানে? পুলিশমন্ত্রী জানেন? মমতা যাননি বইমেলায়? জাগো বাংলার স্টল হয়নি? বইমেলাতে মিছিল, পুলিশ আটকাতে গেছে, সামান্য ধস্তাধস্তি হয়েছে, এরজন্য জামিন অযোগ্য ধারায় ছাত্রদের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে? এবং তারপরেও আমাদের বলতে হবে যে নরেন্দ্র মোদিই একমাত্র ফ্যাসিস্ট, মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়? প্রতিবাদীদের জেলে পোরে? আমরা এখনও মনে করি আরএসএস-বিজেপি এদেশের সবচেয়ে বড় বিপদ, এক ফ্যাসিস্ট শক্তি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে থাকা কোনও দল আর তাদের সরকারও যদি একই কায়দাতে মিছিল, মিটিং, সভা, সমাবেশ বন্ধ করতে চায়, যদি তারাও প্রতিবাদী মুখকে জেলের ভেতরেই রাখতে চায় তাহলে এক ঘোষিত মূল শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইটা কঠিন হয়ে যায় না কি? এই পুলিশি সক্রিয়তার খবর কি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নেই? বইমেলা রাজনীতিবিহীন বইয়ের বাণিজ্য হতে পারে না, বইমেলা নিছক মোগলাই আর ফিশ কাটলেট খাওয়ার জায়গা হতে পারে না। বই থাকবে, বই থাকলে চিন্তা থাকবে, চিন্তা থাকলে পক্ষবিপক্ষ থাকবে, প্রতিবাদও থাকবে। যদি সেসব তুলেই দিতে হয়, তাহলে বইমেলা করার দরকারটাই বা কী? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বইমেলাতে মিছিল করার অপরাধে, স্লোগান দেওয়ার অপরাধে ছাত্র, লেখক, মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার করা হবে, জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করে ছাত্রদের জেলে পুরে দেওয়া হবে, এরকম কাজ কি আপনারা সমর্থন করেন? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
ক্ষমতার এক অনন্য ভাষা থাকে, এক চেহারা থাকে, তা কোথাও আলাদা হয় না। তর তম’র ফারাক থাকে, একটু ভালো কিছুটা ভালোর, বেশি খারাপ এরকম হয়, কিন্তু তার মোটের ওপর চেহারা বদলায় না। আর সেই ক্ষমতাকে ক্রমাগত আরও ক্রূর, আরও জনবিরোধী করে তোলার কাজে পুলিশের একটা ভূমিকা থাকে। বইমেলাতে একটা মিছিল খুব বিরাট কোনও বিষয়ই নয়, যাঁরা সেই মিছিল করেন, স্লোগান দেন তাঁরা যে ওখানে ভাঙচুর করতে গেছেন, বই বিক্রি বন্ধ করতে গেছেন এমনও নয়। কিন্তু পুলিশের তৎপরতা দেখলে মনে হবে দাউদের এজেন্টদের তারা সামনে পেয়েছে। এ ধরনের অতিসক্রিয়তা বন্ধ হওয়া উচিত, বইমেলাতে গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া উচিত।