কমরেড বলে ডাক দিল কেউ কমরেড বলে ডাক, বুকের মধ্যে রক্ত ছলাৎ, ঢেউ ছলাৎ, ছলাৎ। ধু ধু বালিয়াড়ি উদ্দাম নদী, পাহাড়ের ব্যারিকেড, সব মিলেমিশে হয় একাকার কমরেড কমরেড। কথা ও সুর অশোক দে। এমনিতে কমরেড শব্দের মানে বন্ধু, তা ব্যবহার হয়েছে ওই অর্থেই বহুবার, কিন্তু ওই কমরেড লেনিনের আহ্বান, চলে মুক্তি সেনা দল। ওই রাশিয়ার বিপ্লবের সময় থেকে দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে এই শব্দ হয়ে উঠল সহযোদ্ধার প্রতিশব্দ, আমাদের দেশেও তাই। একইভাবে কমিউনিস্ট পার্টির লাল ঝান্ডা আর কাস্তে হাতুড়িও হয়ে উঠল এক প্রতীক, যা কমিউনিস্টদের একান্ত আপন। সেই ছবিটার কথাই ভাবুন না, জার্মানিতে বিধ্বস্ত ভাঙাচোরা রাইখস্ট্যাগের মাথায় সোভিয়েত সেনারা কাস্তে হাতুড়ি চিহ্ন সমেত লাল পতাকা উড়িয়ে দিচ্ছে। আর প্রায় ঠিক তার পরে পরেই এই বাংলায় গান লেখা হচ্ছে, কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিসান ভাইরে কাস্তেটারে দিও জোরে শান। সেই জান কবুল লড়াই তেভাগার অধিকারের লড়াই ওই কাস্তে নিয়েই, গ্রামের জোতদার আর কংগ্রেসি নেতাদের বিরুদ্ধে লড়াই আর তীব্র ঘৃণা। আমাদের প্রণববাবু, হ্যাঁ মুখ্যমন্ত্রী প্রণববাবুর বাবাকে কীর্ণাহারে ঘিরে ধরে টিকি কেটে নিয়েছিল এই কমরেডরাই। ওই সময়েই হুগলি, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বিক্ষোভ, স্ট্রাইক, রাস্তায় লড়াই, হাতে কাস্তে হাতুড়ি। শ্রমিক মহল্লায় পুলিশ, লাঠি গুলি, বিধান রায়ের সরকার, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে লালঝান্ডা, কাস্তে হাতুড়ি নিয়ে মাঠ আগলাচ্ছেন মহম্মদ ইসমাইল। কমরেডরাই বলেন, আলো নিভিয়ে ব্যালট বদলে সামান্য ভোটে বিধান রায়কে কোনও রকমে জেতানো হয়েছিল, উল্টো দিকে ছিলেন ওই মহম্মদ ইসমাইল। কিছুদিন পরেই ভুখা মানুষের মিছিল, গুলি চালাল কংগ্রেসি সরকারের পুলিশ, খাদ্য আন্দোলন। যুক্তফ্রন্ট, কংগ্রেসের কলকাঠি নাড়ার জন্য হাজির রাজ্যপাল ধরমবীর। অবশেষে সত্তর দশক। কংগ্রেসি গুন্ডারা বেলা ১০টার মধ্যেই লুঠ করেছিল ব্যালটবাক্স, জ্যোতি বাবু হেরেছিলেন, ওই সত্তর দশকেই ঘর ভাঙা হয়েছিল, ঘরছাড়া হয়েছিলেন সিপিএম দলের কর্মী সমর্থকরা, গান লেখা হয়েছিল কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে। ৭৭-এ সিপিএম-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট, কমরেড জ্যোতি বসু লাল সেলাম, রাজ্য জুড়ে কাস্তে হাতুড়ি। এবং আরও তীব্র হয়েছে কংগ্রেস-সিপিএম লড়াই, চারু মার্কেটে পেট্রল বোমা, পোড়া লাশের ছবি, মালোপাড়ায় সারি সারি লাশ। উল্টো দিকে কেবল ভোট দেওয়ার জন্য হাত কেটে নেওয়া। এসব রাজনীতির মধ্যেই বিজেপির উত্থান এবং সিপিএম-এর সইফুদ্দিন চৌধুরীর কং বাম ঐক্যের তত্ত্বকে কেবল খারিজ করে দেওয়াই নয়, সইফুদ্দিন চৌধুরি, সমীর পুততুন্ড সমেত একঝাঁক নেতার দলত্যাগ এবং দল থেকে বহিষ্কার। তার ক’ বছরের মধ্যে বাম-কং জোট, আসন সমঝোতা, নির্বাচনী সমঝোতা ইত্যাদির মোড়কে আসলে বাম-কংগ্রেস ঐক্যের তত্ত্ব নিয়ে চলছে সিপিএম। গতকাল সেই তত্ত্বকে রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে দিতেই দলের ওই কাস্তে হাতুড়ি চিহ্ন সম্বলিত উত্তরীয় পরানো হল কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে, পাশে রইলেন রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সেটাই বিষয় আজকে, কমরেড অধীর চৌধুরী, লাল সেলাম।
স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশের সবথেকে বড় দল কংগ্রেস সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে নানান মতামত ছিল। শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে সমেত বেশ কিছু নেতা বহুদিন ধরেই কংগ্রেস দলকে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল বলে মনে করতেন এবং তাদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা চাইতেন, কিন্তু দলের সেই নেতারা যাঁরা পরে সিপিএম-এ এলেন বা তৈরি করলেন তাঁরা কংগ্রেসকে দেশের একচেটিয়া পুঁজি আর অবশিষ্ট সামন্তবাদের প্রতিনিধি হিসেবেই মুল্যায়ন করেছেন, যা এখনও সিপিএম-এর পার্টি কর্মসূচিতে আছে, সেই কর্মসূচিতে এও লেখা আছে যে এই একচেটিয়া পুঁজি, অবশিষ্ট সামন্ততন্ত্র এবং তাদের প্রতিনিধি এই কংগ্রেসকে হারিয়ে, উৎখাত করেই এক জনগণতান্ত্রিক সরকার তৈরি করতে হবে।
আরও পড়ুন: আজকে (Aajke) | লকেট, রচনা, দেব, হীরণ এবং রাম নবমী
সেসব আছে, কিন্তু তারমধ্যেই তো বিজেপির উঠে আসা, তখন লাইন পাল্টে কংগ্রেস বিজেপি সমদূরত্বের লাইন আনা হল। এরপরে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে, তাকে হঠাতে দেশজুড়ে প্রত্যেক গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে এক মঞ্চের কথা বলা হয়েছে, তার প্রয়োগের শুরুতেই একগুচ্ছ স্ববিরোধিতা ঘিরে ধরেছে সিপিএমকে। প্রথমত যে সব দলকে নিয়ে জাতীয় মঞ্চ তৈরি হল, ইন্ডিয়া জোট তৈরি হল, তাতে তৃণমূলও আছে, এদিকে বাংলাতে তাদের লড়তে তো হবে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে, যা আছে তৃণমূলের দখলে। ওদিকে কেরালাতে তাদের লড়তেই হবে কংগ্রেসের সঙ্গে, অন্য রাজ্যে যেখানে কংগ্রেস সমঝোতা করছে না যেমন অসম, যেমন ওড়িশা, যেমন অন্ধ্রপ্রদেশে সিপিএম লড়ছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও। সব মিলিয়ে স্ববিরোধিতার চূড়ান্ত, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা বা মাছ দিয়ে শাক ঢাকা নিয়ে চূড়ান্ত ধোঁয়াশা। কিন্তু নির্বাচন আর কাউকে না করুক, মহম্মদ সেলিমকে এতটাই উত্তেজিত করে যে উনি কাণ্ডজ্ঞান হারান। গতবার দাঁড়িয়েছিলেন ফুরফুরা শরিফ সংলগ্ন চণ্ডীতলায়, তো এতটাই জেতার ইচ্ছে যে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে অধীর বাবুর বক্তৃতা থামিয়ে আব্বাসকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আদৌ রাজনৈতিক কোনও চেহারাই নন, অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক কাঠমোল্লাকে জড়িয়ে ধরার একমাত্র কারণ এক ফোটো অপরচুনিটি তৈরি করা যা তাঁকে জিততে সাহায্য করবে। অধীরবাবু দৃশ্যতই বিরক্ত হয়ে নেমে যাচ্ছিলেন, বিমান বসু তাঁকে থামান। আজ সেই জেতার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় কাস্তে হাতুড়ি চিহ্ন সম্বলিত উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন অধীর চৌধুরীকে, নিজেও পরলেন, ভোট ভিক্ষায় নামলেন। জিততে হবে, এটাই বটম লাইন, যে কোনও মূল্যে জিততে হবে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে অধীর চৌধুরীর গলায় পরানো হল কাস্তে হাতুড়ি উত্তরীয়, কাস্তে হাতুড়ি হাত এক হয়ে গেল রাস্তায়, এটা কি এ রাজ্যের কমিউনিস্টদের আদর্শহীনতা? নাকি স্রেফ ভোটে জেতার জন্য একটা অস্থায়ী পরিকল্পনা? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
মহম্মদ সেলিমের ভোটে জেতার তীব্র বাসনা এর আগেও দেখেছি আমরা, আব্বাসকে কেবল জড়িয়ে ধরা নয়, ২০২১-এ আইএসএফ-বাম জোটের প্রধান কারিগর ছিলেন এই সেলিম সাহেব। তারও আগে ওনার ছবি দেওয়া বড় বড় কাট-আউট লাগানো হয়েছিল পার্ক সার্কাসে, দলের নিষেধ সত্ত্বেও, জানাজানি হতে তা তুলে নেওয়া হয়। রায়গঞ্জে মাথায় চন্দনের তিলক কেটে ঘুরেছিলেন এই মহম্মদ সেলিম, কেন? ওই একই, ভোটের জন্য। এবারে বুঝেছেন কংগ্রেস না হলে ন্যূনতম লড়াইও হবে না, তাই ছুটে গেছেন রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে যে রাহুল গান্ধী মাত্র এক দিন আগে বলেছেন দলের আরেক পলিটব্যুরো নেতা পিনারাই বিজয়নের সঙ্গে বিজেপির সেটিং আছে, তা নিয়ে একটা হালকা প্রতিবাদও আরেকজন পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড সেলিমের গলাতে দেখা গেল? না। কারণ ওই ভোটের হিসেব। আগামী ভোটে ইনি প্রয়োজনে মমতার গলাতেও ওই কাস্তে হাতুড়ি উত্তরীয় পরিয়ে দিতে পারেন, যদি ভোটের অঙ্ক সেরকম হয়, সে উত্তরীয় মমতা পরবেন কি না, তার আলোচনা পরে, কারণ সবাই তো অধীর চৌধুরী নন, কিন্তু সেলিম তা করতে পারেন, ওনার কাছে নির্বাচনে জেতাটাই একমাত্র লক্ষ্য, সবথেকে জরুরি।