বহু আগের, মানে সেই বাম আমলের কংগ্রেসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজ্যের দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় এসেই গিয়েছেন কংগ্রেস সদর দফতরে। প্রথমে বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজন চেল্লামেল্লি করেছে, তারপর ধুতি ধরে টান। সাংবাদিকরা সেদিন প্রণববাবুকে আক্ষরিক অর্থেই বিবস্ত্র হতে দেখেছেন, পরনের ধুতি খুলে গেছে, চশমা পড়ে গেছে, সে এক বিচিত্র ছবি। সেই দিনেই সম্ভবত রবীন দেব বলেছিলেন, পাগলা আগে দল সামলা, পরে গড়বি বাংলা। রবীন দেব হতে পারেন, গৌতম দেবও হতে পারেন, কোনও একজন তরুণ তুর্কি এরকম এক স্লোগান দিয়েছিলেন। আপাতত এই বঙ্গে বিজেপির রকমসকম দেখে ওই একই স্লোগানের কথা মনে পড়ে গেল। পাগলা পরে গড়বি বাংলা, আগে দল সামলা। বিজেপি দলের সদর দফতর, মুরলীধর লেনে একদা রাজ্য সভাপতি সমর্থকদের নিয়ে যাচ্ছেন। মাঠ ফাঁকা, সদর দফতরে তেমন কেউ নেই, সমর্থকরা ঢুকলেন দিলু ঘোষকে নিয়ে, স্লোগান দিলেন দল কা নেতা ক্যায়সা হো, দিলীপ ঘোষ জ্যায়সা হো। কেন হিন্দিতে স্লোগান? সে প্রশ্ন আমায় নয় বিজেপি নেতা সমর্থকদের করুন। এমনিতেও ওনারা জাতীয় দল হিসেবেই কর্মকর্তা নয় কারিয়াকর্তা বলতে বেশি পছন্দ করেন। দলের একমাত্র বাংলা ছড়াকার হলেন রুদ্রনীল ঘোষ, তো উনি তো সেদিন ছিলেন না। তাই ওই দল কা নেতা, বংগাল কা মুখ্যমন্ত্রী ক্যায়সা হো, দিলীপ ঘোষ জ্যায়সা হো-র স্লোগান পড়েছে। দিলু ঘোষ বিনয়ের সঙ্গেই বলেছেন, ওসব উৎসাহী সমর্থকদের বাপার, ওসবে বেশি কান দিতে নেই। ধরে নিলাম উনি কান দেননি, কিন্তু সুকান্ত মজুমদার বা শুভেন্দু অধিকারীও কান দেননি, এমনটা তো নয়? এবং এরই মধ্যে দিলু ঘোষ আলাদা করে বিজয়া সম্মিলনীর কথা ঘোষণা করেছেন, সব মিলিয়ে সার্কাস জমজমাট। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, দিলু ঘোষের বিজয়া সম্মিলনী নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিজেপি নেতারা।
পুজো শেষ, পুজো নিয়ে মমতার মাঠে খেলতে নেমে এক ওই সজল ঘোষের রামমন্দির ছাড়া ডজন ডজন গোল খেয়ে বসে আছে রাজ্য বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইভেন্ট বোঝেন, পুজো বোঝেন আর বাংলার মানুষকেও চেনেন, কাজেই পুজো নিয়ে উনি যথেষ্ট এগিয়ে। কিন্তু বিজেপি নেতারা ভেবেছিলেন পুজোর পরে বিজয়া দশমীর আয়োজনে ছড়াকার রুদ্রনীল এবং এখনও অবশিষ্ট কিছু টালিগঞ্জ সেলিব্রেটিদের এনে কিছু একটা করা যাবে। কিন্তু তার আগেই দিলু ঘোষ জানিয়েছেন, উনি বিজয়া দশমীর এক সম্মিলনীর আয়োজন করছেন, ব্যস, ফিসফিস, গুজগুজ শুরু। আগামী পাঁচ তারিখে দিলু ঘোষের মর্নিং ওয়াকের সময়েই সেই সম্মিলনী। কারা যাবেন? কিছু মাইনে পাওয়া সাংবাদিকদেরও কাজে লাগিয়ে সে তথ্য জানার চেষ্টা করছেন বিজেপি নেতারা। এখানেই কি শেষ? রাজারহাটে সায়ন্তন বসু আর রাজু ব্যানার্জি বিজয়া সম্মিলনী সেরে ফেলেছেন, সেই অনুষ্ঠানের মেনু নিয়েও গবেষণা চলছে। কেন? কারণ এই দুই নেতাই আবার দিলীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ।
আরও পড়ুন: Aajke | টাটার জয়, বিপ্লবী কমিউনিস্ট তৃতীয় ছাগল সন্তান সিপিএম-এর জয়
আজ বৃহস্পতি, রবিবারে উত্তর ২৪ পরগনাতে আরও একটা বিজয়া সম্মিলনী হওয়ার কথা। জেলায় জেলায় দিলু ঘোষের অনুগামীরা আলাদা বিজয়া সম্মিলনী করছেন। এদিকে অফিসিয়াল বিজয়া সম্মিলনী হওয়ার কথা ছিল সল্টলেকের ইজেডসিসি-তে। কেন? ওখানে কেন? কারণ ওই হল এবং ইজেডসিসি-র মাথায় আছেন কেন্দ্রীয় সরকারের আমলা, তাই ওই হলেই বিজেপির যাবতীয় অনুষ্ঠান হয়। তো সেই অনুষ্ঠান হবে নাকি হবে না এসব দোলাচলের মধ্যে মাত্র গতকাল জানানো হয়েছে আপাতত তা স্থগিত রইল। কারণ? না, কারণ জানানো হয়নি। সব মিলিয়ে দিলু ঘোষ অ্যাডভানটেজ, কিন্তু তিনি আবার দিল্লির নেতাদের, মোদি-শাহের গুডবুকে নেই, এদিকে বিজেপি কর্মীদের মধ্যে তিনিই জনপ্রিয়। কাজেই তাঁকে নিয়ে টেনশনে রাজ্যের আর দুই নেতা। এক সূত্র জানাচ্ছে, অধিকারীবাবু এবং সুকান্তবাবু দুজনেই তাঁদের লোকজন লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কারা কারা এই দিলু ঘোষ গোষ্ঠীতে আছেন। দলের মধ্যে দিলু ঘোষ সমর্থকরাও বসে নেই, তাঁরাও জায়গায় জায়গায় ঘোঁট পাকাচ্ছেন। তার উপরে এনআরসি হবেই এমন প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরেও এনআরসি-র কোনও নামগন্ধ নেই দেখে বনগাঁর ঠাকুরবাড়ি ক্রমশ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। সব মিলিয়ে দল তৃণমূলের সঙ্গে লড়বে কী? নিজেদের লড়াই তো বন্ধ হচ্ছে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, দিলু ঘোষ বনাম শুভেন্দু অধিকারী বনাম সুকান্ত মজুমদার শিবিরের মধ্যে এই ক্রমাগত আকচাকচিই কি এ রাজ্যে বিজেপিকে শেষমেশ তিন নম্বরে ঠেলে দেবে? শুনুন মানুষ কী বলেছেন।
এ রাজ্যের বিজেপি নেতাদের অপদার্থতা যত বাড়ছে, যত বেশি করে তাঁদের মধ্যের কোন্দলের ছবি বেরিয়ে আসছে তত বেশি করে তাঁরা রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ বা ইডি-সিবিআই-এর অভিযান গ্রেফতারের উপর নির্ভর হয়ে পড়ছেন। অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে বাংলা বিজেপির তফাত হল ৭০ জন এমএলএ নিয়েও তাঁরা রাজ্য জুড়ে কোনও দাগ কাটার মতো আন্দোলন খাড়া করতে পারছেন না। এবং সেই সংগঠনহীনতাই শেষমেশ তাঁদের এক খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ২০২৪-এ সরকার চলে গেলে বা কোনও রকমে জোড়াতালি দেওয়া সরকার হলেও বাংলায় বিজেপি পূনর্মূষিক ভব হয়ে উঠবে। আবার সেই ৭-৮ শতাংশ ভোট এবং শূন্য কিংবা দু’ চারটে বিধায়ক নিয়েই টিকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হবে। আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর এ জীবনে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না।