সেই গণশক্তি যেখানে ছাপা বিজ্ঞাপন থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে সেমিনার হচ্ছে, তাও আবার জ্যোতি বসু সেন্টার ফর স্যোশাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানের উদ্বোধক কে? নীতীশ কুমার। মানে সিপিএম জানতই না যে ইনি একজন পালটু কুমার? খবরই ছিল না যে ইনি অটলের মন্ত্রিসভাতে মন্ত্রী ছিলেন? জানাই ছিল না যে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে উনি দীর্ঘ সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন? সব জানতেন সিপিএম-এর নেতারা। যে যে অভিযোগ সিপিএম-এর নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বলে থাকেন, যথা মমতা অটলের মন্ত্রিসভাতে ছিলেন, বিজেপির সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক ইত্যাদি, তার সবক’টা আরও বেশিভাবে প্রযোজ্য এই নীতীশ কুমারের জন্য। কিন্তু তবুও এখানে ডাকা কেন? কারণ নীতীশকে ধরে সিপিএম নেতারা বিহারে অন্তত একটা সেফ সিট পেতে চাইছিলেন। সেদিন নীতীশ আসেননি, ৮ দিন ধরে গণশক্তিতে টানা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, তিনি আসেননি। কমরেড সেলিম জানিয়েছিলেন উনি কুয়াশার জন্য প্লেন ধরতে পারেননি, উনি জানিয়েছিলেন ওনার কাজের ব্যস্ততার জন্য আসতে পারেননি, এখন বোঝাই যাচ্ছে যে কোন কাজে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু যাই হোক মুখ পুড়েছে সিপিএম-এর। এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন ঘটনা তো সিপিএম প্রথম ঘটাল না, বহুবার ঘটিয়েছে, কিন্তু সেখানেই কি শিক্ষা হবে? সেটাই আজকের বিষয় আজকে, আবার সিপিএম-এর মুখ পুড়ল, না শুধরোলে আরও পুড়বে।
জন্মাবধি এক কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচন, ভোট, কীভাবে আর কটা আসন পাওয়া যাবে, কীভাবে ক্ষমতাকে ব্যবহার করা যাবে ছাড়া আর কিছুই ভেবে উঠতে পারল না। ধরুন ১৯৬৪, কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগে ভাগ হচ্ছে। কেন? সিপিএম বলেছিল সিপিআই হল দক্ষিণপন্থী সুবিধেবাদী দল, কংগ্রেসের দালাল, মনে করুন সেই স্লোগানের কথা দিল্লি থেকে এল গাই সঙ্গে বাছুর সিপিআই। ওরা বিপ্লব করবে না, ওরা দক্ষিণপন্থী, আমরাই আসলে এক সাচ্চা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি বলার পরে ৬৪ সালে দক্ষিণ কলকাতার ত্যাগরাজ ভবনে নতুন দল তৈরি হল সিপিএম। কিছুদিনের মধ্যে নির্বাচন এল, কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্গেই সিপিআই-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার করা হল। তারপর সরকার বানানোর জন্য সেই সিপিআই-এর হাত ধরে তৈরি হল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার, এক বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, এক দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে সরকার গড়ল। সে সরকার ভেঙে গেল, আবার নির্বাচন, আবার যুযুধান শিবির, আবার সেই একই প্রচার, সংশোধনবাদী, দক্ষিণপন্থী ইত্যাদি, আবার ঝুলন্ত বিধানসভা, আবার সেই দক্ষিণপন্থীদের নিয়ে সরকারে সিপিএম।
আরও পড়ুন: Aajke | রাহুল গান্ধী কী চান? অধীর চৌধুরী কী চান?
বারবার এরকম সুবিধেবাদী জোটের মধ্যে থেকেছে তারা। আমাদের দেশের সব দলই থেকেছে, কিন্তু এনারা শুধু থাকেননি, দাবি করেছেন তাঁরা আগমার্কা সৎ বিপ্লবী দল যাঁরা এক আদর্শ নিয়ে চলেন। কারা ছিল ভি পি সিং মন্ত্রিসভার দুটো স্তম্ভ? সিপিএম-এর নেতৃত্বে বামেরা, অন্যদিকে বিজেপি। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বোফর্সের দালালি খেয়েছেন, ওনাকে জেলে পাঠাব, হাতে হাত ধরে বলেছিলেন জ্যোতি বসু, অটল, আদবানি। সেখান থেকেই কংগ্রেসের পতন, বিজেপির উত্থান। কিন্তু ওনারা তকমা নিয়েই ঘুরেছেন, আগমার্কা সাচ্চা বিপ্লবী দল। দেশের কংগ্রেস দল কেবল নয়, সমস্ত বিরোধী দল বলছে দায়িত্ব নিন জ্যোতিবাবু, বিপ্লবী দল তা নাকচ করেছিল। আমেরিকার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছে কংগ্রেস, সমর্থন তুলে নিল সিপিএম। চুক্তিও হল, সরকারও পড়েনি, বরং তার সুযোগ নিয়েই এই রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় এল, বিপ্লবী পার্টির ব্যাখ্যা হল, মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আরএসএস-এর চক্রান্তের ফলেই তাঁরা হেরে গেছেন, বোঝো কাণ্ড। হারার পরে কুঁকড়ে গেল সিপিএম, নির্বাচনে তাদের ভোট চলে গেল বিজেপির দিকে, বিজেপির উথ্বান, ২০১৬ তে আবার হার, আসন আরও কমল। ২০১৯-এ বিজেপির ১৮টা আসন জেতা, সবই নাকি মমতার সঙ্গে সেটিং। ২০২১-এ এক কমিউনিস্ট পার্টি এক অশিক্ষিত মৌলবাদী মোল্লাকে ব্রিগেডের মিটিং এ বুকে জড়িয়ে মুসলমান ভোট জোগাড়ের ধান্দায় নামল, ফল? ফুরফুরা শরিফের ঢিল ছোড়া দূরত্বে কমরেড সেলিম চণ্ডীতলা আসনে তিন নম্বরে। হারার পরে তত্ত্ব কী? বিজেপি তৃণমূল সেটিং। দেশের বাকি দলগুলোর রাজনৈতিক ভুলভ্রান্তি কি নেই? আলবাত আছে, কংগ্রেস থেকে শুরু করে সমাজবাদী দল, বিএসপি, জনতা দলের বিভিন্ন ফ্যাকশনের নানান ভুলের জন্যই তো আজ বিজেপির এই রমরমা বাজার। কিন্তু নিজেদের এক সাচ্চা বিপ্লবী আদর্শবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বলে তো তারা দাবি করেনি, সেসব ভুলের পরে তারা বিভিন্ন ভাবে শুধরানোর চেষ্টাও করেছে। ধরুন তৃণমূল, সিপিএমকে হঠানোর জন্যই তো বিজেপির হাত ধরেছিল, কিন্তু বুঝেছিল যে এরফলে মুসলমান ভোট, সংখ্যালঘু ভোট চলে যাবে। তারা নিজেদেরকে ওই সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের সবচেয়ে বড় দাবিদার হিসেবে জিইয়ে রাখতেই বিজেপির তীব্র বিরোধিতা করে চলেছে। ডিএমকে দল ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির তীব্র বিরোধী হলেও বিজেপির সঙ্গে গিয়েছিল, তার তাদের অবস্থান ঠিক করেছে। কিন্তু সিপিএমকে দেখুন। যদি তারা মনে করত এইরকম এক অবস্থায় কংগ্রেসের সঙ্গেই চলতে হবে, আদর্শগতভাবে সেটাই সঠিক, তাহলে তারা দেশজুড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধত, কিন্তু তারা যেখানে ক্ষমতায় আছে সেই কেরালায় কং-এর সঙ্গেই তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তার মানে কোনও আদর্শ নয়, একটা কমিউনিস্ট পার্টিও কেবল নির্বাচনের হিসেব নিকেশ করেই কৌশলী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। একই হিসেবে তারা এই রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট চায়। কিন্তু তাদের টগর বোষ্টমীপনা হল, তৃণমূল আর কংগ্রেসের জোট হলে তা তো প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাবে, অতএব সেই জোট যেন না হয়, তার চেষ্টা ও কামনা তারা করে যাচ্ছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, সিপিএম বা এই সরকারি বামেরা নিজেদেরকে এক অসম্ভব আদর্শবাদী নীতিনিষ্ঠ দল হিসেবেই লোকের সামনে রাখতে চায়, কিন্তু তাদের বিভিন্ন কাজকর্ম কি সেই ধারণার বিরোধী নয়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
বামপন্থীরা শুধু সৎ হবে এটাই কোনও মাপকাঠি হতে পারে না। একবারের জন্যও কি কেউ বলতে পারেন যে জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, আচার্য কৃপালিনী, মোরারজি দেশাই, রাজীব গান্ধী, কাঁসিরাম, চন্দ্রশেখর, চরণ সিং, অটল বিহারী বাজপেয়ী, লাল্কৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর জোশি, এরা চোর ছিলেন? ব্যক্তিগতভাবে অসৎ ছিলেন? একজনও না। কিন্তু এঁরা কি কমিউনিস্ট ছিলেন? কমিউনিস্টরা সৎ তো হবেনই কিন্তু রাজনৈতিক সততা এবং আদর্শের সঙ্গে আপসহীন হওয়াটাও তো কমিউনিস্টদের কাছ থেকেই আশা করে মানুষ। সেইদিক থেকে দশে দুইও পাবে না সিপিএম। মুখ পুড়েছে বারবার, নিজেদের না শুধরালে আবার মুখ পুড়বে।