অনেকেই, এমনকী বিজেপিরও কিছু নেতা এখন মাঝেমধ্যেই একান্ত আলাপচারিতায় বলেন, কংগ্রেস-মুক্ত ভারত সম্ভব নয়, আসলে কংগ্রেস যেখানে নেমেছে তার থেকে আরও খারাপ কিছু হওয়া প্রায় অসম্ভব। সত্যি যে দল এক সময়ে ৫৪৩-এ ৪১৪টা আসন পেয়েছিল, সেই দল এখন কোথায় নেমেছে। তারা এখন ৫২, মানে লোকসভার ১০ শতাংশ আসনও হাতে না থাকায় তারা সরকারিভাবে স্বীকৃত বিরোধী দলও নয়। এর পিছনের কারণ কী? কারণ কংগ্রেসের সাংগঠনিক কাঠামো। দিল্লিকেন্দ্রিক সংগঠন ছিল, রাজ্যে রাজ্যে কিছু পুতুল তৈরি হয়েছিল, জি হুজুরের দল। তারপর দিল্লির সে রোয়াব গেছে, সরকারি ক্ষমতা গেছে সেই জো হুজুরেরা এখনও আরও অবিন্যস্ত। অরুণ জেটলি একবার বলেছিলেন হেডলেস চিকেন, মুণ্ডহীন মুরগি। সত্যিই তাই। দক্ষিণের কিছু রাজ্য বাদ দিলে কংগ্রেসের সাংগঠনিক অবস্থা ওই হেডলেস চিকেনের মতোই। কাজেই একে একে নিভিছে দেউটি। আগে যাকে টিম রাহুল বলা হত তাদের মধ্যে থেকে হিমন্ত বিশ্বশর্মা, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, এ কে অ্যান্টনির ছেলে অনিল অ্যান্টনি, গুজরাতের অল্পেশ ঠাকোর, হার্দিক প্যাটেল, উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ চেহারা জিতিন প্রসাদ, আর পি এন সিং, বলরাম ঝাখরের পুত্র পঞ্জাবের সুনীল ঝাখর, অশ্বিনী কুমার এবং সর্বশেষ উইকেট পড়েছে মহারাষ্ট্রের মুরলী দেওরার পুত্র মিলিন্দ দেওরার। এদের কেউ কেউ আরও বড় আকাঙ্ক্ষা সাধনের জন্য, কেউ কেউ জেলে যাওয়ার ভয়ে বিজেপিতে চলে গেছেন। অথচ এঁরাই ছিলেন টিম রাহুল। দল এঁদের ধরে রাখতে পারেনি, সবাইকে পারত না কিন্তু কিছু লোককে তো আটকানো যেত। কিন্তু বললাম সংগঠন যদি হেডলেস চিকেন হয়ে পড়ে তাহলে এটাই স্বাভাবিক। তো সেই হেডলেস চিকেনদের অন্যতম হলেন আমাদের বহরমপুর কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী। দল ও দলের অবস্থান আর চাহিদাটাও বুঝে ওঠা যাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সেটাই বিষয় আজকে, রাহুল গান্ধী কী চান? অধীর চৌধুরী কী চান?
কংগ্রেসের জানা আছে তাদের স্ট্রাইক রেটের কথা, যেখানে তারা সরাসরি বিজেপির সঙ্গে লড়াই করে সেখানে তাদের স্ট্রাইক রেট ১০ শতাংশ। মানে ১০০টায় বিজেপির সঙ্গে সরাসরি লড়লে মাত্র ১০টায় জেতার সম্ভাবনা নিয়ে মাঠে নামা। এবং এবারেও তেমন আসনের সংখ্যাই বেশি যেখানে তাদের মুখোমুখি হতে হবে বিজেপির। তাহলে?
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু, সুকান্ত, দিলীপরা সারাদিন চেষ্টা করার পরেও ডাহা ফেল
বাকি আসনে বিভিন্ন বিরোধী দল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দল কোনগুলো? কংগ্রেসের সঙ্গে এক ধরনের জোট আছে তেমন দল হল লালুপ্রসাদ, তেজস্বী যাদবের আরজেডি, নীতীশ কুমারের জেডিইউ, শরদ পাওয়ারের এনসিপি, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, স্তালিনের ডিএমকে। মানে এখানে এক ধরনের জোট আছে, একটা রফাসূত্রে আসা যাবে। কাদের সঙ্গে জোট নেই কিন্তু তারা সক্রিয়ভাবে বিরোধী জোটে আছে? প্রথমটা হল আপ, পরেরটা হল তৃণমূল আর তিন নম্বরে সমাজবাদী দল। এখানে জোট হলে কংগ্রেসের আসন কি খুব বাড়বে? না বাড়বে না, কিন্তু বিজেপির কমবে। দিল্লিতে আপ-এর সঙ্গে জোট হলে ৭টা আসনের তিন কি চারখানা আসন খোয়াবে বিজেপি, রামমন্দিরও বাঁচাতে পারবে না। গুজরাতেও একই কথা, জোট হলে এক আধটা বিজেপির আসন কমতে পারে। আর আপাতত কংগ্রেসের স্ট্র্যাটেজি বিজেপির আসন কমানো, কারণ বিজেপিকে না কমাতে পারলে কংগ্রেস আরও শক্তি হারাবে। এটা রাহুল সোনিয়া এবং যে কোনও বুদ্ধিমান মানুষজন জানেন কিন্তু অধীরের ব্যাপার আলাদা উনি তো এই সব গোত্রে পড়েন না, তাই জানেন না। সমাজবাদী দলের সঙ্গে জোট হলে ওই একই ব্যাপার, নিজেদের আসন হয়তো এক থেকে দুই কি তিন হবে, ব্যস, এটা জানে কংগ্রেস। বাংলাতে রাহুল জানেন যে তৃণমূলের সঙ্গে জোট না হলে একটা আসনও হয় তো কংগ্রেস পাবে না কিন্তু বিজেপি কম করেও চার পাঁচটা আসন জিতে যাবে কেবল ভোট ভাগাভাগির জন্য। এগুলো জানার পরেই সোনিয়া মমতার সঙ্গে কথা বলছেন, রাহুল মমতার সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন কিন্তু এগুলো বোঝার মতো সাধারণ জ্ঞানগম্যি অধীরবাবুর আছে কি না জানা নেই, উনি বকেই যাচ্ছেন। ওনার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে, জোট হলেও বহরমপুরের আসনে যদি তৃণমূল পিছন থেকে ছুরি মারে? সিপিএম-এর ভোটটা থাকলে বরং জেতার সম্ভাবনা আছে, তাই জোট ভাঙো, এটা আপাতত অধীর চৌধুরীর ওয়ান অ্যান্ড ওনলি ওয়ান প্রোগ্রাম। ওদিকে রাহুল বা কংগ্রেসের মাথায় যাঁরা এখনও আছেন তাঁদের মাথায় স্বাভাবিকভাবেই ঘুরছে বিজেপিকে ২৫০-২৬০-এর মধ্যে আটকে রাখা, না রাখতে পারলে তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন, এটা তাঁরা জানেন। তাই রাহুল চাইছেন সবচেয়ে বড় জোট আর অধীর চৌধুরী চাইছেন বহরমপুরের আসন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে বার বার অধীর চৌধুরী প্রকাশ্যেই মমতার বিরুদ্ধে তীব্র কটূক্তি করে, রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চেয়ে আসলে কি জোট ভাঙার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন? রাহুল গান্ধীও কি সেই চেষ্টাতেই আছেন নাকি উনি জোটের ব্যাপারে সিরিয়াস? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
একদা আরএসপি-র উঠতি নেতা, পরবর্তীতে এলাকার রবিন হুড বনে যাওয়া অধীর তারপরে সিপিএম জমানায় বুদ্ধবাবুর পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়িয়েছেন, জেল থেকে নির্বাচিতও হয়েছেন। সেই অধীরের আপাতত লক্ষ্য বহরমপুরের আসন। দেশের রাজনীতি তাঁকে বিচলিত করে না, দেশের সামনে ফ্যাসিজমের মতো বড় বিপদ তিনি বুঝতে পারেন বলেও মনে হয় না। কিন্তু সেই কারণে জোট ভাঙার যে চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন তার এক সুদূরপ্রসারী ফল তাঁকে ভুগতে হবে, এটা রাজনীতির প্রথম পাঠের ছাত্ররাও জানেন।