মাঝেমধ্যেই দেখেছি, দারুণ প্রস্তুতি থাকে, সাতসকালে বাজারে গিয়ে টাটকা ফুলকপি, কড়াইশুঁটি, নতুন আলু কেনা হল, খাসির মাংস কেনা হল রেওয়াজি দেখে, সালাদের জন্য শসা, টোমাটো, মুগডাল। আমি বাৎসরিক পিকনিকের কথা বলছি। তারপর কী হইতে কী হইয়া গেল। ভাত ধরে গেল হাঁড়িতে, তাতে পোড়া গন্ধ। অমন নতুন আলু ফুলকপি কড়াইশুঁটির তরকারি গলে পাঁক আর মাংস সেদ্ধই হয়নি। এরকম হয়, বহু প্রিপারেশন নিয়ে মাঠে নামার পরেও ফলাফল শূন্য হয়। গতকাল রাজ্য বিজেপির ছিল সেই দিনটা। মাস ছয় আগেই মোটা ভাই, ছোটা মোটা ভাই এবং নানাবিধ গাবলুস গুবলুস নেতারা দিল্লি থেকে এসে জানিয়েছিল মোক্ষম সুযোগের কথা, একটা লাগ লাগ লাগ ভেলকি লাগিয়ে দেওয়ার কথা। ওধারে রামমন্দির উদ্বোধন হবে, গর্ভগৃহ থেকে বাইরে এসে মোদিজি নতুন কালচক্রের কথা বলবেন, নতুন ভারতের আগামী নির্মাণের কথা বলবেন আর এখানে সামান্য উসকানিতে আগুন ধরাতে পারলেই ব্যস। কোথাও, রাজ্যের কোথাও একটা অশান্তি বাঁধাতে পারলেই ব্যস। হিন্দু খতরে মে হ্যায়, উত্তেজিত বাঙালি হিন্দি বলতে বলতে বেরিয়ে আসত মুরলীধর লেনের দফতর থেকে, হিন্দুদের উপর অত্যাচার তাও আবার এরকম এক ঐতিহাসিক দিনে। এরকমই কি একটা ইচ্ছে ছিল না? রাজ্য জুড়ে এরকমই কি একটা নীল নকশা নিয়েই কালকের দিনটা শুরু হয়নি? কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ওই যে আগেই বলেছি অন্তত এ বাংলাতে গতকাল কালচক্র শুরু হয়নি। গতকাল কেবল মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের দিনই ছিল না, কেবল এক ধর্মের উন্মাদনা ছড়ানোর দিন ছিল না। যাই থাকুক মনে, শেষমেশ গতকাল রাতে রাজ্য বিজেপির মার্কশিটে পাশ নম্বরটুকুও জোটেনি। আর সেটাই বিষয় আজকে। শুভেন্দু, সুকান্ত, দিলীপরা সারাদিন চেষ্টা করার পরেও ডাহা ফেল।
যতটা সফলভাবে অন্তত দেশের গোবলয়ে এই রামমন্দির উদ্বোধনকে নিয়ে যেতে পেরেছে বিজেপি, তারচেয়েও বেশি অসফলতা এই চোখে পড়ল এই বাংলায়। গতকাল খেলার মাঝমাঠ থেকে দুটো উইংস বা গোলপোস্টে জবরদস্ত দখল ছিল তৃণমূলের। সব্বাই জানে গতকাল ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক ইভেন্ট, ২০২৪-এর আগে দেশজুড়ে এক রাজনৈতিক প্রচারের অঙ্গ হিসেবেই বিজেপি তার রামমন্দিরের এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছিল।
আরও পড়ুন: Aajke | ২২ জানুয়ারি এ বাংলায় কারা রাস্তায় থাকলেন?
সত্যিই যদি এটা ভক্তি আর আস্থার বিষয় হত, তাহলে দিলীপ, শুভেন্দু, লকেট, সুকান্তরা অযোধ্যাতেই থাকতেন। ওনাদের তো বাদই দিলাম, আপাতত বিজেপির দু’ নম্বর নেতাও গতকাল দিল্লির ওয়ার রুম সামলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। নির্মলা সীতারামন তামিলনাড়ুতে, নির্বাচিত প্রত্যেক বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের রাজ্যে। কেন? কারণ গতকাল ছিল এই ধর্মীয় উন্মাদনা, এই ধর্মীয় মেরুকরণকে এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার দিন। কারণ হাজার চেষ্টার পরে এখনও, হ্যাঁ এখনও হিন্দু জনসংখ্যার ৩০-৩৫ শতাংশকেই নিজেদের দিকে নিয়ে যেতে পেরেছে বিজেপি। মানে কমিটেড হিন্দু ভোটার, এর পরের যে সংখ্যা তা নড়বড়ে। কিন্তু তাদের দরকার অন্তত ৬০ শতাংশ, যা তাদের এক দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করবে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সার্ভে বলছে, দেশের ৬৪ শতাংশ হিন্দু প্রতিদিন মন্দিরে যায়, পুজো করে, প্রার্থনা করে। তাহলে সেই হিন্দু জনসংখ্যা, যা দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ, তার মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি ভোট কেন পাচ্ছে না বিজেপি? কারণ হিন্দু জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাস করে, বিজেপির কড়া হিন্দুত্ববাদে তারা এখনও মজেনি। কিন্তু সেটাই তো লক্ষ্য বিজেপির, সেই কারণেই মন্দির উদ্বোধন ঘিরে এত উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা। সারা ভারতের কথা আরেকদিন আলোচনা করা যাবে, বরং এই বাংলায় গতকাল আমাদের চোখে যা পড়ল তা বলা যাক। প্রথম কথা হল তুলসীদাসী রামায়ণে মজে থাকা গোবলয়ের থেকে বাংলার মানুষের পছন্দ কৃত্তিবাসী রামায়ণ, যেখানে সীতা ভিন্ন রামের অস্তিত্বই নেই। যেখানে রাম এক রণহুঙ্কার নয়, রামায়ণ রামসীতার কাহিনি, যুদ্ধ আছে, রাবণ বধও আছে কিন্তু তাতে সেই বীর রস অনুপস্থিত, হনুমান এক ভক্ত, রাবণ এক অসৎ মানুষ, লক্ষণ এক ছোট ভাই। সব মিলিয়ে আমাদের রামায়ণের আঙ্গিক আলাদা। তাই বাবরি ভেঙে এক নতুন মন্দির আমাদের বাঙালি জীবনে এক নব চেতনার জন্ম দিতে পারেনি। কাজেই সক্কাল থেকে দিলীপ, শুভেন্দু, লকেট, সুকান্তরা ঘুরেছেন প্রচুর, তেমন সাড়া মেলেনি। প্রস্তুতি কিন্তু ছিল, একটা ফোন নম্বর ভাইরাল করা হয়েছিল, কোথাও বাধা পেলেই আমাদের জানান। কোনও বাধা আসেনি, একটা ফোনও আসেনি, একটা ফোন এলেই তিলকে তাল করার প্রস্তুতি তো ছিলই, কিন্তু তিলও জোটেনি, তালও পাকেনি। এবং বাড়িতে না বসে মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূল দলের নেতারা সারা রাজ্যেই সংহতি দিবস পালনে নেমেছিলেন। ওই যে বললাম মাঝমাঠ কেবল নয়, দুটো উইং আর গোলপোস্টেও দারুণ খেলেছে তৃণমূল, সেটাও একটা কারণ ওই রামমন্দিরের উন্মাদনা এ রাজ্যে দেখাই গেল না। প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু ডাহা ফেল করলেন শুভেন্দু, দিলীপ, লকেট সুকান্তরা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশ জুড়ে না হলেও অন্তত উত্তর ভারত গোবলয় জুড়ে রামমন্দির নিয়ে যে উন্মাদনা দেখা গেল, তা এই বাংলায় ছিলই না, এর সম্ভাব্য কারণ কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
গতকাল বাংলার মানুষের মধ্যের ধর্ম নিরপেক্ষতার এক নতুন ছবি দেখা গেল। চারিদিকে হাজার প্ররোচনা ছিল, একটা স্ফুলিঙ্গের জন্য অপেক্ষা করছিল অনেক শকুন, কিন্তু সারা বাংলার মানুষ আস্থা রাখল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। সারা বাংলা এক সঙ্গেই কাল গেয়েছে রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিত পাবন সীতারাম, ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম, সবকো সন্মতি দে ভগবান।