সদ্য নতুন কাক হওয়া আর পুরনো দাঁড়কাকের মধ্যে তফাৎ থাকাটা স্বাভাবিক, তারচেয়েও স্বাভাবিক একে অন্যকে দেখে খচে যাওয়া, কারণে অকারণে তেড়ে যাওয়া। এ বঙ্গ বিজেপির দিলীপ ঘোষ আর শুভেন্দু অধিকারীকে দেখলে আমার ঠিক সেটাই মনে হয়। সিপিএম জালমানা শেষ হয়েছে ২০১১-তে, ২০১৪-তেই দিল্লি দখল করেছেন মোদিজি। এদিকে ৩৪ বছরের ইট চুন সুড়কি পাথরের মৌরুসিপাট্টা, ভোট দেওয়ার অপরাধে হাত কেটে নেওয়া, মেসোমশাই এলসিএস ডেকেছে শুনলে ইয়ে টিয়ে ভুলে ছুটতে হয়েছে লোকাল কমিটি দফতরে, তো সে জমানা গেলে খানিক উলটো চাপ হবে বইকী, মাইকে বদলা নয় বদল চাই গোত্রের রামধুন চললেও হবে, হচ্ছিল। এবং সেই সময়ে সেই হাতে মাথাকাটা এলসিএস, এলসিএম, ডিসিএম কমরেডরা কেটে পড়েছেন, অনেকেই আম্মো আর পলিটিক্সে নেই, কেউ কেউ বাজারে চড় থাপ্পড় খাওয়ার আগেই ১০০ কিলোমিটার দূরে ভায়রাভাইয়ের ঘরে বসে, আমি তো এটা জানতাম, এরকমই তো হবেই ইত্যাদি কপচাচ্ছেন। কিন্তু পাড়ার হবা গবা রামা শ্যামারা, যারা পোস্টার লিখত, মিছিল করত, তারা ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে সারেন্ডার করেছে আর এক বড় অংশ গিয়ে শেল্টার নিয়েছে বিজেপির ছাতার তলায়। ঘটনাচক্রে তখন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলু ঘোষ। ৩৪ বছরের রাজত্ব থেকে উৎখাত হওয়া সিপিএম ক্যাডার, সমর্থক ভোটারের দল আগে রাম পরে বাম ফর্মুলা মেনে বিজেপিকে ভোট দিলেন, মনে অসম্ভব ঘৃণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য, তেনাকে হারানোর জন্য বিজেপিই সই। কিন্তু সেই ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ের মতো বিজেপির সেই হঠাৎ উত্থান দিলু ঘোষের কৃতিত্ব হয়ে দাঁড়াল। ২ থেকে ১৮টা আসন ২০১৯-এর লোকসভায়। দিল্লির আহাম্মক বিজেপি নেতারা ভাবলেন দেওয়াল নড়ছে, এক ধাক্কা আউর দো, তাই দল ভাঙিয়ে আনলেন খোকাবাবুকে। আর সেই থেকে নতুন কাক আর পাড়ার পুরনো দাঁড়কাকের লড়াইয়ের মতো শুভেন্দু আর দিলু ঘোষের লড়াই থামার আর নাম নেয় না। সেটাই বিষয় আজকে, দিলীপ আসছে, শুভেন্দু কাঁপছে।
এমনিতে দিলু ঘোষের সাদা মনে কাদা নেই, দুমদাম কথা বলেন, চিরকুমার কি না তা বলা তো সম্ভব নয়, তবে অবিবাহিত বটে। শুভেন্দু অধিকারী এবং আরও কিছু নৌটঙ্কিবাজদের দলে ঢুকতে দেখে তিনি ভেবেছিলেন তাঁর আসনে নজর দেবার ক্ষমতা এই দলবদলুদের নেই। ওদিকে রাজনীতি করা ইস্তক এই চেয়ারের খেলাটা ভালো করে শিখেছেন আমাদের টাচ মি নট খোকাবাবু, দলের মধ্যে দল করা, সময়মতো চোট দেওয়া, এসব তেনার বাঁয়ে হাত কা খেল।
আরও পড়ুন: Aake | অক্সফোর্ডে যাচ্ছেন মমতা, আপনাদের এত চুলকোচ্ছে কেন কমরেড?
কাজেই দলে ঢোকার পর থেকে সব থেকে প্রভাবশালী দিলু ঘোষের পিছনে লেগে গেল তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের গোষ্ঠী, এবং সেই লড়াই রাবণের চিতার মতো, তা নেভে না, এনাদের কলহ থামে না। এক সঙ্গে হাত মেলালেন, খেলেন, উঠে ক্যামেরা মাইকের সামনে বলে দিলেন উনি এটা ঠিক করেননি। ক’দিন আগেই শুভেন্দু ক্ষমতায় আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে জিতে আসা মুসলমান বিধায়কদের ‘চ্যাংদোলা’ করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলার দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, সে মন্তব্যে উত্তপ্ত হয়েছে রাজ্য রাজনীতি। দিলীপ ঘোষ জানালেন, না এটা তো ঠিক নয়, এরকম বলা যায় না। যিনি বুদ্ধিজীবীদের রগড়ে দেব গোছের কথা বলেন তিনি হঠাৎ রাজনৈতিক ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠলেন। কিন্তু সমস্যা আরও গভীরে, দিল্লির নেতারা এমনকী আরএসএস-এর মধ্যেও এক বিরাট অংশের সমর্থনে দিলু ঘোষ আবার হবেন সভাপতি, আর ঠিক এই খবরেই শুভেন্দুর মেজাজ খারাপ, শোনা গেছে ওনার মাইনে করা দুই ইউটিউবারদের কথায় কথায় বলেছেন এরকমটা চলতে থাকলে উনি নাকি সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন। দিল্লিতে সুকান্তবাবুর ডেরাতে বসেছিল বৈঠক সেখানে নাকি দিলু ঘোষের নাম সাজেস্ট করেছিলেন এক দিল্লির নেতা, যিনি সংগঠন দেখেন, তিনি দিলু ঘোষের নাম করতেই বেজায় অখুশি আমাদের টাচ মি নট খোকাবাবু নাকি বলেছেন তাহলে ২০২৬-এও সম্ভব হবে না। এদিকে আরএসএস-এর যিনি বাংলার সংগঠনের দায়িত্বে তিনি বলেছেন, এমনিতে ২০২৬-এ খুব বিরাট সম্ভাবনা আছে বলে তাঁরা মনে করছেন না কিন্তু দিলু ঘোষকে সামনে রেখে যেটুকু লড়াই দেওয়া যাবে, যা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। শোনা যাচ্ছে এই পদের আর একজন স্ট্রং দাবিদার নাকি দু’ পক্ষের লোকজনদের তাতাচ্ছেন, যাতে পাকা ফলটা তাঁর পাতে এসে পড়ে। সবমিলিয়ে বসন্ত শেষে আমরা নির্ভেজাল সার্কাস দেখছি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে বঙ্গ বিজেপির বৈঠক আপাতত কলতলার ঝগড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তারা একজন সভাপতিকে বেছে উঠতে পারলেন না, সেই একে অন্যের সঙ্গে চুলোচুলিতে ব্যস্ত বিজেপি কি কোনও ভাবেই তৃণমূলের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে পারবে? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
বাংলাতে বিজেপির সব চেয়ে বড় সমস্যা হল এখানকার মাটি। আজন্ম সেই মাটিতে লালন রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ চাষ করেছেন, সার দিয়েছেন, এ মাটিতে সোনা গলে ঘৃণা ফলে না, আর ঠিক তাই শুভেন্দুই আসুন বা দিলু ঘোষ বা ফাঁকতালে শমীক ভট্টাচার্য, কেউই খুব একটা কিছু করে উঠতে পারবেন না আর যেটুকু সম্ভাবনা তাঁদের ছিল তা শেষ হয়ে গেছে ওই ২০২১-এই। খেয়াল করুন তারপর থেকে নির্বাচনের পর নির্বাচন বিজেপির ভোট কমছে, আসন কমছে, বামেরা সামান্য বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পেলে বিজেপি আবার তার ১২ শতাংশ ভোট আর এক দুখানা আসনে ফিরে যাবে। কিন্তু তখনও ডাডা অনুগামীদের পোস্টে লেখা হবে ডাডা আসছে দিলু কাঁপছে, দিলীপ আসছে শুভেন্দু কাঁপছে। এ লড়াই ক্ষমতার লড়াই খুব তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার নয়।