রাজনীতি শিখেছেন মমতার কাছে, কিন্তু প্রথম পাঠ নেওয়ার সময়ে যা বারবার বলেছিলেন উনি, তা ভুলে মেরেছেন। মমতার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনকে এক একজন এক একদিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি ওয়ান ডায়মেনশনাল তো নন, একরৈখিক নন, বহু ধরনের আপাত স্ববিরোধিতা আছে। গণতন্ত্রের এক প্রবল চাহিদা তাঁর আছে আবার তার সঙ্গে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক আচরণও আছে। এবং এমন স্ববিরোধিতা বোধহয় সবারই থাকে। অমন যে অমন নেহরু, তিনি রে রে করে ভিড়ের মধ্যে এক ব্যক্তির গায়ে হাত তুলেছিলেন, সেই লোকটি গান্ধীজি সম্পর্কে কটূক্তি করেছিলেন, উপস্থিত মানুষজন নেহরুকে সরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু আদতে নেহরু রগচটা ছিলেন না, ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ ছিলেন। তো যেকথা বলছিলাম, রাজনীতির যে সবচেয়ে বড় পাঠ মমতা শিখেছেন, প্র্যাকটিস করেছেন তা হল ধৈর্য, লেগে থাকা। অন্যান্য নেতারা যখন হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন, তিনি তখন আরও বেশি করে সেটাই করছেন, করেছেন যা তাঁকে বহু পরে ডিভিডেন্ড দিয়েছে। তো সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজনীতির পাঠ নেওয়ার সময়ে শুভেন্দু এই পাঠটি সম্পূর্ণ করেননি। করেননি বলেই বারবার শর্টকাট রাস্তায় নেমে পড়ছেন এবং ঝোলাচ্ছেন। সন্দেশখালিই প্রথম নয়, তিনি ঢুকেছিলেন বিজেপিতে ২০২১ বিধানসভার আগে। বিজেপি নেতৃত্বকে বুঝিয়েছিলেন মমতাকে আক্রমণ করতে হবে, কেবল মমতা। সেদিন দলের অন্য নেতারা, দিলীপ ঘোষ ইত্যাদিরা নেতৃত্বকে বোঝাচ্ছিলেন ইস্যু সর্বত্র এক নয়। কিন্তু নেতৃত্ব বিশ্বাস করেছিল এই শর্টকার্ট পদ্ধতিতে, মমতাকে তৃণমূলের অন্য নেতৃত্বের থেকে বিচ্ছিন্ন করো, যদি পুরো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও আসে, তাহলেও তৃণমূল ভেঙে সরকার তৈরি হবে। পুরো ক্যাম্পেনটা হয়েছিল এক শর্টকার্ট ফরমুলায়, মমতা আর ভাইপো। ফল হাতেনাতে, রাজনৈতিক, ধার্মিক মেরুকরণের ফলে ভোট জমা হল তৃণমূলের বাক্সে, বিজেপি ৭৭-এই থামল। এরপরেও শুভেন্দু তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশ বাদ দিয়ে রাজনীতিতে নামতে পারেননি, তিনি যা বলছেন সবই দিদিমণি আর ভাইপো। যেন এটাও আবার বিধানসভার লড়াই হচ্ছে। সেটা করতে গিয়েই সন্দেশখালি, আবার শর্টকাট, এবং এবার আরও বিরাটভাবে ল্যাজেগোবরে। সেটাই বিষয় আজকে, সন্দেশ এবার শুভেন্দুর গলায় আটকেছে।
সন্দেশখালিতে আন্দোলনের ইস্যু ছিল না? অমিত শাহ ভরা জনসভাতে জিজ্ঞেস করেছেন, সন্দেশখালিতে কি কিছুই হয়নি? হয়েছে তো। আফটার অল রাজ্যের পুলিশই তো শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতারও করেছে, তার এগেনস্টে নন বেলেবল অফেন্স-এর ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছে। করেছে তো, হ্যাঁ বহু আগেই করা উচিত ছিল, এবং তৃণমূলের মধ্যে এখনও এমন অনেক শেখ শাহজাহান, উত্তম সর্দারেরা আছেন, তাঁদের চিহ্নিত করা উচিত কিন্তু সেকথা বলছেন কে? অমিত শাহ? কোন মুখে? যাঁরা ওই ব্রিজভূষণ সিংয়ের ছেলেকে টিকিট দেন? যাঁরা প্রোজ্জ্বল রেভন্নার মাথায় হাত রাখেন, তাঁরা জিজ্ঞেস করছেন, সন্দেশখালিতে কিছু হয়েছে কি না?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদি সরকার এবার সরকারি দলিল সামনে রেখেই হিন্দু-মুসলমান বিষ ছড়ানোর ব্যবস্থা করল
আচ্ছা এই স্টিং অপারেশন তো অনেকদিন হয়ে গেছে, তার ভিডিও, তারপরে আরও বেশ ক’টা ভিডিও বাজারে হাজির, একবারও আমাদের অমিত শাহ বা নরেন্দ্র মোদিকে দেখছেন তার বিরোধিতা করতে? করতে পারছেন না বলে বলছেন কিছুই কি হয়নি? আসলে শুভেন্দু যে ডুবিয়েছেন তা আবার তাঁরা বুঝে গেছেন, কিন্তু এখন কোর্স কারেকশনেরও তেমন সময় নেই। লাগাতার ওই জমি কেড়ে নেওয়া, জোর করে নোনা জল ঢুকিয়ে ভেড়ি তৈরি করা ইত্যাদি অভিযোগগুলো নিয়ে মাঠে নামলে ফল হত বইকী, কিন্তু মাথা পিছু ২০০০ টাকা, মদের খরচ আর অস্ত্রশস্ত্র জুগিয়ে যে শর্টকাট প্রসেসে শুভেন্দু অধিকারী দলকে নিয়ে গেলেন তা ব্যাকফায়ার করতই, করেছেও। এখন সবটাই প্রশ্নের মুখে। সারা দেশের মানুষ জেনে গেছেন যে সন্দেশখালির গণধর্ষণ ইত্যাদির অভিযোগ আসলে বানানো, টাকা দিয়ে বানানো। তৃণমূল নিশ্চিত তার ফায়দা নেবে, নিচ্ছেও। শুভেন্দু অধৈর্য হয়ে শর্টকাট পদ্ধতিতে এক রোমহর্ষক ন্যারেটিভ তৈরি করতে গিয়ে দলকে ডুবিয়েছেন, নিজেও ডুবেছেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে সন্দেশখালির ঘটনা কি বিজেপির ক্ষেত্রে ব্যাকফায়ার করল? আর সেটার জন্য কি শুভেন্দু অধিকারীই দায়ী? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
এখনও দলটার নাম ভারতীয় জনতা পার্টি। পাকিস্তানে গিয়ে একটা লুজ বল খেলেছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি, বলেছিলেন জিন্না একজন ধর্মনিরপেক্ষ নেতা ছিলেন, ফিরে আসার পর থেকে তিনি দলের মধ্যে ব্রাত্য হয়েছেন এখন তো স্মৃতির ওপারে। শুভেন্দুর বিধানসভার সময়ে ভুলকে অতি উৎসাহী এক নেতার কাজ কারবার বলেই মনে করেছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব, তারপরে মাঝেমধ্যেই বোমা পড়বে গোছের কথাবার্তার পরে তাঁকে ডেকে সাবধানও করা হয়েছে বলে শোনা গেছে। এবারে এই সন্দেশখালি ইস্যুকে অর্থহীন ভাবে জটিল করে তৃণমূলের সুবিধে সত্যিই হয়ে গেলে নির্বাচনের পর শান্তিকুঞ্জে আরও অনেক অশান্তি লেখা রয়েছে।