সব্বার ফাঁসি চাই, যতজন আমার মেয়ের খুনের সঙ্গে জড়িত আছে সব্বার ফাঁসি চাই, বলেছিলেন তিলোত্তমার মা। গতকাল আদালতে গিয়ে তিলোত্তমার বাবা-মা বললেন, সব মানিক খোয়া গেছে, সব প্রমাণ হারিয়ে গেছে, তাই যা বেঁচে আছে সেই প্রমাণকে খোয়াতে রাজি নই, তাই সঞ্জয়ের ফাঁসি চাই না। তার আগেই মিডিয়াকে বলেছেন আমরা জানি এক মৃত্যু সেই পরিবারের কাছে কতটা বেদনাদায়ক, তাই আমরা সঞ্জয়ের ফাঁসি চাই না। বিচারের দিন বলেছিলেন আমরা সর্বোচ্চ সাজা চাই। আমাদের দেশে সর্বোচ্চ সাজা তো ফাঁসি। মাত্র ক’দিনের মধ্যেই এত ধরনের স্টেট্মেন্ট কেন? এত স্ববিরোধিতা কেন? সেই শুরুর দিনগুলোর কথা ভাবুন, উত্তাল কলকাতা, তাঁরা সকাল হচ্ছে, কিছু মুখে দিয়ে বা না দিয়েই বেরিয়ে পড়ছেন। সেই মিছিল মিটিংয়ের মধ্যমণি তাঁরা চেয়ে দেখছেন কত মানুষ, কত ছেলেপুলে, তাদের যে কেউ হতেই পারত তাঁদের কন্যা, তাঁরা সেই ভিড়ে স্বস্তি পাচ্ছিলেন, সান্ত্বনা পাচ্ছিলেন, সেই ভিড় তাঁদেরকে আশ্বাস জোগাচ্ছিল। কিন্তু সেদিনেও তাঁদের মধ্যে কি অসংলগ্নতা ছিল না? ছিল বইকী। মুখ্যমন্ত্রী গেলেন, দেখা করে বেরিয়ে এলেন, সেদিন ক্যামেরার সামনে তাঁরাই বলেছিলেন পুলিশ তদন্ত করছে আমাদের ভরসা আছে, মুখ্যমন্ত্রী দোষীদের শাস্তি দেবেন বলেছেন। কবের কথা? মাত্র ১১ তারিখ মুখ্যমন্ত্রী গেছেন মৃতার বাড়িতে, সেদিনও বলেছেন এই কথা। বলেননি যে দেহ জোর করে পোড়ানো হয়েছে, বলেননি যে আমরা দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেমের দাবি করেছিলাম, বলেননি যে একজন পুলিশকর্তা আমাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য টাকা দিতে চেয়েছেন, বরং বলেছেন কলকাতা পুলিশ ভালো কাজ করছে, মুখ্যমন্ত্রীর উপরে আমাদের ভরসা আছে। কিন্তু মাত্র ক’দিনেই ওনারা ওনাদের স্ট্যান্ড পাল্টালেন। বিকাশ ভট্টাচার্য হাইকোর্টে গিয়ে জানালেন যে উনি এক্কেবারে ঘোড়ার মুখ থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কথা জেনেছেন, যা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মি লর্ড, এই ঘটনা একজন ঘটাতেই পারে না, কলকাতা পুলিশ একজনকে ধরে সব ধামাচাপা দিতে চাইছে। ব্যস, ওমনি মি লর্ড ওই বিশাল যুক্তি শুনেই সিবিআই তদন্ত দিয়ে দিলেন আর বিকাশবাবু হয়ে উঠলেন ওই নির্যাতিতার মা-বাবার পক্ষের আইনজীবী। সেইটাই ছিল স্ববিরোধী অসংলগ্ন বিবৃতি দেওয়ার শুরুয়াত। আজ সেটাই বিষয় আজকে, অভয়ার মা-বাবা নিজেদের হাসির খোরাক করে তুলছেন কেন?
কতটা অসংলগ্ন, স্ববিরোধী কথা বললে এই ক’দিন আগে ঘটে যাওয়া এমন মর্মান্তিক ঘটনার পরে সামাজিক মাধ্যমে মৃতার বাবা-মাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে? সংবেদনশীল যে কোনও ব্যাপারেই রাজনীতির বড় নেতারা খুব সামলে কথা বলেন, বিশেষ করে এমন জঘন্য ধর্ষণ আর খুনের পরে তো আরও সাবধানী হয়ে যান শাসকদলের নেতারা, কেন তাঁরা এখন অনায়াসেই মুখ খুলছেন। আসলে শোকের আবহ ছিঁড়েখুঁড়েই তিলোত্তমার বাবা-মা যা করছেন তা বিশুদ্ধ রাজনীতিই হয়ে উঠছে। এবং সেটাও যদি এক খাতে বইত তাহলেও না হয় বোঝা যেত, ছাত্রনেতা আনিস খানের বাবা কোনও স্ববিরোধিতায় না গিয়ে তাঁর ছেলের মৃত্যুর বিচার চেয়েছেন, শুরুর দিন থেকে ভুল হোক ঠিক হোক এক কথা বলে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দুর মাথায় ঝুলছে খাঁড়া, দল ছাড়বেন নাকি?
আর এই লক্ষ মানুষের সমর্থন পাওয়ার পরেও, সারা দেশ বিদেশ থেকে সমর্থন পাওয়ার পরেও তিলোত্তমার বাবা-মা তাঁদের অসংলগ্ন আচরণের ফলে হাসির খোরাক হয়ে উঠছেন। ৯ তারিখ রাতে আপনাকে এক পুলিশ অফিসার টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখার কথা বললেন। আপনি সেটা কবে বললেন সংবাদমাধ্যমকে? ইন ফ্যাক্ট আপনিও বলেননি, বলেছিলেন ডাক্তার আন্দোলনকারীরা, আপনি ভিডিও বিবৃতি দিয়ে জানালেন যে না এমন কিছু হয়নি। পরে বলেছেন যে তাঁকে চাপ দিয়ে এই কথা বলানো হয়েছে। কিন্তু ১৫ তারিখ, ১৫ অগাস্ট আপনিই যখন সিবিআই-এর কাছে গেলেন, তখন কি সিবিআইকেও সেটা বললেন? কারণ এ তো বিরাট অভিযোগ, যে টাকা দিয়ে আপনার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। না, আপনার দেওয়া বয়ানে ১৫ অগাস্ট সেরকম কোনও কথা নেই, তার পরের বয়ানেও নেই, কিন্তু আপনি বাইরে সে কথা বলে গেছেন সিবিআইকে জানাননি, জানালে একজন এসপি-কে কেবল এটা করার দায়েই জেরা করা হত, গ্রেফতারও করা যেত। ধরুন আজ যে কথা জনে জনে বলে বেড়াচ্ছেন যে আপনারা দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেম চেয়েছিলেন, প্রথম পোস্টমর্টেমের পরে আপনারা সেই সময়েই জানিয়েছিলেন? উল্টে আপনার কন্যাসম ৫ জন পিজিটি ছাত্রী যাঁরা সেদিন পোস্টমর্টেমে হাজির ছিল, তাঁরা লিখে দিলেন যে তাঁরা স্যাটিসফায়েড। আপনারা কেন দ্বিতীয়বার পোস্ট মর্টেম চাইছিলেন? চাইছিলেন, সে কথা আপনারা টালা থানায় বলেছিলেন? সেদিন রাতে আপনাদের বাড়িতে ৪০ মিনিটের বেশি তিলোত্তমার দেহ রাখা ছিল, জানিয়েছিলেন কাউকে যে আপনারা দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেম চান? জানাননি। দেহ পোড়ান হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী এলেন, সংবাদমাধ্যমের লোকজন এল, জানিয়েছিলেন যে আপনারা দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেম চেয়েছিলেন পুলিশ তা হতে দেয়নি। মামলা সিবিআই-এর কাছে চলে গেল, ১৫ অগাস্ট বয়ান দিতে গেলেন, জানিয়েছিলেন যে আপনারা দ্বিতীয়বারের জন্য পোস্টমর্টেমের দাবি করেছিলেন। করেননি। তারও তিনদিন পরে আপনি প্রথমবার সিবিআই-এর সামনে এবং তারপরে সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রথমবার জানালেন যে আপনারা দ্বিতীয়বারের জন্য পোস্টমর্টেম চেয়েছেন। কেন? কোন তথ্য জানার পরে আপনারা এই সিদ্ধান্তে এলেন? জানিয়েছেন? আজ অবধি জানাননি। এই সবের শুরুয়াত সেই হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে বিকাশবাবুর বয়ান, তাঁকে আরজি করের পোস্টপর্টেমের দায়িত্বে থাকা ডাক্তারবাবুই নাকি জানিয়েছেন যে সেই পোস্টমর্টেম দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে একজন নয় অনেকে মিলে ধর্ষণ করেছিল এই নির্যাতিতাকে। তাহলে পোস্টমর্টেম ঠিকই ছিল? এবং দেশের সবথেকে অভিজ্ঞ সংস্থার এক ডাক্তারদের বোর্ড এই পোস্টমর্টেমের প্রতিটা তথ্য দেখেই জানিয়েছে এই ধর্ষণ এবং হত্যা একজনেরই কাজ। পোস্টমর্টেমের ব্যাপারে কার কথা আমরা বিশ্বাস করব? একজন আইনজীবীর? না অভিজ্ঞ ডাক্তারদের এক বোর্ডের? সেই বিকাশবাবুও নাকি আপনাদের কন্যার মামলা হ্যান্ডল করতে পারছিলেন না। কী করে বুঝলেন? আপনাদের আইনের পাঠ আছে? তিনি বিনা পয়সায় আপনাদের মামলা লড়তে এসেছিলেন, তাঁকে মুখেও নয়, হোয়াটসঅ্যাপে জানানো হল যে আপনাকে আর দরকার নেই। তিনি সরে গেলেন, এলেন বৃন্দা গ্রোভার। এখন আপনারা বলছেন এই মামলা শেষ হলে আপনারা বৃন্দা গ্রোভারকে নাকি আইন শেখাবেন? ভাবা যায়? ওই মাপের একজন আইনজীবী একজন অ্যাকটিভিস্ট, যিনি বিনা পয়সাতে মামলা লড়তে এলেন, তাঁকে আপনারা আইন শেখাবেন? কলকাতা পুলিশের হাত থেকে মামলা সিবিআই-এর কাছে এল, আপনারা স্বাগত জানালেন। এখন বলছেন সিবিআই কিছুই করেনি, আবার তদন্ত চাইছেন, কে করবে সেই তদন্ত? এক জায়গাতে শুনলাম বলেছেন যে সেই তদন্ত একজন বিচারপতি করবেন, বিচারপতি তদন্ত করেন না, বিচারালয়ের দেখরেখে তদন্ত হয়। এই গোটা তদন্ত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে। কী চাইছেন আপনারা? এবারে মুখ্যমন্ত্রীকে নির্লজ্জ বলছেন, বলছেন তিনিই নাকি প্রমাণ লোপাট করিয়েছেন। কোন তথ্যের ভিত্তিতে বলছেন? মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইছেন? কিসের ভিত্তিতে চাইছেন? আপনাদের এই অসংলগ্ন কথা আপনাদের জন্য মানুষের সহানূভুতির অপরিসীম ভাঁড়ার ক’দিনের মধ্যেই শূন্য হয়ে যাবে, আপনাদের ব্যবহার করা হচ্ছে, আপনারা ব্যবহৃত হচ্ছেন, আপনাদের সেই পোটেনশিয়াল নেই, যা আপনাদের এক দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা ধরে রাখবে। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবহৃত ঠোঙার মতো পড়ে থাকবেন। যে পড়শিরা ছুটে এসেছিল দুর্দিনে, তাঁদেরকে আঘাত করেছেন, যে মানুষেরা সমব্যথী ছিলেন, তাঁদের বিশ্বাস চলে যাচ্ছে, অথচ এটা তো সত্যিই যে সন্তান হারানোর বোঝা এনাদের দুজনের কাঁধেই রয়েছে, এক নরক যন্ত্রণা। আমরা আজ আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, নির্যাতিতার বাবা-মা এই ধর্ষণ খুনের প্রমাণ লোপাটের জন্য দায়ী করে তাঁর পদত্যাগ চেয়েছেন, আপনারা আপনাদের মতামত জানান। শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
জীবনের কোনও দুঃখ, কোনও শোক চিরস্থায়ী নয়, আনন্দ ঘুরে ফিরে আসে, সব শোকের পলিমাটি ধুয়ে দিয়ে চলে যায়, এটাই জীবনের নিয়ম। সমস্ত নিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কেউ শোককে আঁকড়ে ধরেই চলতে চান, কিন্তু তা এক অসংলগ্নতার জন্ম দেয়। শোকের অনুভূতি ভাগ করে নিতে বহু মানুষই এগিয়ে আসে, কিন্তু এই অসংলগ্নতার জন্য দায়ী থাকেন তাঁরাই, তার ভাগাভাগি হয় না। আমাদের শাস্ত্র মানুষকে স্থির হতে বলে, ধৈর্য হারাতে মানা করে, শোকের মধ্যেও নিজের বোধবুদ্ধির বিসর্জনের ব্যাপারে সতর্ক করে। যদি অন্যায় হয়ে থাকে তার প্রতিবাদ হোক না, কিন্তু এই অসংলগ্নতা এই স্ববিরোধিতা কাটিয়ে বেরিয়ে আসুন নির্যাতিতার বাবা-মা, এটা আমার নয়, আমাদের প্রার্থনা।