এমনিতে আমরা সব্বাই জানি যে রেলের নতুন যা কিছু, সে ট্রেন হোক আর স্টেশন, উদ্বোধন তো করবেন ওই নরেন্দ্র মোদিজি। কিন্তু দফতরের মন্ত্রীকেই হ্যাপা সামলাতে হবে, সেটাও জানা। মোদিজি দুর্ঘটনা নিয়ে একটা দুঃখপ্রকশের টুইট করেছেন, ব্যস। কিন্তু কেন এই দুর্ঘটনা তা নিয়ে কিছু তো বলতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য সোজা একটা ব্যাপার আছে, যেহেতু একজন পাইলট মৃত, তাঁর ঘাড়ে সব দোষ ঠেলে দিলেই ল্যাটা চোকে, বিষয়টা সেদিকেই গড়াচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের এই দুর্ঘটনা উসকে দিয়েছে এক বছর আগের ৩ জুনে করমণ্ডল দুর্ঘটনার স্মৃতি। সেই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ২৯৬ জন। আহত হয়েছিলেন প্রায় ১২০০ জন। বালেশ্বরের বাহানাগা বাজারের কাছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস, বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস এবং একটি মালগাড়ির সংঘর্ষ হয়েছিল। সংঘর্ষের তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। ওই দুর্ঘনায় মৃতদের মধ্যে অনেকেরই নাকি পরিচয় জানা যায়নি আজও। সোমবারের কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাও একই রকম ভাবে হয়েছে। এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ির সংঘর্ষ, মালগাড়ির উপর উঠে যাওয়া এক্সপ্রেসের কামরা— দুই ঘটনার মিল বেশ কিছু ক্ষেত্রেই। সে সময়েও দুর্ঘটনার পর যা যা প্রশ্ন উঠেছিল, এ বারও অনেকাংশে সেই প্রশ্নই উঠছে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। একই সঙ্গে এই দুর্ঘটনার দায় কার, তা নিয়েও শুরু হয়েছে তরজা। কিন্তু সেই সময় ভয়াবহতার যে ‘ছবি’ সামনে এসেছিল, এ বার তা খানিকটা পাল্টেছে। হতাহতের পরিমাণ সে বারের তুলনায় অনেকটাই কম। মনে করা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। তবে ট্রেনের গতি কম থাকার কারণেই তা এড়ানো গিয়েছে। কিন্তু হতেই পারত তারচেয়েও বড় এক দুর্ঘটনা। আরেকটা ছবিও একই রকম তা হল উদ্ধারকার্য, রেলের যেন কোনও দায়ই নেই, স্থানীয় মানুষেরা হাত লাগানোর ঘণ্টাদুয়েক পরে এসেছে রেলের সাহায্য। সব মিলিয়ে একটা প্রশ্নের তো জবাব সব্বাই খুঁজছেন, বারবার ঘটতে থাকা এমন দুর্ঘটনার কারণ কী? সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কেন ঘটেছিল ওই দুর্ঘটনা? কারা দায়ী।
প্রথমেই সবথেকে সহজ উত্তর বেছে নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। যিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁর উপরেই সমস্ত দোষ চাপানোর চেষ্টা চলছে। অনুমতি না থাকার পরেও তিনি সিগনাল ভেঙে কীভাবে গাড়ি চালালেন। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশাপাশি মালগাড়ির চালককেও ‘টিএ ৯১২’ ফর্ম দেওয়া হয়েছিল। সেই ফর্মে উল্লেখ ছিল কোন কোন সিগন্যাল ‘ভাঙতে’ পারবেন চালক। এমনকী, কোথা থেকে কোন অবধি এই ‘অনুমতি’ বহাল থাকবে, তারও উল্লেখ ছিল। মালগাড়ির চালক ও গার্ডের কাছেও ছিল সেই ছাড়পত্র। সাধারণত, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ হয়ে গেলে ওই নির্দেশের ভিত্তিতেই ট্রেন চালিয়ে থাকেন চালক। সিগন্যাল লাল থাকলেও নিয়ন্ত্রিত গতিতে ট্রেন চালাতে পারেন তিনি।
আরও পড়ুন: Aajke | আমাদের রাজ্যপাল, শুভেন্দু অধিকারী আর নির্যাতিতদের নিয়ে দুটো কথা
সোমবার সকালের দুর্ঘটনার পর যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, কাগুজে সিগন্যাল পেয়েও নিয়ম মানেননি মালগাড়ির চালক? সেই প্রশ্নের উত্তর এখন আমাদের কাছে। এই যে সেই অনুমতিপত্র, সেটা নিয়েই ট্রেন চালাচ্ছিলেন তিনি। মালগাড়ির চালকের কাছেও ছিল কাগুজে অনুমতি। রেলের পরিভাষায় যাকে বলে ‘পেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিট’ (পিএলসিটি)! রেল সূত্রে খবর, সোমবার ভোর থেকেই রাঙাপানি এবং চটের হাট অংশে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা বিকল। ওই অংশে তাই ট্রেন চলাচল হচ্ছিল কাগুজে সিগন্যালে। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল অকেজো হওয়ায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং মালগাড়ি, দুই ট্রেনের চালক এবং গার্ডকেই কাগুজে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশন মাস্টারই ওই কাগুজে অনুমতি দিয়েছিলেন। রাঙাপানি থেকে চটের হাট পর্যন্ত মোট ৯টি লাল সিগন্যাল ‘ভাঙা’র অনুমতি ছিল মালগাড়ির চালকের কাছে। মালগাড়ির চালক ও গার্ডকে স্টেশন মাস্টার অনুমতি দিয়েছিলেন, এ৫-৬৫৪, এ৫-৬৫২, এ৫-৬৫০, এ৫-৬৪৮, এ৫-৬৪৬, এ৫-৬৪৪, এ৫-৬৪২, এ৫-৬৪০ আর এ৫-৬৩৮ সিগন্যাল ‘ভাঙা’ যাবে। অনুমতিপত্রে যথারীতি লেখা ছিল, চালককে অবশ্যই নজর রাখতে হবে যাত্রাপথের লেভেলক্রসিং গেটের উপর। যদি গেট বন্ধ থাকে তবেই ট্রেন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন চালক। গেট খোলা থাকলে তার আগেই ট্রেনকে থামিয়ে দিতে হবে তাঁকে। নিয়ম অনুযায়ী, কাগুজে সিগন্যালে ট্রেন চালানোর সময় দিনের বেলা দৃশ্যমানতা ঠিক থাকলে প্রতি ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার গতিবেগে ট্রেন চালানো যায়। একই সঙ্গে আগের গাড়ির সঙ্গে অন্তত ১৫ মিনিটের দূরত্বে পরের গাড়িকে যেতে হবে। রাতের বেলা বা কুয়াশা থাকলে ওই গতি ১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় রাখতে হবে। এগুলো ওই পেপার পারমিশনে লেখা থাকে, আলাদা করে লিখতে হয় না। এ ক্ষেত্রে মালগাড়ির চালক সেই নিয়ম মেনেছিলেন কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু গাড়ির স্পিড যে যথেষ্ট কম ছিল তা রেলের লোকজনই জানিয়েছেন। যদিও রেলের তরফে এখনও স্পিকটি নট। এ নিয়ে সরকারিভাবে কিছু জানানো হয়নি। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব গতবাঁধা সুরেই জানিয়েছেন উদ্ধারকাজ এবং রেল পরিষেবা স্বাভাবিক করাই এই মুহূর্তে প্রাথমিক লক্ষ্য। বাকিটা তদন্তসাপেক্ষ। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখে ছিলাম, পরপর ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনাগুলোই কি বলে দিচ্ছে না ভারতের রেলপথ এখন বিচ্ছিরি রকমের অসুরক্ষিত, তার উপরে দ্রুতগামী ট্রেনের সাংখ্যা বাড়াতে গিয়ে কি আরও বড় বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে না? শুনুন দর্শক শ্রোতারা কী বলেছেন।
সোমবার ফাঁসিদেওয়ার রাঙাপানির কাছে, জালাস গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট নির্মল জোতের মানুষজনের দিন শুরু হয় আঁতকে ওঠা দিয়ে। সকাল পৌনে ৯টা নাগাদ কানফাটানো আওয়াজের পরে তাঁরা দেখেন, মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপরে উঠে গিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের একটি কামরা! ধাক্কায় প্রায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে আর একটি। যাত্রীদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল গ্রাম জুড়ে। ওই গ্রামের মানুষরাই উদ্ধারের কাজ শুরু করেন। মুসলিম অধ্যুষিত এই গ্রামের অনেকেরই বাড়িতে পড়ে থাকল কুরবানির পশু, পড়ে থাকল ইদ উদযাপনের ব্যবস্থা, তাঁরা বিপন্ন মানুষদের বাঁচাতে নামলেন, অনেকেই সারা দিন খাননি, আরেকবার সত্যটা উঠে এল সভ্যতার, এটাই মানবতা, এটাই ধর্ম।