সম্রাট আমলে দিল্লি থেকে ফতোয়া জারি করা হত, ফরমান জারি করা হত, নানান বিষয়ে, কখনও মন্দিরে ভেঙে ফেলার ফতোয়া তো কখনও মন্দির গড়ার জন্য নিষ্কর জমি দেওয়ার ফরমান। তারপরেও ইংরেজ শাসনেও দিল্লির ফরমান আসত, তাকে ফরমান বলা হত না, বলা হত ডিক্লারেশন, ঘোষণাপত্র। কালকে থেকে বাংলা আর এক থাকবে না, তাকে দু’ টুকরো করা হবে, এসব সরকারি ঘোষণা। এরপরে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কাজেই যা হবে সংসদেই হবে, সংসদে আনা বিল আইন হয়ে যাবে, তাকে মানতে হবে, এমনটাই চলে আসছিল। কিন্তু বিজেপি আমলে আবার সেই ফতোয়া আর ফরমান ফিরে এসেছে। মাঝেমধ্যেই সন্ধে, মাঝরাত কিংবা দুপুরবেলাতেও সরকারের মাথারা ওই ফতোয়া বা ফরমান জারি করছেন। তো এবারে নতুন নির্বাচিত দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্তার নয়া ফরমান এসেছে, দুর্গাপুজো করছেন করুন, সরকার হ্যানা দেবে ত্যানা দেবে, কিন্তু একটাই শর্ত, দেবীর পায়ের তলায় নরেন্দ্র মোদিকে রাখতে হবে। ইয়েস, মোদিজি দখল নেবেন অসুরের জায়গাটা, এমনই ইচ্ছে আমাদের দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর। কী কী দেবেন? শোনা গেল দিল্লির সরকার কিছু অনুদান দেবে, বিদ্যুতে কিছু সাহায্য করবে আর ওই সিকিউরিটির ব্যবস্থা ইত্যাদি করবে আর তার বদলে আমাদের অমন পুরুষালি বলশালী অসুরের জায়গাতে সর্বদা হাততালি দিয়ে কথা বলা নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি। ভেবেই শিহরিত আমি, কেবল জানতে চেয়েছিলাম। অত্যন্ত সরল সহজ প্রশ্ন ছিল আমার, ম্যাডাম মোদিজির গায়ের রংটাও কি তাহলে ওই সবুজ বা ছাই ছাই কালারের করা হবে? আমাকে বকা দিয়েছে, কাজেই নো প্রশ্ন কেবল আলোচনা, সেটাই বিষয় আজকে, মা দুর্গার পায়ের তলায় এবারে অসুরের বদলে মোদিজি?
ছোট্টবেলা থেকেই আমার দুর্গাপুজোর থেকেও মহালয়া বেশি ভালো লাগে। কেন? অতশত বুঝি না, ভালো লাগে ব্যস। আর সেই মহালয়ারও আবার সবটা নয়, ওই যে যেখানে দুর্গাকে নানান অস্ত্র শস্ত্র দিচ্ছেন দেবতারা, মুখস্থ আমার, দেবী সজ্জিতা হলেন অপূর্ব রণচণ্ডী মূর্তিতে। হিমাচল দিলেন সিংহবাহন, বিষ্ণু দিলেন চক্র, পিনাকপাণি শঙ্কর দিলেন শূল, যম দিলেন তাঁর দণ্ড, কালদেব সুতীক্ষ্ণ খড়্গ, চন্দ্র অষ্টচন্দ্র শোভা চর্ম দিলেন, ধনুর্বাণ দিলেন সূর্য, বিশ্বকর্মা অভেদ্যবর্ম, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা-কমণ্ডলু, কুবের রত্নহার। সব্বাই নানান অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে বললেন এবার এসো মা, ওই অসুরটাকে মারো দেখি, বড্ড বাড় বেড়েছে। অমনি রণদুন্দুভি ধ্বনিতে বিশ্বসংসার নিনাদিত হল। এবং তারপরের যে অংশটা সবচেয়ে ভালো লাগত সেটা হল ক্লাইম্যাক্স, দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরের প্রবল সংগ্রাম আরম্ভ হল। দেবীর অস্ত্রপ্রহারে দৈত্যসেনা ছিন্নভিন্ন হতে লাগল। মহিষাসুর ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন করে নানা কৌশল বিস্তার করলে। মহিষ থেকে হস্তীরূপ ধারণ করলে; আবার সিংহরূপী দৈত্যের রণোন্মত্ততা দেবী প্রশমিত করলেন। পুনরায় নয়নবিমোহন পুরুষবেশে আত্মপ্রকাশ করলে ওই ঐন্দ্রজালিক। দেবীর রূঢ় প্রত্যাখ্যান পেয়ে আবার মহিষমূর্তি গ্রহণ করলে।
রণবাদ্য দিকে দিগন্তরে নিনাদিত, চতুরঙ্গ নিয়ে অসুরেশ্বর দেবীকে পরাজিত করবার মানসে উল্লসিত। দেবীর বাহন সিংহরাজ দাবাগ্নির মত সমস্ত রণক্ষেত্রে শত্রুনিধনে দুর্নিবার হয়ে উঠল। নানাপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গা মধু পান করতে করতে মহিষরূপকে সদম্ভে বললেন,
“গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম্ ।
ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ ।। “
আরও পড়ুন: Aajke | শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে চাকরির পরীক্ষা তো দিলেন, তারপর?
মানে হল আমি মধু পান করছি, তারপর তোকে বধ করলে দেবতারা আনন্দ করবে। এবং দেবতাগণ সানন্দে দেখলেন, দুর্গা মহিষাসুরকে শূলে বিদ্ধ করেছেন আর খড়্গনিপাতে দৈত্যের মস্তক ভূলুণ্ঠিত। কোথায়? ওই যে মায়ের পায়ের কাছে, এবারে সেই জায়গাতেই থাকবে অসুরের জায়গাতে মোদিজির মাথা, এমনটাই জানিয়েছেন দিল্লির কর্তাব্যক্তিরা। ভেবেই আনন্দ লাগছে, এ তো এক নিশ্চিত সেটিং, সারা বাংলাতেও হোক, লাগু হোক এই ফরমান। অসুরের বদলে মোদিজির মাথা বা ত্রিশূল বিদ্ধ শরীর। এক নতুন থিমও হবে, সেই থিম বাংলার মানুষ দলে দলে দেখতে যাবে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এই রাজ্যে পুজো ক্লাবগুলোকে সাহায্য অনুদানের বদলে তাদের কিছু সরকারি প্রকল্পের ব্যানার পোস্টার টাঙানোর কথা বলা হয়, আর দিল্লিতে তার অর্ধেকের অর্ধেকের অর্ধেক অনুদান দেওয়ার পরে বলা হয়েছে যে টাকা তারাই পাবে, যারা দুর্গাপ্রতিমার পায়ের তলায় মোদিজির ছবি রাখবেন। এই ফতোয়া কি মানা যায়?
এই ফতোয়ার ফলে যে প্রশ্নগুলোর জন্ম হচ্ছে সেগুলো একটু বলি। এক) এর আগে কখনও কোনওদিনও কি দুর্গাপুজোতে মোদিজিকে অংশ নিতে দেখা গেছে? উনি তো নবরাত্রির উপোস করেন, উনি এই মাছ মাংস খেকো বাঙালি দেবীর পুজোতে সত্যিই কি অংশ নেবেন? দুই, দিল্লিতে কি এবারের মহানবমীতে আমিষ খাবারের অনুমতি থাকবে? নাকি গত বারের মতনই এবারেও বন্ধ থাকবে যাবতীয় আমিষ রেস্তরাঁ, মাছ মাংসের বাজার? তিন নম্বর আর জরুরি প্রশ্ন হল বাঙালিরা দুর্গাপুজো করলে বাংলাদেশি বলে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হবে না তো?