বাংলাদেশের এই গন্ডগোলের দিনগুলোতে সেই কবেকার দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। সেটাও ছিল এই অগাস্ট মাস। বাংলাদেশে রাজনৈতিক উথাল পাথাল চলছে। মুজিবুর রহমানের মাথায় ঘুরছে বাকসাল, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামি লিগ। সমস্ত দল মিশে যাবে একটা দলে, সেই দল সব বিভেদ মিটিয়ে গড়বে নতুন বাংলাদেশ, এক ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল অসন্তোষ, আওয়ামি লিগের কিছু নেতার দুর্নীতি মানুষের মধ্যে ক্ষোভের কারণ হচ্ছিল। অন্যদিকে জঙ্গি কমিউনিস্ট আন্দোলন শান্তিশৃঙ্খলার প্রশ্নটাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছিল, কাজেই লক আপ ডেথ, সিরাজ শিকদারকে খুন ইত্যাদির মতো ঘটনা ঘটছিল আর এসব চলতে চলতেই ১৪ অগাস্ট রাতে মুজিব সহ তাঁর পরিবারের প্রত্যেককে খুন করা হল। ৭৫ সালের সেই ঘটনার রেশ চলেছিল বহুদিন, একটা সুস্থির সরকার ছিল না বহুদিন। হ্যাঁ, সেই বছর কলকাতার বাজারে ইলিশ আসেনি, বাংলাদেশি ইলিশ আসেনি, আসার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তারপরে পরিস্থিতি যখন ঠিক হল তখন ইলিশ ছিল না পদ্মায় বা থাকলেও রফতানির মতো ইলিশ ছিল না, সে বছর মুজিবের মৃত্যুর বছর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ইলিশ খায়নি। হাওড়া মাছের হাটের এক মাছের ব্যবসায়ী যিনি বাংলাদেশ থেকে মাছ রফতানি করেন, তাঁর বাবার বিজনেস ছিল, এখন তিনি দেখেন। সেই তিনিই বলছিলেন আরেকটা অগাস্ট মাস এসে হাজির এবং এবারেও সম্ভবত বাংলাদেশের ইলিশ মাছ বাঙালির পাতে পড়বে না। আর সম্বৎসর এক পিস পদ্মার ইলিশ মাছ ভাজা, ভাজার তেল, এক পিস ভাপা আর এক পিস কেবল কালোজিরে সরষে দিয়ে খাব বলে যাঁরা বসে থাকেন, তাঁদের ক’জনেরই বা সেই ৭৫-এর অগাস্ট মাসের ইলিশের আকালের কথা মনে আছে। তাঁরা এবারের আকাল মনে রাখবেন, মনে রাখবেন এবারে রাতে নয়, দিনে রাতে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের উল্লাস আনন্দ কলরবের মধ্যেই আবার মুজিবুরের মাথা ভেঙে ফেলে দেওয়া হল, শাবল গাঁইতি দিয়ে খুবলে নেওয়া হল চোখ মুখ নাক। সেবারে যেখানে পড়ে ছিল তাঁর মৃতদেহ, বেগম মুজিবের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ যে বেডরুমে পড়ে ছিল বা ১০ বছরের শেখ রাসেলের গুলিবিদ্ধ শরীর যেখানে পড়ে ছিল, সেই ভবন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। এবারেও টার্গেট মুজিব, এবং ধনা দা, ওই মাছ ব্যবসায়ী বলছিলেন এবারেও বাঙালি পাবে না ইলিশ, এসব কবে মিটবে কে জানে? সেটাই আমাদের বিষয় আজকে ইলিশ আসবে না?
আজ নয় সেই স্বাধীনতার, মানে মুক্তিযুদ্ধের বহু আগে থেকেই মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামি লিগের আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলাদেশে দুটো পক্ষ, তিনটে পক্ষ নেই। এক হল গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ, অন্যটা হল ইসলামিক রাষ্ট্র যা নিজেকে দুনিয়ার অন্যান্য ইসলামিক দেশের সঙ্গেই একাত্ম রাখতে চায়, যা বাঙালির সাহিত্য থেকে যাবতীয় সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে ইসলামিক রীতিনীতিকেই আঁকড়ে ধরতে চায়, তেমন এক শক্তি।
আরও পড়ুন: Aajke | বাঁদরামি চলবে না, জানালেন মমতা
ধরুন এই নতুন সরকার তৈরি হবে, একজনের নাম খুব শোনা যাচ্ছে, ডঃ সলিমুল্লাহ খান, ইনি ঘোষিত রবীন্দ্র-বিরোধী, সাফ জানিয়েই দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম না করতে পারলে বাংলা সাহিত্যের কোনও অগ্রগতি সম্ভব নয়, কী অদ্ভুত কথা? শেক্সপিয়রকে অতিক্রম না করলে ইংরিজি সাহিত্য সম্ভব নয়, কেউ বলেছেন? বলেননি, বলেননি কারণ এখানে বিবেচ্য সাহিত্য নয়, বিবেচ্য রবি ঠাকুরের মানবতাবোধ, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধিতা। সে যাই হোক, এই শক্তি আজ নয় সেই কবে থেকেই বাংলাদেশে এক সমান্তরাল শক্তি যারা সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করেছে, যারা ক্রমশ বোরখা হিজাব আর ইসলামিক রীতিনীতি চাপিয়েছে দেশের সর্বত্র। কিন্তু এরা পিছিয়েই ছিল, হাসিনা, তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ আর তাঁর সরকারের দুর্নীতি হয়ে উঠল এক সুযোগ। মানুষের সাধারণ গণতান্ত্রিক চাহিদা, সাধারণ ক্রোধকে হাতিয়ার করে সরকার ফেলে দিল, ছাত্রদের সামনে রেখে, হেরে গেল ভাষা চেতনার বাংলাদেশ, হেরে গেল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, তাঁর দলের সরকারের দুর্নীতিকে সামনে রেখে ছাত্রদের সামনে রেখে এক ধর্মান্ধ জামাত গোঁড়া ইসলামিক শক্তিই কি জায়গা করে নিল বাংলাদেশে? শুনুন কী বলছেন মানুষজন।
এ বছর ইলিশ এল না তো এল না, এ বছর না হয় পদ্মার ইলিশ পাতে পড়ল না কিন্তু আমার পড়শি দেশের এই উথাল পাথাল সময়ে আমাদের মন খারাপ, অতজন ছাত্রের মৃত্যু কি সত্যিই এড়ানো যেত না? দেশের সর্বত্র এই বিশৃঙ্খল অবস্থা কবে ঠিক হবে? কবে শুরু হবে বাণিজ্য, খুলবে অফিস আদালত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। আরও বড় প্রশ্ন, যে মুজিবকে আবার কবরে পাঠানো হল সেই মুজিবের মুক্তি চেতনা কবে আবার ফিরে আসবে? এক ভাষা এনেছিল মুক্তি, সেই ভাষার মানুষ হিসেবেই আমাদের এই মন কেমন করা প্রশ্ন তো থাকবেই, জাতির পিতার এই অসম্মান কি সত্যিই প্রাপ্য ছিল?