যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। ৬০ দিন ধরে বিচারের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে জানা গেল অভয়া খুন ধর্ষণ মামলার রায় দেওয়া হবে ১৮ জানুয়ারি। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ৬৫টা প্রমাণ, ৯টা ফরেনসিক ল্যাবরেটরির রিপোর্ট সমেত ৯০টা ডকুমেন্টের ভিত্তিতে সিবিআই ২৪ পাতার চার্জশিট ফাইল করেছিল আদালতে, সেখানে বাবা-মা সমেত ১২৮ জনের সাক্ষী তালিকা ছিল, তাদের প্রত্যেকর কথা শোনা হয়েছে। আপাতত একমাত্র অভিযুক্তের উকিলরা তাঁদের সওয়াল করেছেন, সিবিআই-এর তরফে আইনজীবী ছিল, অভয়ার মা-বাবার তরফেও আইনজীবীরা তাঁদের যা বলার বলেছেন, অভিযুক্তকে যা বলতে চায় তা বলতে দেওয়া হয়েছে।
সেই একমাত্র অভিযুক্ত প্রথম দিকে গ্যালারি গরম করার জন্য কলকাতা পুলিশ কমিশনার ইত্যাদির নাম নিলেও বিচারকের সামনে কেবল বলেছেন আমাকে ফাঁসানো হয়েছে, আমি নির্দোষ। এই এতকিছু দেখে একটা রায় দেওয়া হবে ১৮ তারিখে। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে আমাদের দেশে প্রতি ন’ মিনিটে একটা করে ধর্ষণ হয়, কাজেই অসংখ্য ধর্ষণের মামলাও চলে, খুনের মামলা চলে। এবং আমাদের একটা সাধারণ বিশ্বাস হল আদালত, আইন তাদের পথেই চলবে, আইন অনুযায়ী রায় আসবে। তাই বহু মানুষজন ওই ১৮ তারিখের রায়ের জন্য বসে থাকবেন, তাঁরা ইতিমধ্যে জেনেছেন কী নৃশংসভাবে খুন আর ধর্ষণ করা হয়েছিল শহরের কেন্দ্রে এক হাসপাতালের মধ্যে ওই অভয়াকে। তার ধর্ষণ খুনের পর উত্তাল হয়েছিল শহর, বিচার চাই দাবি তুলেছিল, ১৮ তারিখ সেই জন্যেই অনেক মানুষের নজর থাকবে ওই রায়ের উপর।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | সুপারি কিলার খুন করল তৃণমূল নেতাকে? কারা জোগালেন টাকা
এবারে অন্যদিক থেকে বিষয়টাকে দেখা যাক। বহুদিন আগে, বাবরি মসজিদ বিতর্ক চলছে, তখনও বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়নি, মামলা আদালতে। আদালতের এক রায়দানের ঘোষণা হয়েছে যাতে বলা হবে সেখানে রামলালার মাথার উপর অস্থায়ী ছাউনি তুলে এক স্থায়ী ছাউনি করা যাবে কি না। সাংবাদিকেরা গেছেন লালকৃষ্ণ আদবানির কাছে, প্রশ্ন ছিল আজকের রায় যদি আপনাদের পক্ষে না যায় তাহলে কী করবেন? উনি সপাটে জবাব দিয়েছিলেন এটা আদালত আর আইনের বিষয় নয়, এটা দেশের সম্পূর্ণ হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের বিষয়। আদালতের রায় আমাদের পক্ষে না হলে আমরা সেই রায় মানব না। হ্যাঁ, সাফ জানিয়েছিলেন, আইনের শাসন নয়, আস্থা তারও আগে, বিশ্বাস তারও আগে। এর কিছুদিন পরেই রথযাত্রা শুরু হয়েছিল, তারপর বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল, জ্যোতি বসু সাফ বলেছিলেন, এরা বর্বর, আইন মানে না।
হ্যাঁ, বিচারের আগেই যদি এক রায় তৈরিই হয়ে যায়, তাহলে বিচারালয়ে যাওয়া কেন? আর যদি অন্য মতামত থাকে তাহলে তার সপক্ষে যুক্তি নিয়ে, প্রমাণ নিয়ে আদালতে যাবে না কেন? এই নিম্ন আদালতে সিবিআই-এর তরফে উকিল ছিলেন, অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের তরফে উকিল ছিলেন আবার অভয়ার মা-বাবার তরফেও উকিল তো ছিলেন। তাহলে হয় সেই সব সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়েই গেছে, যার উপরে বিচারক রায় দেবেন, না হলে সেসব প্রমাণ ইত্যাদি বিচারকের সামনে রাখাই হয়নি, তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই যে সেগুলো রাখা হয়নি কেন? সবমিলিয়ে যাঁরা এখনও ন্যায়বিচারের দাবিতে রাস্তায় তাঁরা এই কথাগুলো সম্ভবত মানুষকে বোঝাতে পারেননি, পারেননি বলেই যে সুনামি এসেছিল কলকাতার রাস্তায়, মানুষের ঢল নেমেছিল রাজপথে আজ সেই সংখ্যা কমতে কমতে দৃষ্টি আকর্ষণেরও ক্ষমতা হারাচ্ছে। আর একটা কথা খুব জরুরি, মাথায় রাখুন এই রায় আসার পরেই এই মামলার সমস্ত সওয়াল জবাব, সমস্ত ডকুমেন্ট কিন্তু পাবলিক ডোমেইনে চলে আসবে, সেখানে ৯টা সিএফএসএল রিপোর্টই শুধু নয়, বিভিন্ন সাক্ষীদের সাক্ষ্য ইত্যাদিও সামনে আসবে। যে মিথ্যের পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছিল তা হুউউশ করেই ধসে পড়বে, কাজেই দু’ পক্ষকেই বলব, কেবল রায় নয়, নজর রাখুন এই মামলার সেই ডকুমেন্ট, সাক্ষ্যপ্রমাণের যা বহু মিথ্যের জাল একটানে ছিঁড়ে ফেলবে। আমরা আপাতত অপেক্ষায় রইলাম, ১৮ তারিখের পরে আমরা আদালতের রায় সাক্ষ্য আর প্রমাণ নিয়ে কথা বলব।