যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। পৃথিবীর সব্বাই যদি এক মতের হত, সব্বাই একই সুরে কথা বলত, কী বোরিং হত সেই পৃথিবী, কাজেই তর্ক বিতর্কে সাদা কালোর দ্বন্দ্বে নানান রং ভেসে উঠুক। মাও সেতুং বলেছিলেন শত ফুল বিকশিত হোক, যত আগাছা নির্মূল হোক। তো ভনিতা ছেড়ে শুরু করি আজকের বিষয়। সিবিআই-এর চার্জশিট এবং লুকিয়ে থাকা রহস্য।
মণিপুরে জাতিদাঙ্গা চলছে, বা বলা ভালো চালানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষের চোখ কপালে উঠবে এটা জানলে যে জঙ্গি কাজকর্ম বাড়লে এক শ্রেণির মানুষজনের বিপুল পয়সা রোজগার হয়। বলা বাহুল্য তাদের সিংহভাগ রাজনীতিবিদেরা পায়, দাঙ্গা থেকে দুর্যোগ, বহু মানুষের ঘুম যেমন কেড়ে নেয়, তেমনিই বেশ কিছু মানুষের ব্যাঙ্কে টাকা ঢোকে কাঁড়ি কাঁড়ি। ঠিক সেইরকম আপনার চোখের সামনে কোনও জ্বলন্ত বিষয়, যাতে আপনি বিচলিত, আপনি আহত, আপনি সেই বিষয়ে চলতে থাকা আন্দোলনের সঙ্গী, কিন্তু আপনি জানেনও না যে সেই আন্দোলন নামক সার্কাসের আড়ালে হয়তো লাখ লাখ টাকা এধার ওধার হচ্ছে। আপনি জানেন না আপনার পবিত্র আবেগ নিয়ে কেউ বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করছে। কারও সিভি-তে চকচক করছে আপনার সাধের আন্দোলন, কেউ বা আপনার আবেগের ভেলাতেই চেপে সিনেমা নাটকের প্রচার সেরে ফেলেছেন, তারপর চুপ করে ধাঁ। আপনি জানেন না যে রোজ কত মিথ্যের নির্মাণ আর বিনির্মাণের মধ্যে আপনি এক সাধারণ মানুষ ভাসছেন, আপনার সাধ্যি নেই সেই মিথ্যে থেকে সত্যিটাকে বার করার, কারণ আপনি তো ঠাকুর পরমহংস নন। বা এমনও হতেই পারে যে সেই তথ্যের ১০০ শতাংশ নির্ভেজাল মিথ্যে, বাছবেন কী করে, বাচ্চা উট তো কাঁটা বেছে খেতেই পারে না। বেচারা খায়, রক্ত বের হয়, সেই নোনতা স্বাদে তৃপ্ত হয়ে আরও জোরে কামড় দেয়, তারপর একদিন কাঁটা খাওয়া সহ্য হয়ে যায়, যেমন আমাদের মিথ্যে সয়ে গেছে। আপাতত আমাদের দেশের পলিটিক্যাল ইকোসিস্টেমে সবথেকে বেশি মিথ্যেগুলো আসছে ওই সিবিআই-এর সূত্র হিসেবে। মানে খেয়াল করে দেখুন সিবিআই যেই একটা মামলা হাতে নিচ্ছে ঠিক তখনই হাজার হাজার ইনফরমেশন এসে হাজির হচ্ছে। সেই চিটফান্ড কেলেঙ্কারির কথা ভাবুন, এর এত টাকা, ওর অত গাড়ি, তার অত সম্পত্তি, সব নাকি জনগণের পয়সা মেরে হয়েছে। যারা সেদিন শিশু ছিল, এই শীতে হয়তো তারা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে নিউ ইয়ার্স পার্টি করবে, কারও কারও বিয়ে হবে। মানে তারা এইসব শুনতে শুনতেই বেড়ে উঠল, কিন্তু তাদের একজনেরও কোনও শাস্তি হল না, শাস্তি হওয়া বাদই দিলাম, তাদের দোষীও বলা হলো না। একে একে তারা বেরিয়ে আসছে। ধরুন কিছুদিন আগেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়, টাকা, জমি, অপা, দলিল, বাগানবাড়ি কত কী, তিনিও বেল পেয়ে গেছেন এখন ছাড়া পাওয়ার অপেক্ষা। শুনলাম বলেছেন এবারে হোলি বাইরেই খেলবেন। ধরুন অনুব্রত মণ্ডল, চিনতেই পারছেন না, আমাদের কেষ্ট মোড়লের কথা বলছি, তিনটে চাল কারখানা, দেড় লক্ষ গরু পাচার, লটারির টিকিট, কী দুর্নীতি কী দুর্নীতি, তো তিনি বেল পেয়ে গেছেন, দেড় বছরে তিনি চর্বি ঝরিয়েছেন কিন্তু সিবিআই প্রমাণ জোগাড় করে উঠতে পারেনি। ধরুন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সব্বাই ভেবেছিলেন চাক্কি পিসিং অ্যান্ড পিসিং অ্যান্ড পিসিং, কোথায় কী, তিনি কেবল নয়, দলবল সমেত সব্বাই বাইরে। নাকি চীনের টাকা নিয়ে দেশবিরোধী কাজ করছিলেন নিউজ ক্লিক-এর সম্পাদক মালিক প্রবীর পুরকায়স্থ, ইডি-সিবিআই ছেড়ে দিন, এনআইএ-ও হাজির, ইউএপিএ দিয়ে জেলে। তিনিও বেল পেয়েছেন। ক’দিন আগেই জেল পেয়েছেন টালা থানার ওসি আর আরজি করের অধ্যক্ষ। আসলে সিবিআই এক অদক্ষ সংগঠন, সিবিআই, ইডি বা এনআইএ এইসব সংগঠনগুলো আসলে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম করে চলেছে, তাদের নিজের তো কিছু বলার নেই। ধরতে বললে ধরছে, কিন্তু তারপর প্রমাণের অভাবে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে সব্বাই।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | মোদিজির নতুন নাটক, এক দেশ এক ভোট
হ্যাঁ, অন্তত সিবিআই নিয়ে এটাই আমাদের প্রচলিত ধারণা। কিন্তু এবারে অন্যদিক থেকে ব্যাপারটাকে দেখা যাক, সিবিআই তো আকাশ থেকে পড়েনি, তারাও তো দেশের পুলিশ বিভাগেরই এক্সটেনশন। আইপিএস অফিসারেরা মাথায় বসেন, একই তদন্তের প্রসেস, একই ফরেনসিক ল্যাব্রেটরিতে কাজ হয়। আর সিবিআই-এর অলিখিত আইন অনুযায়ী তাদের বিবৃতি আসে লিখিত, সাংবাদিক সম্মেলন তারা করে না, প্রায় মোদিজির মতো। এমনকী তারা প্রকাশিত খবরের বিরোধিতাও করে না। কাজেই কোত্থেকে খবর পেলেন ভাই? কেন সিবিআই সূত্রে বলে দিলেই কাজ শেষ। এরপরে যত দোষ নন্দ ঘোষ। খেয়াল করে দেখুন ওই সারদা কর্তা বা রোজ ভ্যালি কর্তাদের সম্বন্ধে যা যা পড়েছেন তা কি সিবিআই কোনও বিবৃতিতে জানিয়েছিল, জানায়নি। সিবিআই কি জানিয়েছিল যে কেষ্ট মোড়লের ক’টা ধানকল আছে? জানায়নি। আবার তারা যদি তাদের নামে কোন ভুল খবর বের হল তা দেখতে বসে তাহলে রাত কাবার হবে, কাজেই তারা মুখ চেপে বসে ছিল। কিন্তু তাদের কাছ থেকেই খবর পাওয়া গেছে বলে রাশি রাশি মিথ্যে কথা ছড়ানো হয়েছে। তার শেষতম উদাহরণটা আপনাদের কাছে রাখি। আরজি করের অধ্যক্ষকে সিবিআই দুটো আলাদা মামলাতে গ্রেফতার করেছে। প্রথমটা হল আরজি করের দুর্নীতি, এই মামলাতে আরও বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সব্বাই জেলে। এবং এই মামলাতে বেশ তাড়াতাড়িই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ট্রায়াল শুরু হবে। অন্যদিকের মামলা হল ধর্ষণ আর খুনের প্রমাণ লোপাট এবং এক বিগার কনস্পিরেসিতে তিনি জড়িত আছেন সেই অভিযোগে। এই মামলাতে তাঁর কো-আকিউজড টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডল। তো সিবিআই-এর কাজ হল ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দেওয়া, ধর্ষণ আর খুনের মামলা তো চলছে কাজেই এটা সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট। তারা চার্জশিট দিতে পারেনি। কেন? কোথাও জানিয়েছে? জানায়নি। সুপ্রিম কোর্টে তাদের সরকারি উকিল জানিয়েছিলেন যে সন্দীপ ঘোষের চার্জশিট দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি দেওয়া হয়নি। সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্য সরকারের পক্ষের উকিল জানিয়েছেন, এরকম কোনও বিষয় তাঁর জানাই নেই। সরকার পক্ষের উকিল এ নিয়ে আর কোনও কথা বলেননি। তিনি সুপ্রিম কোর্টকে বলতেই পারতেন যে অনুমতি না থাকলে যদি চার্জশিট না দেওয়া যায়, তাহলে অভিযুক্ত বেল পেয়ে যাবে, যা তাঁরা চান না। না সুপ্রিম কোর্টে এরকম কোনও কথা তিনি বলেননি। এদিকে ৯০ দিন হয়ে গেল, চার্জশিট দেওয়া হয়নি বলে এই মামলাতে বেল পেয়ে গেলেন দুই অভিযুক্ত। সিবিআই জানিয়েছে, সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট তৈরি হচ্ছে, দেওয়া হবে। কিন্তু খবরের কাগজ সিবিআই সূত্রে পাওয়া খবর দিয়েই জোর দিয়েই জানিয়েছে যে রাজ্য সরকার এখনও আড়াল করতে চায় ওই সন্দীপ ঘোষকে তাই অনুমতি দিচ্ছে না। এবং সিবিআই যথারীতি চুপ করে বসে আছে। তারা দুর্নীতির মামলাতে চার্জশিট দিয়েছে ওই সন্দীপ ঘোষ সেখানে মূল অভিযুক্ত, আবার ধর্ষণ খুনের মামলাতে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিতে পারেনি। তা যদি রাজ্য সরকারের অসহযোগিতার ফলে হত, তাহলে নিশ্চিত তারা বিচারককে সেই কথা জানাত, জানায়নি। কিন্তু খবর তো ভাইরাল। আসলে সিবিআই এক বাপে খ্যাদানো মায়ে খ্যাদানো ছেলে, সে অসহায়, তার মালিক তাকে যা করতে বলে তারা তাই করে কিন্তু তাদের তো প্রমাণ তৈরি করার কারখানা নেই, কাজেই ওই গ্রেফতার, জেলে পোরা, বড়জোর চার্জশিট দেওয়াই সার। কিছুদিন জেলে থাকার পরে একে একে তাঁরা জেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। যারা নিজেরাই সিবিআই-এর তদন্ত চেয়েছিল, তারাই সেটিং সেটিং বলে ছাগলের তৃতীয় বাচ্চার মতো নাচছে, এতে সিবিআই-এর দোষটা কোথায় বলুন দেখি?
আজ এখানেই শেষ করছি, সিবিআই-এর চার্জশিটের পিছনে যে গোপন রহস্য তা নিয়ে যা বললাম তা যদি পছন্দ হয় লিখে জানান। যদি নাপসন্দ হয় তাহলে আরও বেশি করে লিখে জানান, আমরাও বোঝার চেষ্টা করব আপনার বক্তব্য। কারণ আমরা আর যাই হোক নিজেদের সবজান্তা গেঞ্জিওয়ালা বলে তো দাবি করছি না। ভালো থাকবেন।