এরমধ্যেই আপনারা জেনে ফেলেছেন যে আমাদের এই অনুষ্ঠান একটা বিষয়কে নিয়ে সেটা সত্যি, কিন্তু সেই বিষয়কে দেখার একটা চোখকে নিয়ে নয়, একটাই বিষয়কে দুটো, তিনটে, চারটে, সাতটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। আমরা তাই এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে আনছি, শুনুন সেই মতগুলো। হতেই পারে একটার সঙ্গে আপনি একমত, কিন্তু অন্যধারের কথাটাও শুনুন। না শুনলে আমিই ঠিক, আর সবই তো ভুল, এরকম একটা বোধের জন্ম হয়, যে বোধ আসলে স্বৈরতন্ত্রের। তো আসুন শুরু করা যাক সাদা কালো অদিতির সঙ্গে। আজকের বিষয়? ইউনিফর্ম সিভিল কোড, ভালো না খারাপ। প্রথমে যেটা জেনে নেওয়া দরকার সেটা হল এই ইউনিফর্ম সিভিল কোড ব্যাপারটা কী। এমনিতে ধরুন খুন করলে সাজা হবে, জেল হবে, ফাঁসিও হতেই পারে, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে ফাইন হবে, এসব ক্ষেত্রে তো হিন্দু বা মুসলমান বা অন্য কোনও ধর্মের জন্য আলাদা কোনও আইন নেই। তাহলে সব্বার জন্য এক আইন বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ব্যাপারটা ঠিক কী?
আসলে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়েই, সংবিধান প্রণয়নের সময়েই আমাদের নেতাদের মাথায় ছিল যে সারা দেশে অজস্র ধর্ম আর জাতি আছে, বহু বৈচিত্র্য আছে, বিশেষ করে তাদের বিয়ে, বিয়ে ভাঙা, মানে বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক প্রথা, আর মেইন্টেন্যান্স বা ভরণপোষণের ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্ম আর জাতির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। তাই সেটা এক আইন দিয়ে সামলানো যাবে না। সেইজন্যই এইসব ক্ষেত্রে পারসোনাল ল চালু আছে। এমনও নয় যে কেবল মুসলমানদের জন্য আছে, ইন ফ্যাক্ট হিন্দুদের আছে, পার্সিদের আছে, বৌদ্ধ ও জৈনদের আছে, অনেকের আছে। সেটাকেই বলা হয় পারসোনাল ল। এবার সেই সব তুলে এক অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার ব্যবস্থা হল এই ইউনিফর্ম সিভিল কোড। এবার আসুন যারা চাইছেন এই ইউনিফর্ম সিভিল কোড লাগু হোক, তাঁরা কী বলতে চান?
মোদিজির সাফ কথা তিনি সিভিল কোড আনবেন। এখন তিনিই এটা প্রথম বললেন নাকি? ১৯৫২ সালে জনসঙ্ঘের যে লিখিত প্রোগ্রাম, তাতেই সাফ লেখা আছে ১) তাঁরা দেশের নাগরিক তাঁদেরই মনে করেন যাঁদের এই দেশ জন্মভূমি, কর্মভূমি, পূণ্যভূমি, অহিন্দুদের হিন্দু বানাতে হবে। ২) কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তোলা হবে। ৩) ভারতীয় সংস্কৃতি মেনে চলতে হবে, এক অভিন্ন ভারতীয় সংস্কৃতির কথা তাঁরা বলতেন ৪) গোহত্যা বিরোধী আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবেই গোমাংসের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। ৫) ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে পাপ, এই কথাগুলো জোর দিয়ে বলা ছিল। বলাই বাহুল্য এর সবকটা কথাই আরএসএস বহুদিন ধরেই বলে আসছিল। কিন্তু এই ইউনিফর্ম সিভিল কোডের বিষয়টা নিয়ে সেভাবে তাঁরা সক্রিয় ছিলেন না। ১৯৮৫-তে শাহ বানু মামলার রায় না মেনে যেভাবে আইন সংশোধন করা হল, বামপন্থীরা, মধ্যপন্থী কংগ্রেস মুসলমান ভোটের দিকে তাকিয়ে এই কাজ করলেন বা সমর্থন করলেন। আর ঠিক ওই সময় থেকেই মুসলমান তোষণ করা হচ্ছে এই ইস্যুতে সরব হল বিজেপি, ততদিনে জনসঙ্ঘীরা বিজেপি তৈরি করে ফেলেছে। আর মাথায় রাখুন ঠিক ওই সময় থেকেই হিন্দু ভোটের দিকে তাকিয়ে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে সেখানে পুজোর ব্যবস্থা করে দিলেন রাজীব গান্ধী। দুটো অস্ত্র নিয়ে বিজেপি তার শক্তি বাড়াল, অযোধ্যায় রামমন্দির চাই আর মুসলমান তোষণ চলছে, কাজেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড চাই। এই জনসঙ্ঘীরাই নেহরুর আনা হিন্দু কোড বিলের বিরোধিতা করেছিলেন, এমনও বলেছিলেন যে এক দলিত আম্বেদকর হিন্দু কোড বিল আনবে তা আমরা মেনে নেব না। হিন্দুদের বহুবিবাহ থেকে উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নেহরু হিন্দু কোড বিল আনতে চেয়েছিলেন কেন? তাঁর বক্তব্য ছিল আগে সংখ্যাগরিষ্ঠের পারসোনাল ল-কে আধুনিক করা হোক, তারপরে বাকিদের মধ্যে থেকেও এই দাবি উঠলে তা করা যাবে। তিনি চেয়েছিলেন পারসোনাল ল-কে আধুনিক করা হোক কিন্তু তার দাবি সেই সমাজ থেকেই আসুক, না হলে তারা একে এক চাপিয়ে দেওয়া বিষয় বলেই মনে করবে।
আরও পড়ুন: অভয়ার বিচারের জন্য রাস্তাতেই থাকব? নাকি বিচার আদালতেই হবে?
কিন্তু সেদিন প্রবল বিরোধিতা করেছিল এই আরএসএস-জনসঙ্ঘ, আজ যাদের উত্তরাধিকারি নরেন্দ্র মোদি এক ইউনিফর্ম সিভিল কোড চাইছেন। তাঁদের বক্তব্য, এক দেশে আলাদা আলাদা পারসোনাল ল থাকবে কেন? সমস্ত দেশের ফৌজদারি আইন যেমন এক, ঠিক তেমনই এক অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হোক, আলাদা হবেই বা কেন? এবং ঠিক তাই তাঁরা কেন মুসলমান তোষণ চালানো হবে এই ইস্যুতে যখনই বলেন তখন এই ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথাই বলেন।
এবার আসুন অন্যদিকের যুক্তিটা শোনা যাক, কেন দেশের বিরোধীরা এই ইউনিফর্ম সিভিল কোডে রাজি নন? কেন তাঁরা বিরোধিতা করছেন? তাহলে আবার মনে করিয়ে দিই, বিজেপি আরএসএস সঙ্ঘ পরিবারের এই ইউনিফর্ম সিভিল কোডকে এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে হবে না। কারণ ১) তাঁরা মনে করান, প্রত্যেক ভারতীয়ের পূণ্যভূমি এই ভারতেই থাকতে হবে, মানে কেউ কাবা, মক্কা গেলে বা সেটাকে তার পূণ্যভূমি বলে মানলে বা কেউ বেথলেহেম বা ভ্যাটিকান চার্চকে তাদের পূণ্যভূমি বলে মানলে সে ভারতীয়ই নয়। তাঁদের সেই ৫২ সালের পার্টি ডকুমেন্ট বলছে অহিন্দুদের হিন্দু বানাতে হবে, তাহলে তাঁরা এই ইউনিফর্ম সিভিল কোড চাইছেন কেন?
তাঁরা যখনই এই ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা বলছেন তখন সাফ বলছেন মুসলমান তুষ্টিকরণের কথা, বলছেন ৪টে বিয়ের কথা। একবারও বলছেন না মুসলমানদের বিয়ের সময়ে মহিলাদের একটা দেনমোহরের বিষয় আছে, কোনও কারণে বিয়ে ভাঙলে স্বামীকে সেই দেনমোহর চোকাতে হয়। বলছেন না যে হিন্দুদের বহু আগে থেকেই মুসলমান পারসোনাল ল-তে মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার দেওয়া আছে। তো এগুলো কি ঐ ইউনিফর্ম সিভিল কোডে যাবে? একজন সর্দারজি এমনকী প্লেনেও একটা ছোট হলেও প্রতীকী কৃপাণ নিয়ে যেতে পারেন, তো সেটা কি সবার জন্য থাকবে? হিন্দু কোড বিলে ভরণপোষণ নিয়ে কিছু বলাই নেই, তা কি আনা হবে? এসব নিয়ে কিন্তু কোনও আলোচনাই নেই, কেবল মুসলমান তোষণের ব্যাপারটাকেই সামনে রেখে এই ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা বলছেন। দেশের আইন নিয়ে তাঁদের চিন্তা নেই, দেশের অজস্র আদিবাসী মানুষজনদের নানান রীতি নীতি নিয়ে তাঁদের চিন্তা নেই, দেশের বাকি ধর্মের মানুষ নিয়েও তাঁদের মাথাব্যথা নেই, টার্গেট সংখ্যালঘু মানুষজন, আরও পরিষ্কার করে বললে টার্গেট খ্রিস্টান, মুসলমান। কারণ আগেই বলেছি জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস সঙ্ঘ পরিবার মনে করে, এদেশে থাকলে হিন্দু রীতি নীতি মেনেই থাকতে হবে। এই ইউনিফর্ম সিভিল কোড আসলে হয়ে উঠবে এক হিন্দু সিভিল কোড, যা প্রত্যেককে মানতে বাধ্য করা হবে।
নিন, দু’ ধারের যুক্তি সাজিয়ে দিলাম। এবার আপনাদের মতো করে আপনারা বুঝে নিন, কিন্তু যা বুঝলেন, বা আরও যদি কিছু বলার থাকে নিশ্চয়ই লিখে জানাবেন, আর দেখতে থাকবেন অদিতির সঙ্গে সাদা কালো।