যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আদিত্যনাথ যোগী জানাচ্ছেন ৫৫ কোটি মানুষ পুণ্যস্নান করেছেন, খানিকটা ১২ হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো এক গুলগল্প। যদি ধরেও নিই যে ১০ লক্ষ বিদেশি এসেছেন মহাকুম্ভে তাহলে ধরে নিতে হবে যে দেশের প্রায় ৪০% মানুষ মহাপুণ্য করার জন্য মহাকুম্ভে গেছেন। ঘোড়াতেও হাসবে এই হিসেব শুনে। কিন্তু কথা হল এক জার্মান সাহেব সেই কবেই বলে গেছেন এমনি এমনি কিচ্ছুটি হয় না, হ্যাঁ মানুষ মিথ্যে কথা, ইন ফ্যাক্ট যে কোনও কথা এমনি এমনি বলে না। তো যোগী আদিত্যনাথ এই গুলগল্পটা বাজারে ছাড়লেন কেন? ১) এটা বোঝাতে যে ওনারা মানে এক হিন্দু সরকার বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইভেন্ট অ্যারেঞ্জ করেছেন। ২) ৫৫ কোটি মানুষের আসা যাওয়ার মাঝখানে শ’ দুই লোক যদি মরেও থাকে তাহলে তা এমন কোনও বিরাট ব্যাপার নয়। ৩) নেহরু এই কাজ করে উঠতে পারেননি, এটা হল সেই হিন্দু ধর্মের রেজারেকশন, পুনরুত্থান। এই মিথ্যে মিথ হয়ে থাকবে, কারণ একে বিশ্বাস করার এক আধার আছে। ব্রিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ড ভরে গেলে তাকে ৫ লাখ, ৮ লাখ, ১৩ লাখ বললেও বিশ্বাস করার মানুষ থাকে বলেই নেতারা সেই কথা বলেন, যাঁরা সেই পুণ্যস্নানে গিয়ে ডুব দিয়েছেন তাঁদের চারপাশেই ছিল অসংখ্য মানুষ, তিনিই সেই ৫৫ কোটির একজন এটা বলে গর্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল এই সংখ্যা ঠিক কত? সেটা যাঁরা সঠিকভাবেই বলতে পারতেন, তাঁরাই যদি মিথ্যেটা বলেন তাহলে তাকে মিথ্যে বলে প্রমাণ করাটা খুউউউব শক্ত। তবুও সাধারণ হিসেবেই বোঝা যায় যে ভারতীয় রেলের সংখ্যা, তারা কত মানুষ নিয়ে যেতে পারেন, বাকি প্লেন বা বাস বা গাড়ি, বাইক ইত্যাদিতে চেপে কতজন মানুষ একদিনে ওই প্রয়াগরাজে যেতে পারেন তার এক হিসেব দিয়েছেন বিষ্ণুপ্রসাদ দুবে। হ্যাঁ, জাতিতে ব্রাহ্মণ, পেশায় স্ট্যাটিস্টিশিয়ান, তিনি বলেছেন কোনওভাবেই এই সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন ৩ লক্ষের বেশি হতেই পারে না, মানে ৬০ দিনে এই সংখ্যা এক কোটি ৮০ হাজারে গিয়ে দাঁড়াবে। ওনার হিসেবের ভিত্তি ছিল রেল, বাস, ভাড়ার বা ব্যক্তিগত গাড়ি, বাইক ইত্যাদি পরিবহণ, ফাইভ স্টার, থেকে এক্কেবারে সরাইখানার মোট বিছানার ব্যবস্থা, প্রয়াগরাজ, কুম্ভ মেলার চারপাসে অস্থায়ী খাবার দোকানের একটা সাধারণ হিসেব। তো জল কতটা? ঢুন্ডতে রহ যাওগে। কানপুরের বাসিন্দা এই দুবেজি আপাতত অজ্ঞাতবাসে, পুলিশও খুঁজছে, নাগা সন্ন্যাসীরাও নাকি খুঁজছে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জানিয়েছে বৈদিক ম্যাথেমেটিক্স না পড়ার ফল। যোগীজি আবার জানিয়েছেন, ৫৫ কোটি মানুষ এসে গেছেন। কিন্তু আমাদের কাছে ওই প্রয়াগ থেকে ফেরা নিথর লাশ আছে, যাদের ডেথ সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়নি, পোস্ট মর্টেম তো দূরের কথা। তাঁদের আত্মীয়স্বজনের কান্না আছে, চান করতে গিয়ে অটোওলার কলার চেপে টাকা আদায়ের ঘটনা আছে, দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়ানোর অসহায়তা আছে, পুলিশের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার অভিযোগ আছে, এমনকী এসি টু টিয়ারে রিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে বাঁদর বাহিনীর দাঁত খিচুনির আতঙ্ক আছে। আমরা জানি ৫৫ কোটি না হলেও এই অসংখ্য মানুষের যাবতীয় বর্জ্য নেমেছে গঙ্গায়, আরও দূষণ তো ছিলই, সেই যে রাম তেরি গঙ্গা ম্যায়লি হয়েছিল, তা আজ আরও বিকট অবস্থায়, সেই বর্জ্য নদীতেই পড়েছে, যার কথা ভাবেইনি যোগী সরকার। সব মিলিয়ে এই অবস্থাকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মৃত্যুকুম্ভ বলেছেন।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | মোদিজি যা বলেন, মোদিজি যা করেন
এবারে আসুন কিছু শ্রীবচনে যাওয়া যাক। ইতিমধ্যেই জেনেছি যে কুইন্টাল কুইন্টাল জলে স্নান করে আসা সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় দু’ হাত তুলে উত্তর প্রদেশ সরকারের সুষ্ঠু ব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন, তিনি ধোঁয়া দেখে বুঝে যান শিল্প হয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি, সেই তিনিই জলপথে গিয়ে ডুব দিয়ে ফিরতি পথেই বুঝে নিয়েছেন যে দুর্দান্ত ব্যবস্থা। যেদিন বলছেন সেদিনেও পড়ে আছে দুর্ভাগাদের কাপড়চোপড়, ব্যাগ, চটি পোঁটলাপুঁটলি, তখনও জানাই যায়নি মৃতদেহের সংখ্যা। তিনি জেনে ফেলেছিলেন সুব্যবস্থার কথা। তিনি এই বাংলার সাংসদ। অন্য আর একজনের কথা না বললে নয়, ২০০৯ সালে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর আক্ষরিক অর্থে মা-মাসি করতেন, চ্যানেলে চ্যানেলে গিয়ে সিঙ্গুরের কারখানা আটকে রাজ্যের যুবকদের মুখের ভাত কেড়েছে ওই ডাইনি গোছের কথাবার্তা বলেছেন, তারপর অবাক হয়ে দেখেছেন ২৩৫ কীভাবে ৩৫ হয়ে গেল। এমনিতে এক স্বাধীন পরিচালকের এসবে কী আর এসে যায়, কিন্তু তিনি তো কেবল পরিচালক নন, প্রোডাকশন ডিজাইনার। বুঝতে অসুবিধে হলে বুঝিয়ে বলি, সিনেমা তৈরির সেই মাথারা, যারা ওই রাস্তাঘাটের পারমিশন, খাবার দাবার হোটেল, যন্ত্রপাতি, স্টুডিও ইত্যাদি ভাড়া করেন এবং সেসব থেকেই উপার্জন করেন, সেই কাজ করতেন, বুঝে ফেললেন তাড়াতাড়ি যে ঘটি উল্টেছে, এবং ব্যবসা লাটে উঠবে, কাজেই তিনি সুললিত সুরে কথা বলে পালটি খেলেন। তাঁর ঘরে অনেক বিদেশি ছবির ডিভিডি আছে, কাজেই তিনি রাজ্যের ফিল্মোৎসবের একজন কর্তাব্যক্তিও হয়ে গেলেন, কিন্তু ২০১৯ এ হুউউস করে বিজেপির উত্থান তাঁর চোখে পড়েছিল, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, তিনি মাঝারি অবস্থানে চলে গেলেন ২০২১-এ উনি বা ওনার সঙ্গেই তৃণমূলে ভিড়ে গিয়ে ভিভিআইপি ক্যাম্পেনার হওয়া আরও কয়েকজনের মতোই চেপে গেলেন, এবং আবার অবাক হয়ে দেখলেন বাংলা বাংলার মেয়েকেই চায়। কী ফ্যাসাদ, কিন্তু এর৷ মধ্যে এসে গেছে একলা পেয়ে মহিলাদের সঙ্গে দুষ্টুমির বেশ কিছু অভিযোগ। সব মিলিয়ে কুম্ভ স্নান জরুরি ছিল, আর চান করলে জামা বদলও জরুরি, সেটা তাঁর চেয়ে বেশি আর কেই বা জানেন? মাথায় হলুদ এবং সিঁদুর লেপে ছবিও পাঠিয়ে দিলেন সেইখানে যেখানে ছাপা হবে এবং তার সঙ্গে দু’ মুখে প্রশংসা, আহা যোগীরাজ কত্ত ভালো। সমস্যা হচ্ছে কাকা, ওই মধ্যেখানে থাকা মানুষেরা না দু’দিক থেকেই ঝাড় খায়, এক পরিচালক হিসেবে সেটা তো তেনার না জানার কথা নয়, তবুও যখন নানান অভিযোগের পরেও ভেসে ওঠার জন্য ডান দিকে রই না আমি বাম দিকে রই না আমি মধ্যখানে রই পরান জলাঞ্জলি দিয়া রে, হ্যাঁ ওনার যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সেটাও জলাঞ্জলি দিয়ে উনি এখন ভেসে থাকার চেষ্টায় আছেন, জেতার নয়, কিছু করার নয়, স্রেফ সারভাইভালের জন্য পরিচালক শীল মশাইকে প্রয়াগে ডুব দিয়ে বলতে হচ্ছে আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।