যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আপনার কাছে স্মার্ট ফোন আছে, আপনার ব্যাঙ্কে টাকা আছে, আপনি ফি রবিবার বাজারে গিয়ে গলদা চিংড়ি, ভেটকি, অসময়ের ইলিশ কেনেন। এসব কেনার আগেই জিজ্ঞেস করে নেন যে বিক্রেতার অনলাইন পেমেন্ট সুবিধে আছে কি না, তারপর মোবাইল বার করে পেমেন্ট আর মাছ ঝোলাতে পোরা। কিন্তু পাশে রাস্তাতেই বসে লকলকে লাউশাক নিয়ে যে বুড়ি, তাকে পেমেন্ট করবেন কী করে? সে উপায়ও সেই বুড়িই বার করে নিয়েছে, মাছওলাকেই দিয়ে দাও, ওর কাছ থেকে আমি পয়সা নিয়ে নেব। ডিজিটাল লেনদেন সেরে চায়ের দোকানে বসে আলোচনা, ভাগ্যে মোদিজি পিএম হলেন, না হলে এমন ডিজিটাল অর্থনীতি কি দেখতে পেতাম? পকেটে ক’টা ক্রেডিট কার্ড আর হাতে মোবাইল থাকলেই ব্যস, জীবনটা ফুরফুরে, সব কিছু ডিজিটাল। অনলাইন খরিদ্দারি, অনলাইন পেমেন্ট। স্পেনসার্স থেকে ঢাউস মল, অনলাইন গ্রসারি অ্যাপ, ক্যাশ টাকার প্রয়োজন কি ফুরল? তাহলে সেই মুঠোভর্তি কাঁচা টাকা ওড়ানোর হিন্দি বাংলা ছবির দৃশ্যগুলো কি মুছেই যাবে?
হ্যাঁ, নরেন্দ্র মোদি এটাকেই ডিজিটাল ইন্ডিয়া বলেছেন, বলেছেন আমরা খুব দ্রুত আধুনিক হয়ে উঠেছি, খুব দ্রুত আমরা ইউরোপের দেশের মতোই ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, তার পরেই তাঁর স্বভাবসুলভ অত্যন্ত বোকা বোকা কথাবার্তা, যাকে বেশিরভাগসময়েই ছ্যাবলামি বলেই মনে হয়, তিনি বললেন ভিখিরিরাও নাকি আজকাল ফোন পে-তে পেমেন্ট নিচ্ছে। সমবেত করতালি। এটা তো ঠিকই যে ইউরোপের দেশগুলোতে গড়ে ৫৫ শতাংশ ডিজিটাল লেনদেন হয়, এরফলে দুর্নীতিও খানিক কমেছে, খরচের হিসেব থেকে যাচ্ছে, কাজেই দুর্নীতির টাকা হদিশ করা সোজা হয়ে যাচ্ছে। আমেরিকাতে এই ডিজিটাল লেনদেন প্রায় ৯২ শতাংশ। মোদিজির স্বপ্ন আমেরিকা, ইউরোপের মতো এক ডিজিটাল ইন্ডিয়া গড়ে তোলা।
আরও পড়ূন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | ১৮তে বিচারের রায়, অভয়া বিচার পাবে
এবার আসুন বিষয়টাকে একটু অন্যদিক থেকেও দেখা যাক। এরকম একটা ভাবনা, মানে সব ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, ইদানিং অনেকের মুখে শুনি, শুনি কেন না আমরা তো তাঁদের সঙ্গেই মিশি, আড্ডা দিই, গল্প করি, নেমন্তন্ন খাই, পিকনিকে যাই, যারা আমার ক্লাসের, যাদের মাসের শেষে মাইনে জমা পড়ে, যাঁদের স্মার্ট ফোন আছে। আর কুয়োর ব্যাংয়ের মতো সেটাই পৃথিবী ভেবে নিজেদের মতামত জাহির করি। একটা হিসেব দেওয়া যাক। ২০২৩–২৪ এ আমাদের দেশে মোট লেনদেন হয়েছে কমবেশি এক লক্ষ কোটি টাকা, তারমধ্যে ডিজিটাল লেনদেন ছিল ১৮৫৯২ কোটি টাকার। মানে মোট লেনদেন এর ২০ শতাংশ ছিল ডিজিটাল। কিন্তু এই যে এক লক্ষ কোটি টাকার লেনদেন হল, তার বেশিরভাগটাই কিন্তু দেশের ৭-৮ শতাংশ মানুষের হাত দিয়ে। হ্যাঁ, দেশের ১০-১২ শতাংশ মানুষ ডিজিটাল লেনদেন করছেন বইকি। তাঁদের ব্যাঙ্কে টাকা আছে, তাঁদের মাইনে বা রোজগার ব্যাঙ্কে জমা পড়ে, তাঁদের স্মার্ট ফোন আছে, তাঁদের একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, দেশের মানুষের মধ্যে বাড়ি গাড়ি এসি এবং ফ্রিজ এই চারটেই আছে ৮ শতাংশ মানুষের, তাদের কেনার ক্ষমতা আছে। তাঁরা ডিজিটাল পেমেন্ট করছেন, মাছের দোকানদার থেকে ফুটপাথের লাউশাক বিক্রি করেন যে মহিলা, তাঁরা বাধ্য হয়েই, খদ্দের হারানোর ভয়েই ওই পেমেন্ট নিচ্ছেন, কিন্তু নিজে খরচ করচেন গুনে গুনে, আর তা ডিজিটাল নয়। কিন্তু এমন এক প্রচার হচ্ছে যে দেশসুদ্ধু মানুষজন এখন ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। এমনকী বিভিন্ন ভরতুকির টাকা, যা নাকি ব্যাঙ্কে জমা পড়ছে, সে পিএম কিসান-এর টাকা বা লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা যাই হোক না কেন, তাকেও ডিজিটাল লেনদেনের মধ্যে দেখিয়ে ওই পার্সেন্টেজ বাড়ানোর খেলা চালাচ্ছেন মোদিজি।
আর তার সঙ্গেই জন্ম নিয়েছে এক সাংঘাতিক ডিজিটাল দুর্নীতি, ক্রেডিট কার্ড থেকে ই পেমেন্ট-এ নানান জালিয়াতি। ডিজিটাল অ্যারেস্ট, ডিজিটাল ডিটেনশন এবং ডিজিটাল সার্চিং এখন নতুন কোনও অপরাধ নয়। গত দু’বছরের মধ্যে এই শব্দটার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছে সাধারণ মানুষের। কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেব বলছে, গত বছরের প্রথম তিন মাসে শুধুমাত্র ডিজিটাল অ্যারেস্টের জেরে দেশের আম আদমির পকেট থেকে গচ্চা গিয়েছে ১২০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, একটি বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে প্রায় ২৫ হাজার ডিজিটাল অ্যারেস্টের ঘটনা ঘটেছে। এই অপরাধ থেকে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি পকেটে ঢুকিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাইবার প্রতারকরা। কিন্তু এ সবের মধ্যেই নতুন বছরে বাজারে হাজির হয়েছে সাইবার অপরাধের নয়া সংস্করণ, ‘সাইবার কোর্ট।’ মাত্র এক সপ্তাহ আগে মধ্যপ্রদেশে চাকুরিরত দক্ষিণ কলকাতার এক বাসিন্দা প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে ভার্চুয়ালি ঢুকে পড়েন এই নতুন অপরাধের বৃত্তে। বিশ্বজিৎ দাস নামে ওই ব্যক্তি জব্বলপুরে একটি মেডিক্যাল সরঞ্জাম সংস্থার উঁচু পদে রয়েছেন। উনি জানিয়েছেন “আমার কাছে কাজের সূত্রে নানা জায়গা থেকে ফোন আসে। বেশিরভাগ কল আমি রিসিভ করি, তাই সেটাও করেছিলাম। সে সময়ে আমাকে বলা হয়, আমরা এনসিবি (নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো) হেড অফিস থেকে বলছি। আপনি অমুক সংস্থার বড় পদাধিকারী, ফলে আপনার নাম করে ড্রাগ পাচারের অভিযোগ আমরা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছি। কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে আপনার নামে পার্সেল–ভর্তি ড্রাগ বাজেয়াপ্ত হওয়ায় আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনাকে অ্যারেস্ট করার জন্য। কিন্তু সেটা না করে সরাসরি সাইবার কোর্টে আপনি হাজির হতে পারেন। মাদক মামলা খুব সিরিয়াস অপরাধ।” কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লিঙ্ক পাঠিয়ে সেখানে বেশ কিছু তথ্য জানাতে বলা হয়। তার মধ্যে ছিল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, প্যান কার্ড নম্বর–সহ আরও অনেক ব্যক্তিগত তথ্য। সেটা পাঠানোর পরে ভিডিয়ো কল করা হয় ওনাকে। উনি জানালেন, “অন্য প্রান্তে দেখতে পাই কোনও পুলিশ অফিসার নয়, কালো কোট পরিহিত এক ব্যক্তি যেন আদালতের এজলাসে বসে রয়েছেন। তিনি হিন্দি এবং ইংরেজিতে চোস্ত কথা বলছেন। এজলাসের ঠিক পাশে একটি কাঠের বক্স মতো জায়গায় এক ব্যক্তি সাদা জামা পরে আমার হয়ে সওয়াল করছেন। আমার বিরুদ্ধে নারকোটিক সাবস্ট্যান্স অ্যাক্টে কলকাতা বিমানবন্দর এলাকার কোনও থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। বিচারক ওখানে বসে আমার আইনজীবী সেজে থাকা ব্যক্তির কাছে পুরোটা শুনে এটাকে ‘গুরুতর অপরাধ’ বলে মন্তব্য করলেন। কঠিন ধারা থেকে জামিন পেতে আমার বেল মানি ধার্য করা হল ৭০ হাজার টাকা। তবে সবচেয়ে জটিল বিষয় হল, গোটা প্রক্রিয়ায় আমার ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকা এবং অনলাইনে টাকা পেমেন্ট করা ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না।” ওনার ৭০ হাজার গেছে, অনেকের ৬-৮ লক্ষ টাকা চলে যাচ্ছে। এই হল আপাতত ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ছবি। দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ এখনও সই পর্যন্ত করতে জানেন না, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের আয় বছরে ১ লক্ষ টাকার কম, সেই জনসংখ্যা নিয়ে স্বাধীনতার অমৃতকালে এসে মোদিজি কেবল মিথ্যে বলে যাচ্ছেন, এখনও পর্যন্ত ওনার এই ডিজিটাল ইন্ডিয়া এক বিশুদ্ধ বাওয়াল।