আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চারটে স্তম্ভ, আমাদের সংবিধানে তাদের দায় আর দায়িত্ব আলাদা এবং নির্দিষ্ট করা আছে। দেশের মানুষ, দেশের সংবিধান, এই দুইয়ের রক্ষার জন্য চারটে স্তম্ভ কাজ করবে। কিন্তু আপাতত এক সর্বশক্তিমান আইন সভা, যা গণতন্ত্রের বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কথা বলছে, তাদের হাতে আছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তারা কেয়ার করে না কাউকে। প্রশাসন অনুগত অন্ধ ভৃত্যের ভূমিকায়, ওই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, সরকার নেতাদের যে কোনও নির্দেশ মানার জন্য এক পা এগিয়ে। বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শত গুণ, এখানে প্রশাসন ১০০০ গুণ আনুগত্য দেখাতে ব্যস্ত, বিরোধী স্বর শুনলেই ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই, পুলিশ, ভিজিলেন্স তাকে দমন করতে, ভয় দেখাতে, জেলে পুরতে ব্যস্ত। হুকুম দেওয়ার আগে ছুটে যাচ্ছে তারা, তারাই নতুন নতুন রাস্তা দেখাচ্ছে ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে, নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য যে কোনও মিথ্যে বলতে, যে কোনও অন্যায় করতে তাদের কোথাও আটকাচ্ছে না।
বিচারবিভাগের কথা তো, কিছুদিন আগে স্বয়ং চিফ জাস্টিস অফ সুপ্রিম কোর্টই বলেছেন, আমরা সবাই জানি, বিচারের বাণী আজও নীরবে, নিভৃতে কাঁদে, কাঁদছে। একের পর এক রায় দেখে আমরা হতভম্ভ, আবার সেই আনুগত্যের প্রকাশ, অবসর নেওয়ার পরে ক’মাসের মধ্যে বিচারকরা পাচ্ছেন বিভিন্ন কমিটির মাথায় বসা, এবং তার ফলে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে, টাকায়, ব্যবস্থায়। পাচ্ছেন রাজ্যসভার পদ, তাদের আনুগত্যে খুশি সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের প্রবক্তারা, সরকার বাহাদুর খুশ। বিচারক রায় দেওয়ার সময় এমন মন্তব্য করছেন, যা করাই যায় না। কিন্তু করছেন, করছেন কারণ উপরে বিগ বস ইজ ওয়াচিং, বিচারক নয়তো যেন মধ্য আশির অ্যাংরি ইয়ং ম্যান, অমিতাভ বচ্চন, কি সব মন্তব্য, ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিত, সবকটাকে জেলে পোরা উচিত, এবং তারপর বিচারকের চাকরি ছেড়ে রাত পোহালে হয়ে যাচ্ছেন বিজেপি নেতা। লক্ষ লক্ষ মানুষের নানান আবেদন পড়ে আছে, তারা বিচার চাইতে সাতসকালে বিচারালয়ের দোরগোড়ায় গিয়ে হাজির হয়, হুজুর মাই বাপ বিচার করে দিন, জমি কার? গরু কার? মামলার পর মামলা জমছে, যা বিচারের জন্য আসাই উচিত নয় তাও এসে হাজির হচ্ছে। অতএব তারিখ পর তারিখ, তারিখ পর তারিখ। একধারে অতিসক্রিয়তা, অন্যধারে চরম নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আমাদের তৃতীয় স্তম্ভকে মানুষ তো বটেই, সর্বোচ্চ আদালতে মুখ্য বিচারপতিই প্রশ্ন করছেন। এবং কীভাবে কীভাবে একটা কথা বড্ড চালু হয়ে পড়েছে, বিচার নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না? কে বলেছে ভাইটি? এটা কার কথা? সংবিধান সে কথা বলে না, আইনশাস্ত্রও সে কথা বলে না। একশোবার কথা বলা যাবে, বলা তো যাবেই যে বিনা বিচারে জেলে রেখে জামিন না দিয়ে আর্বান নকশাল নামক কিছু কবি, লেখক, সাংবাদিক সমাজকর্মী, আইনজ্ঞকে জেলে পোরা হয়েছে, আমরা তার ন্যায় বিচার চাই, বলা যাবে।
আরও পড়ুন: কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট (পর্ব-২০)
বিচারবিভাগের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে, অতিসক্রিয়তা নিয়ে কথা বলা যাবে, বলছি। এবং এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, সাংবাদমাধ্যম নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো। লজ্জাই লাগে, যখন দেখি সাংবাদিকতার নামে উলঙ্গ স্তাবকতা হচ্ছে, মেন স্ট্রিম মিডিয়া তো এখনও রাহুল গান্ধীকেই প্রশ্ন করে যাচ্ছে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সাহস তারা এখনও জোটাতে পারেনি। দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো, দ্য নেশন ওয়ান্টস অ্যান অ্যানসার বলে চিল চিৎকার করে আসলে সরকারের পদলেহনে ব্যস্ত, তাদেরকে এমনকী সাধারণ মানুষও বলছে গোদি মিডিয়া। এই সংবাদমাধ্যম এমন এক দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে মিডিয়ার চেহারাই বদলে দেবে, প্রতিটা খবর, প্রতিটা সাক্ষাৎকার, প্রতিটা এডিটোরিয়াল, এক এবং একমাত্র ক্ষমতাসীনদের পক্ষে, বিরোধীদের বিপক্ষে। যে ছোটখাটো কিছু জায়গায় সত্যিকথা বলার চেষ্টামাত্র হচ্ছে, তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে, তাদের দফতরে ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই পাঠানো হচ্ছে। তাহলে মোদ্দা দাঁড়ালটা কী? এক রাষ্ট্র যা আপাতত সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কবলে, ভোটে জিতেছি, ব্যস, এবার যা ইচ্ছে খুশি করব, একজন প্রতিবাদীকেও গারদের বাইরে রাখব না, এটাই আদত পরিকল্পনা, আর সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই গত ২৪১ দিন জেলে আটক আমাদের সম্পাদক, আমরা বিচার চাইছি, জাস্টিস। জাস্টিস ফর কলকাতা টিভি, জাস্টিস ফর কৌস্তুভ রায়।
দেখুন ভিডিও: