অনেকবার বলেছি, আবার বলছি, রাজনীতি স্নেহের থেকেও বিষম বস্তু। না আছে কোনও রুল বুক, না মেলে কোনও সোজা হিসেব। দুই আর দুইয়ে চার তো অঙ্কে হয়, রাজনীতিতে তা বাইশও হতে পারে, শূন্যও হতে পারে। একটা ছবি দেখুন। ছবিটা ২০১৯-এ নির্বাচনে জেতার পরে মোদি–শাহের। সম্রাট নবাব সুলভ এক পদচারণা। চারিদিকে গগনভেদী রব, মোদি মোদি মোদি, চারিদিক থেকে ফুল উড়ে আসছে, মোদিজি হাত নাড়ছেন। এক স্ট্রিট স্মার্ট অনন্তর মিথ্যে কথা বলে যাওয়া, অসম্ভব শিক্ষার অভাবে বেড়ে ওঠা এক হঠাৎ নবাবের পদচারণা। সেই ২০১৯-এর পর থেকে হারছিলেন, সেভাবে জয় বলতে গুজরাত বা উত্তরপ্রদেশ ছাড়া খাতায় আর কিছুই নেই। কিন্তু ততদিনে এক ন্যারেটিভ তৈরি হয়েই গেছে, গুজরাতের জয় মোদিজির, হিমাচলে হার নাড্ডার, গোয়ায় জয় মোদিজির, দিল্লিতে হার অনুরাগ ঠাকুরের, উত্তরপ্রদেশে জয় মোদিজির, বাংলাতে হার কৈলাশ বিজয়বর্গীয়র। এমনই চলছিল কিন্তু এমনই চলবে তার গ্যারান্টি তো নেই, কাজেই এসবের মধ্যেই কর্নাটকের হার এসে গেল। গোদি মিডিয়া উটপাখি, তারা কর্নাটকের লড়াইকে আপাতত সিদ্দারামাইয়া আর ডি কে শিবকুমারের লড়াইতে এনে ফেলেছেন। আর বাকি যত দোষ তা তো বাসবরাজ বোম্মাইয়ের, সেসবও বলা চলছে। কিন্তু যত ঘোমটা দিয়ে আসল অপরাধীকে ঢাকা হচ্ছে তত তার পিছনের কাপড় উঠে যাচ্ছে। কেবল মুখ দেখেই মানুষ চেনা যায় এমন তো নয়, ডোবারম্যান কুকুর তো শুনেছি ল্যাজ দেখেই চেনা যায়। দেশের মানুষ এই হারের মূল চেহারাকে চিনতে পেরেছে, এটা বুঝেই দলের মধ্যে কথা শুরু হয়ে গেছে।
ভৈরো সিং শেখাওয়াত, পুরনো জনসঙ্ঘের নেতা, বিজেপির প্রবীণ নেতা, রাজস্থানের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর ১০০তম জন্মবার্ষিকী। প্রয়াত এই নেতাকে স্মরণ করার জন্য অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, ছিলেন নীতিন গড়করি। দুজনেই মোদি–শাহের অপছন্দের মানুষ, দেশসুদ্ধ লোক সেটা জানে। কর্নাটকের হারের পরে মঞ্চে উঠে গড়করি যা বললেন তা মোটামুটি কাপড় খুলে দেওয়ারই মতো। যা বললেন তার একটা অংশ অনুবাদ করে আপনাদের শোনাই। উনি বলছেন, “পলিটিক্স ইজ দ্য ইনস্ট্রুমেন্ট অফ সোশিও ইকোনমিক রিফর্ম। পলিটিক্স-এর মানে কী? সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, বিকাশের জন্য সেবার জন্য কাজ করতে থাকা, আজকাল তো সেটা কেবল ভোগের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে আসে সেই লক্ষ্মীর পুজো করে, বড় বড় কথা তো অনেক বলে, কিন্তু গদি পাওয়ার পরে কথা আর কাজের বিরাট ফারাক হয়ে দাঁড়ায়। আজ আমাদের এই কথা তো বলতেই হবে কেবল ক্ষমতা দখলই আমাদের লক্ষ্য নয়, সরকার বদল আমাদের লক্ষ্য নয়, সমাজ বদলাতে হবে।” এরপরে আবার তিনি বলছেন, “আমি খুব কঠিন এক আসন থেকে ২০১৯-এর ভোটে লড়েছিলাম, অনেকে বারণ করেছিল, কিন্তু লড়েছিলাম। এবারে ঠিক করেছি ওই আসন থেকেই লড়ব, কোনও পোস্টার দেব না, ব্যানার দেব না, হোর্ডিং লাগাব না, চা-ও খাওয়াব না। আমার ধারণা গতবারের চেয়ে লাখখানেক ভোট বেশিই পাব। পোস্টার লাগিয়ে নির্বাচনে জেতা যায় না, ভোট পাওয়া যায় সেবার রাজনীতি দিয়ে, ভোট পাওয়া যায় বিকাশের রাজনীতি দিয়ে, ভোট পাওয়া যায় গ্রামে গরিবদের জন্য কাজ করলে। মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করলে মানুষ ভোট দেয়, যুবকদের চাকরি, শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করলে ভোট পাওয়া যায়।”
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কংগ্রেস এক জলসাঘরের জমিদার
আচ্ছা কর্নাটকের হারের পরেই কেন এই কথাগুলো বললেন নীতিন গড়করি? যে কথাগুলো অনুচ্চারিত থেকে গেল, সেটাও তো বোঝা খুব কঠিন নয়। উনি তো পরিষ্কারই বলে দিলেন বিশাল রোড শো, জয় শ্রীরাম, জয় বজরংবলী দিয়ে ভোট পাওয়া যায় না, ভোট পেতে গেলে গরিব মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। লক্ষণীয় যে উনি যখন বললেন আজকাল নেতাদের গদি পেলেই চাল বদলে যায়, তখন মঞ্চে বসে থাকা বসুন্ধরা রাজ্যে হাততালি দিতে শুরু করলেন। আসলে দলের মধ্যে মোদিজির সেই পাহাড়প্রমাণ ইমেজ ধসে গেছে, দলের বহু মানুষ বিজেপির এই ক্ষয়ের জন্য মোদিজিকেই দায়ী বলে মনে করছেন, সেই সংখ্যা বাড়ছেও। মোদিজির লার্জার দ্যান ইমেজে আরও গ্যামাক্সিন লাগবে যদি এরপরের তেলঙ্গানা, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে বিজেপি হেরে যায়। বিজেপিতে একটা হাই কমান্ড কালচার শুরু করেছেন মোদি–শাহ। যেখানে এই দুজনেই শেষ কথা বলছেন, এনারাই ঠিক করে দিচ্ছেন কোথায় কী হবে? কে কোথায় কোন মন্ত্রী হবেন। এঁদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলেই তাঁদের অপছন্দের তালিকায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে, রাজ্যে রাজ্যে তার প্রভাব পড়ছে। নাম কে ওয়াস্তে একজনকে সভাপতি বানিয়ে রাখা হয়েছে, হেরে গেলেই তাঁর দিকে, মানে নাড্ডাজির দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। ইয়েদুরিয়াপ্পাকে সরানোর সিদ্ধান্ত তো মোদি–শাহের, আর ভুল যতদিনে বুঝলেন ততদিনে সময় পেরিয়ে গেছে। বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে মাঠের বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছে, মামাজি শিবরাজ চৌহানও অপছন্দের তালিকাতেই ছিলেন, কিন্তু আপাতত মোদি–শাহ বুঝতে পেরেছেন কিন্তু ওনারা নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে রেখেছেন। মধ্যপ্রদেশে আপাতত বিজেপির সবচেয়ে বড় চিন্তা হল জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। ভোপালে আপাতত চালু জোক হল, এমপির বিজেপি তিন প্রকার, শিবরাজ, মহারাজ আর নারাজ। এমপির প্রথম জনসঙ্ঘের প্রবীণ নেতা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন কৈলাস জোশি, ওনার ছেলে দীপক জোশি বিজেপি ছেড়ে কিছুদিন আগে যোগ দিয়েছেন কংগ্রেসে, কমলনাথ বলেছেন আরও আসবে।
মোদি–শাহের এই হাই কমান্ড কালচার বিজেপির ক্ষয়রোগের অন্যতম কারণ। ডাবল ইঞ্জিন গড়ার চেষ্টাতে রাজ্যে একটা দুধুভাতু মুখ্যমন্ত্রী রেখে দেওয়ার পরিকল্পনাও ব্যাক ফায়ার করেছে, সে সব মুখ্যমন্ত্রীরা রাজ্যে দলের হারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এরপরেই আছে কাস্ট সেনসাসের দাবি, যা শাঁখের করাতের মতো বিজেপির কাছে যন্ত্রণাদায়ক, করলেও বিপদ, না করলেও বিপদ। আসলে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের বিরাট সমর্থন নয়, প্রায় পুরো সমর্থন বিজেপির দিকে, এক ব্রাহ্মণ্যবাদী দল হিসেবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কাস্ট সেনসাস হলেই ওই ৫০ শতাংশের সংরক্ষণের আগল ধরে রাখা যাবে না। দলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষ, ওবিসি ইত্যাদিদের সংখ্যা ৭৯ শতাংশ্তেও পৌঁছতে পারে। তখন সংরক্ষণের দাবি উঠবে, আর সেই দাবি মানলে ১২–১৪ শতাংশ আপার কাস্ট ভোট বিজেপির থেকে সরে যাবে, যা সরে গেলে বিজেপির হাতে পড়ে থাকবে পেনসিল। কাজেই এ কনোনড্রাম, এ ধাঁধার উত্তর তো মোদি–শাহকেই দিতে হবে, যে উত্তর তাঁদের কাছেও নেই। কাস্ট সেনসাস নিয়ে বিপত্তিতে আছে মোদি সরকার, এছাড়াও আছে এনআরসি-র প্রতিশ্রুতি। কাজেই সেনসাস হয়েছে শেষ ২০১১তে, তারপর থেকে দেশের জনগণনা হয়নি, জনগণনা ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা চলছে। এই দশ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে, বিরাটভাবেই বেড়েছে, কিন্তু সে তথ্য আমাদের কাছে নেই।
পরিযায়ী শ্রমিক, এক বিরাট সমস্যা, আমরা কোভিডের সময়ে বুঝেছি, কিন্তু সরকারের কাছে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কোনও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নেই। কাজেই তাদের জন্য কোনও পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়, যদিও সেসব পরিকল্পনার কথা যখন খুশি বলে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে মাইনরিটি কমিউনিটি, বিশেষ করে মুসলমানদের জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, কিন্তু সে সম্পর্কে কোনও ডেটা নেই। কতজনের বাড়ি দরকার, কতজনের চাকরি দরকার, কতজনের কী ধরনের অসুখ হয়, গ্রামে পানীয় জল কতটা গেছে? মানুষ কোন খাদ্যশস্য কোন অঞ্চলে কতটা খাবারের জন্য ব্যবহার করে, এসব তথ্য কোথায়? নেই। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এক বিরাট দরকারি তথ্যভাণ্ডার পাওয়া যায়, হাউস হোল্ড কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভে থেকে, কে কত খরচ করছে, কিসে করছে, কোন প্রডাক্টের কোন অঞ্চলে চাহিদা কেমন? কী ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করছে, কোন ধরনের ভোজ্য তেল ব্যবহার করছে এসব এই সার্ভে থেকে জানা যায়। ২০১৭–১৮র সার্ভে রিপোর্ট প্রকাশ করা হল না কারণ সেই সার্ভের তথ্য সরকারের পছন্দ হয়নি। সামনেই ২০২২–২৩-এর সার্ভে রেডি, জুলাই মাসে বের হওয়ার কথা। মিলিয়ে নেবেন সে সার্ভের রিপোর্ট বের করা হবে না। কাজেই যা চলছে তা সেরেফ বুকনিবাজি। দেশটাকে তুলে দাও আম্বানি আদানি টাটা গোয়েঙ্কাদের হাতে, এই কয়েকটা কর্পোরেট হাউস ব্যবসা করুক বিশ্বজুড়ে, তার থেকে চুঁইয়ে পড়া বিকাশে এক ২০-২৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত তৈরি হবে, এটাই লক্ষ্য। গরিব মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোদিজি ভাবেন? হ্যাঁ ভাবেন, ওই যে ৮০ কোটি লোককে রেশন দেন। নিজেই মাঝেমধ্যে জানান, ওই তো ১০-১৫ কেজি চালগম পাবে দেশের ৮০ কোটি মানুষ, দেশের ২০-২৫ শতাংশ মানুষ চুইঁয়ে পড়া বিকাশের ঝোল হাড় চামড়া খাবে আর বাকি ১০ শতাংশ ইন্ডিয়ার বাসিন্দা, নিউইয়র্ক, পারির রাতে আইফেল টাওয়ারে, ভেনিসের গন্ডোলায়, আমেরিকার বার্গার শপে বা বাকিংহাম প্যালেসের সামনে কফি শপে আড্ডা দেবেন। এটাই মোদি–শাহের দর্শন। এই দর্শন নিয়ে আমরা এতদিন অনেক কথাই বলছিলাম, এখন আরএসএস–বিজেপির মধ্যেই এই কথা হচ্ছে। আপাতত এটাই খবর।
শেয়ার করুন