জ্যোতি বসু, হরকিষেণ সিং সুরজিতের মতো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও ছিলেন জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলার পক্ষপাতী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ২০০৮-০৯ সালে সিপিএমের অন্দরে চলছে চরম টানাপড়েন। তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাতের নেতৃত্বাধীন সিপিএমের কট্টরপন্থী নেতারা পরমাণু চুক্তির ইস্যুতে প্রথম ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার ব্যাপারে অনড়। জ্যোতিবাবু তখন অসুস্থ। প্রকাশ কারাত ইন্দিরা ভবনে এলেন প্রবীণ নেতাকে দেখতে। জ্যোতিবাবু প্রকাশের হাত ধরে বলেছিলেন, আর যাই করো, সমর্থনটা প্রত্যাহার করে নিও না। দেশে এবং রাজ্যে অস্থিরতা দেখা দেবে। একইভাবে দলের অন্দরে আপত্তি তুলেছিলেন বুদ্ধদেব। তাঁর যুক্তি ছিল, মনমোহন সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিলে রাজ্যে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের জোটের রাস্তা মসৃণ হয়ে যাবে। কিন্তু জ্যোতিবাবু, বুদ্ধদেবের লাইন খারিজ হয়ে যায় ২০০৯ সালে বিজয়ওয়াড়ায় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত বৈঠকে। শেষ পর্যন্ত বামেরা ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিল। সনিয়া গান্ধী, প্রণব মুখোপাধ্যায়রা বললেন, ঠিক আছে। আমরাও দেখব আপনাদের দম। সেবার লোকসভায় বামেদের ফল খারাপ হল। বুদ্ধবাবু বর্ধিত বৈঠকে প্রথম দিন গেলেনই না। পরবর্তীকালে ২০১১ সালে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম ইমারত ধসে পড়ার পর বুদ্ধবাবু নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিলেন। রাজ্যের বাইরে কেন্দ্রীয় কমিটি কিংবা পলিটব্যুরোর বৈঠকে যেতেন না।
আরও পড়ুন: শিল্প-স্বপ্নের ফেরিওয়ালা বুদ্ধদেব
২০১৬ সালে রাজ্যে ফের কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সমঝোতার বিষয়টি সামনে এল। গৌতম দেব প্রথমে দলের অন্দরে এই সমঝোতার পক্ষে সরব হন। পরে তাঁকে সমর্থন করেন বুদ্ধবাবু এবং আরও অনেকে। আবার বিরোধিতাও ছিল। বিধানসভা নির্বাচনের আগে সিঙ্গুরের কাছে এক সভায় বুদ্ধবাবু তৃণমূলের মতো অশুভ শক্তিকে পরাজিত করার ডাক দিলেন। তিনি বললেন, কংগ্রেসকে বলছি, আপনারা সিদ্ধান্ত নিন। আপনাদের ঠিক করতে হবে, এই লড়াইয়ে কংগ্রেস কোন দিকে থাকবে। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তখনও কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে দ্বিধাগ্রস্ত। দলের কট্টরপন্থীদের চাপে সীতারাম ইয়েচুরির মতো নেতা হুগলিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সঙ্গে এক মঞ্চ ভাগ করলেন না। কিন্তু ২০১৬ সালে দলের কট্টর অংশের আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে পার্ক সার্কাসে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সভা করলেন এবং জোটের বার্তা দিলেন।
২০১১ সালে বামেদের পতন কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি বুদ্ধবাবু। যতদিন বক্তৃতা দিতে সক্ষম ছিলেন, ততদিন দলের সভা সমিতিতে তাঁর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল তৃণমূল। তিনি সব সময় বলতেন, কী চলছে রাজ্যে। চাকরি কোথায়। আইনশৃঙ্খলা কোথায়। সমাজবিরোধীরা ভেবে নিয়েছে, এই রাজ্যে তারা যা খুশি করতে পারে। এই সমাজবিরোধী দলকে সরাতে না পারলে রাজ্যের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের অনেক আগে থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দি। তার আগেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দলের সব পদ ছেড়ে দিয়েছেন। ধীরে ধীরে কথা বলারও শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তবে দলের কট্টরপন্থীদের অগ্রাহ্য করেই ২০১৬ সালে বুদ্ধবাবু কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বার্তা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দলে তখনও তিনিই শেষ কথা। বাকিটা ইতিহাস।