ওয়েব ডেস্ক: ভারত (India) একটি নদীমাতৃক দেশ। বিভিন্ন ছোট-বড় নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে সব নগর। এমনকি ভারতের বেশিরভাগ উৎসবও সেই নদীকে ঘিরেই। এর মধ্যে পৌষ সংক্রান্তির পুণ্য লগ্নে কুম্ভমেলা (Mahakumbh 2025) হল দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয়। ২০২৫-এ আবার পূর্ণ কুম্ভের যোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রয়াগরাজের (Prayagraj) সঙ্গম স্থলে শুরু হয়েছে এবছরের পূর্ণকুম্ভের মেলা। এই বিশেষ সময়ে গঙ্গা (Ganga River), যমুনা (Yamuna River) ও সরস্বতী নদী (Saraswati River) যেখানে মিলিত হয়, সেখানে স্নান করলে নাকি পূণ্য লাভ হয়। তাই দেশ বিদেশ থেকে কোটি কোটি পুণ্যার্থী কুম্ভের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বাস্তবে গঙ্গা ও যমুনা নদীর অস্তিত্ব থাকলেও সরস্বতী নদীকে পৌরাণিক নদী (Mythical River) হিসেবেই দেখা হয়। তাহলে কি কোনওদিনও এই নদীটির বাস্তব কোনও অস্তিত্ব ছিল না? নাকি কোনও প্রাকৃতিক কারণে হারিয়ে গিয়েছে পুরাণে বর্ণিত সরস্বতী নদী? নাকি এই নদীর স্রোত সকলের অলক্ষ্যে প্রবাহিত হয় মাটির নীচে? চলুন এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা যাক।
ঋকবেদে (Rig Veda) সরস্বতী নদীর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক যুগে (Vedic Era) এটি সবচেয়ে পবিত্র নদী হিসেবে বিবেচিত হত। কথিত রয়েছে, সরস্বতী নদীর জল পান করেই নাকি ঋষি-মুনিরা বেদ রচনা করেছিলেন এবং বৈদিক জ্ঞানের বিস্তার করেছিলেন। তাই সেই সময়ে সরস্বতীকে শুধু একটি নদী নয়, জ্ঞান ও সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হত। শুধু তাই নয়, ইতিহাস বলছে বেদে বর্ণিত এই নদীর আশেপাশেই গড়ে উঠেছিল বৈদিক সভ্যতার অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো। তবে শুধুমাত্র ঋক বেদ নয়, সরস্বতী নদীর উল্লেখ মহাভারত (Mahabharat) এবং রামায়ণের (Ramayan) মতো মহাকাব্যেও পাওয়া যায়। সেখান থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, সরস্বতী নদী প্রয়াগের কাছে অবস্থিত সঙ্গমস্থলে গঙ্গা এবং যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়। তবে সরস্বতীকে অন্তঃসলিলা নদীও বলা হয়। অর্থাৎ এটি মাটির নিচে প্রবাহিত হয়। এই কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। তাই তাঁদের বিশ্বাস অন্তঃসলিলা হওয়ার কারণে নদীটিকে সরাসরি দেখা যায় না।
আরও পড়ুন: হিন্দুশাস্ত্র মতে মহাকুম্ভের পুণ্যস্নান অতি পবিত্র, জানুন এর পিছনে আসল ব্যাখ্যা
সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব প্রমাণে আধুনিক বিজ্ঞানও (Modern Science) বিভিন্ন গবেষণা চালিয়েছে। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO)-র মতে, সরস্বতী নদীর চিহ্ন আজও হরিয়ানা, পঞ্জাব এবং রাজস্থানের কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, এই এলাকায় মাটির নিচে প্রবাহিত হয় নদীটি। বহু হাজার বছর আগে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের (Natural Calamity) ফলে মাটির স্তর পরিবর্তিত হয়। এর ফলে সরস্বতী নদীর প্রবাহ থেমে যায় বলে মনে করেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। এদিকে ঐতিহাসিকভাবে মনে করা হয়, সরস্বতী নদী হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে রাজস্থান এবং গুজরাতের মধ্য দিয়ে গিয়ে আরব সাগরে (Arabian Sea) মিশেছে। আসলে পৌরাণিক কাহিনি এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মিলিয়ে সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ জানা যায়। বৈদিক যুগের শেষদিকে নদীটি শুকিয়ে যেতে শুরু করে। তাই ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানব ক্রিয়াকলাপও এর বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে চোখে না দেখা গেলেও ভারতীয় সংস্কৃতিতে সরস্বতী কেবল একটি নদী নয়; এটি জ্ঞান, বিদ্যা এবং সৃষ্টিশীলতার দেবী। সরস্বতী পূজার মাধ্যমে আজও আমরা এই নদী ও তার ঐতিহ্যকে স্মরণ করি।
মোটকথা সরস্বতী নদী ভারতের ইতিহাস ও পৌরাণিক মহাকাব্যের এক অমর অধ্যায়। এটি শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক জলধারা নয়, বরং এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। আধুনিক যুগে সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো বিজ্ঞান আরও স্পষ্টভাবে নদীটির প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে। কিন্তু আজ সরস্বতী আমাদের কল্পনা ও ইতিহাসের এক অপূর্ব সংযোগ হিসেবে মিশে রয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির অলিন্দে।
দেখুন আরও খবর: