রাঁচি: ট্র্যাজেডি কিছু মানুষের জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। যেখানে জীবন থেকে সব প্রত্যাশার মৃত্যু হয়, সেখান থেকেই ফিনিক্সের মতো তাদের মহাকাব্যিক উত্থান হয়। নিমেষে উদাহরণ হয়ে যায় বাকি বিশ্বের কাছে। এই প্রসঙ্গে যাঁর কথা বলছি তিনি রাঁচি টেস্টে অভিষেক করা বাংলার ক্রিকেটার আকাশ দীপ। তাঁর স্বর্গীয় বাবা চাইতেন বড় হয়ে অনেক নাম করুক আকাশ। আজ আকাশের নাম গোটা ক্রিকেট দুনিয়া ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছে। প্রথম সেশনেই ৩ উইকেট তুলে নিয়ে নিজের আগমন বার্তা দেন আকাশ। এমন একটা সময় এসেছিল যখন একই বছরে বাবা এবং তাঁর ভাইকে হারান আকাশ দীপ। জীবন যখন হতাশায় একেবারে বিপর্যস্ত ঠিক সেইসময়েই তাঁর মহাকাব্যিক উত্থান। মন কেড়ে নিল মধাহ্নবিরতির সময়ের এক দৃশ্য। আকাশ দীপ সামনে এবং পিছনে সব ভারতীয় ক্রিকেটারেরা- এগিয়ে চলেছেন ড্রেসিংরুমের দিকে, সঙ্গে সতীর্থদের স্বতঃস্ফূর্ত করতালি। বাস্তব জীবনের ‘বাজিগর’ যেন আকাশ দীপ! অন্য পৃথিবী থেকে নিশ্চয়ই সব দেখছেন তাঁর বাবা আর আশীর্বাদ করছেন নিজের স্নেহধন্যকে।
প্রথমদিনের খেলা শেষে প্রেস কনফারেন্সে এসে আকাশ বললেন, ‘আমার এই পারফরম্যান্স বাবাকে উৎসর্গ করছি। বাবা চাইতেন আমি বড় হয়ে কিছু করি। আজ নিশ্চয়ই কিছু করতে পেরেছি। দূর থেকে বাবা গর্বিত হবেন আমি নিশ্চিত।’ যখন বলছিলেন তখন চোখ ভিজে আসছিল। সত্যি এও তো এক রূপকথা! ডেবিউ ক্যাপ দেওয়ার সময় রাহুল দ্রাবিড় আকাশ দীপকে বলেন, ‘বেশি কিছু করতে হবে না, যে প্রসেসে ঘরোয়া ক্রিকেটে সাফল্য এসেছে সেটাই করো।’ আর ঠিক সেই পথেই এল সাফল্য। বাবা অন্য পৃথিবী থেকে দেখলেও এদিন স্টেডিয়ামে ছেলের কীর্তির সাক্ষী ছিলেন তাঁর মা।
আরও পড়ুন: শতরানে সমালোচনার জবাব রুটের, ৩০০ পেরল ইংল্যান্ড
লাঞ্চ টাইম শেষ। প্রেসবক্সে ঠিক পাশের চেয়ারে এসে বসলেন এক মধ্যবয়স্ক ইংরেজ ভদ্রলোক। প্রথমে ভেবেছিলাম জার্নালিস্ট, পরে ভাবলাম এ তো অবিকল প্রাক্তন ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইক আথারটনের মতো দেখতে। দিল্লির এক সাংবাদিক বন্ধু ভুল ভাঙালেন। বললেন, উনি শুধু দেখতে নন, আদতেই মাইক আথারটন, কলামনিস্ট হিসেবে লিখছেন এই সিরিজে। এরপর আর কালবিলম্ব না করে পরিচয় পর্ব মিটিয়ে একটাই প্রশ্ন করলাম, বাজবলের বিসর্জন দিয়ে অবশেষে তাহলে ফর্মে জো রুট? আথারটন প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘এটাই টিপিক্যাল রুট ব্যাটিং। দেখুন ডিফেন্সের সময় বলের গন্ধ তাঁর নাকে আসছে। টেস্ট ক্রিকেট এটাই। আপনাকে ক্রিজে সময় কাটাতেই হবে। টেম্পারামেন্ট দেখাতে না পারলে কিসের টেস্ট ক্রিকেট? ঠিক সময়ে রুট ফর্মে ফিরেছে দেখে ভালো লাগল।’ মনে মনে ভাবলাম ইনি পুরো অন্য জগতের লোক যেখানে কোনও স্থান নেই ম্যাককালাম-পন্থীদের! ১৯৯০-এ ম্যাঞ্চেস্টারে এবং ১৯৯৬-এ নটিংহ্যামের ইনিংসেও টিপিক্যাল টেস্ট ব্যাটিংয়ের নিদর্শন দেখিয়েছিলেন আথারটন।
আরও পড়ুন: কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট (পর্ব-৯)
ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে ভারতের একটাই কাজ, দ্রুত অবশিষ্ট তিন উইকেট তুলে নেওয়া। অভিষেকেই আকাশ দীপ ৫ উইকেট নিতে পারেন কি না সেদিকেও নজর থাকবে। এরপর চোখ থাকবে পরপর দুটি টেস্টে দ্বিশতরান করা যশস্বী জয়সওয়াল দিকে। আজাদ ময়দানে পানিপুরি বিক্রেতার ছেলেকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত কিংবদন্তি সুনীল গাভাসকর। ম্যাচের মাঝেই একান্তে জানতে চাইলাম, ৭১-এর ক্যারিবিয়ান সফরে জয়সওয়াল থাকলে কি সফল হতেন? হেসে বললেন, ‘কী বলছেন? জয়ন্তী লালের জায়গায় জয়সওয়াল থাকলে হয়তো আমার ভারতের হয়ে অভিষেক করাই হত না।’ লিটল মাস্টার রসিকতার ছলে উত্তরটা দিলেও মনে দাগ কেটে গেল। যে সিরিজের পর লর্ড রিলেটর তাঁকে নিয়ে ক্যালিপসো রচনা করে, সেই লিজেন্ডের মুখ থেকে এই উক্তি! এর থেকে বড় কমপ্লিমেন্ট আর কী-ই বা পেতে পারেন জয়সওয়াল!
এরপরও কি ঘুম ভাঙবে না বলিউডের আব্বাস-মাস্তানদের? যশস্বী-আকাশ দীপদের নিয়ে হবে না ‘বাজিগর’-এর সিকুয়েল?