উত্তরপ্রদেশে পুলিশ ফোর্সে ৬০ হাজার শূন্যপদের জন্য ৪৮ লক্ষ বেকার যুবক চাকরির আবেদন করেছেন, ৪০ লক্ষ বেকার সেই চাকরির লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং তার আগেই সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিভিন্ন জায়গাতে খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। না, কোনও ইডি বা সিবিআই যায়নি, কোনও অগ্নিমিত্রা পল বা শুভেন্দু অধিকারী প্রতিবাদ করেননি, কোনও মানবাধিকার কমিশন যায়নি, কোনও তদন্ত হচ্ছে না। পরীক্ষা বাতিল হয়েছে তেমন কোনও সরকারি নোটিস আজ অবধি নেই। ২০১৪-তে এক্কেবারে জরুরি খাবার দাবারের যা দাম ছিল আজ তার ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে, মানে ১০০ টাকা তখনকার দাম হলে আজ ১৪৩ টাকা দিতে হবে। মজুরি বেড়েছে ১৩ শতাংশ, মানে ১০০ টাকা মজুরি এখন ১১৩ টাকা। না, এ নিয়ে কোনও চিন্তা নেই, সরকারের কোনও পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। আরএসএস থেকে বজরং দল বা বিজেপি এ নিয়ে চিন্তিত নয়। তাদের আপাতত বিরাট চিন্তার বিষয় হল আকবর নামে সিংহ কেন সীতা নামের সিংহীর সঙ্গে এক ঘরেই বসবাস করছে। একে তো লিভ ইনই বলা যায়, কারণ গান্ধর্ব মত বা হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট বা মুসলমান মতে বিয়ে শাদি তো হয়নি। সেটাই আজ দেশের সামনে বিরাট সমস্যা, এ নিয়ে আদালতেও চলে গেছেন কিছু মানুষ। সত্যিই তো পুরাণের সীতা মা কী করে আকবরের সঙ্গে লিভ ইন করছে, হোক না সিংহ বা সিংহী, দেশ তো ভারতবর্ষ এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম তো নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। আসলে এই সরকারের যা কিছু সবটাই আবর্তিত হচ্ছে এক অদ্ভুত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে ঘিরে। এবং সেখানেই প্রশ্ন, ধর্ম কী?
যা ধারণ করে, তাই ধর্ম, যা ধারণ করে না, তা অধর্ম। এ তো গেল শব্দের মানে, এবং এই মানে অনুযায়ী, প্রত্যেকটা বস্তু, মানুষ, গোষ্ঠী, সমাজ বা দেশ এমনকী গোটা পৃথিবীর এক নির্দিষ্ট ধর্ম আছে। আগুনের ধর্ম তার দহনশীলতা, জলের ধর্ম তার তরলতা, মানুষের ধর্ম মানবিকতা, সমাজের ধর্ম একসঙ্গে বেঁচে থাকা, দেশের ধর্ম তার বিকাশ, উন্নয়ন আর নাগরিক সুরক্ষা, পৃথিবীর ধর্ম তার আহ্নিক গতি, তার বার্ষিক গতি, তার ফলস্বরূপ দিন ও রাত, ঋতুর পরিবর্তন। এর যে কোনও ব্যত্যয়কে অধর্ম বলা হয়। মানুষ যদি বাঘ, সিংহ বা কেঁচোর মতো আচরণ করে, তাহলে তা অধর্ম তো বটেই। সমস্যা হল বস্তুর ধর্ম, পৃথিবী, সৌরজগৎ, জল, আগুন, হাওয়া তার ধর্ম পরিবর্তন করে না, কিন্তু মানুষের সেই বস্তুর ব্যবহার, মানুষের বিভিন্ন কাজের প্রভাবে তার ধর্মে প্রভাব পড়ে, কঠিন লাগছে? একটু বুঝিয়ে বলি। আগুনের ধর্ম উত্তাপ, দহনশীলতা, সেই আগুন দিয়ে মানুষ রান্নাও করে, ঘরও জ্বালায়, তাই না? পৃথিবীর আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির ফলে দিন রাত আর ঋতুর পরিবর্তন তো হয়, কিন্তু মানুষের নির্বিচারে বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলে সেই ঋতু পরিবর্তনের উপরও প্রভাব পড়ে। মানুষের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যই পৃথিবী থেকে মুছে গেছে অনেক সভ্যতা, মেসোপটেমিয় সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা থেকে হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার মুছে যাওয়ার পেছনে মানুষের ভূমিকা এখন স্পষ্ট। একথাও স্পষ্ট যে সেই সব সভ্যতার মানুষজনেরর যে কাজের ফলে সেই সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে, মুছে গেছে পৃথিবী থেকে, সেই মানুষেরা কিন্তু সেটা বোঝেননি, অনুমান করতে পারেননি। তাঁদের সভ্যতা উন্নত ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু এই ধ্বংসের পূর্ব অনুমান তাঁরা করতে পারেননি, ধ্বংসকে রোখা যায়নি।
আরও পড়ুন: কোন অঙ্ক কষে, কোন স্ট্রাটেজি নিয়ে বিজেপি ৩৭০টা আসনের ডাক দিয়েছে
কিন্তু আজকের পৃথিবী সম্পর্কে এ কথা বলা যাবে না, প্রতিদিনের গবেষণা বলে দিচ্ছে পরিবেশ ধ্বংসের কথা, পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠার তথ্য আজ সবার সামনে, ক্রমাগত উষ্ণায়ন নিয়ে পৃথিবীর মানুষ চিন্তিত, তাকে রোখার চেষ্টাও চলছে। কিন্তু বিপদ কাটেনি, বিপদ বাড়ছে, একটা সময়ে উন্নত দেশগুলো নির্বিচারে তাদের উন্নয়ন যজ্ঞ চালিয়েছে, আকাশ ছোঁওয়া বাড়ি, গাড়ি, এসি, উন্নয়নের যাবতীয় প্রতীক আসলে একদিকের ছবি। অন্যদিকে পরিবেশ দুষিত হয়েছে, বায়ুতে বিষ ভরা হয়েছে, যখন তাঁরা বুঝলেন, ততদিনে বিরাট ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, এখন যখন বোঝা গেল, তখন উন্নয়নশীল, দরিদ্র দেশের সেই একই উন্নয়ন প্রশ্নের সামনে, সেই উন্নত দেশের মানুষজন লাখো লাখো বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় করেছেন, এখন তাঁরাই উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের সেই একই কাজের বিরোধিতা করছেন। এই ফ্যালাসি তো আছেই, কিন্তু মোটের ওপর মানুষ বুঝেছে প্রকৃতিকে নিয়ে খেলা করলে, প্রকৃতি ঘাড় নাড়াবে, ভূমিকম্প হবে, বন্যা হবে, উষ্ণায়নের ফলে বৃষ্টি কমবে, জলস্তর বাড়বে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতির রোষে সব উন্নয়নকে থমকে দিয়ে অসহায় মানুষকে লুকিয়ে পড়তে হবে ঘরের ভেতরে, এক ছোট্ট ভাইরাসকে আটকাতে সারা বিশ্বে লক ডাউন। মানুষ এসব বুঝেছে, অন্তত বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষের ধর্ম যদি কেবল মানবিকতাই থাকত, তাহলে তো সমস্যা ছিল না। মানুষ ক্রমশ সমাজবদ্ধ হয়েছে, এবং তার গোষ্ঠীর আচরণ, নিয়ম কানুনকে ঘিরে গড়ে তুলেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, ভূগোলের অবস্থান অনুযায়ী, মানুষ ছিল নিগ্রয়েড, মঙ্গোলয়েড, ককেশিয়ান, এর সঙ্গে অনেকেই অ্যাস্ট্রোলয়েডকেও এক ভাগে রাখেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই চেহারার মানুষ জন্ম নেন, কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই তাদের মিলন হয়, ১০০ শতাংশ ককেশিয়ানও পাওয়া যাবে না, ১০০ শতাংশ নিগ্রয়েডও পাওয়া যাবে না, মিলে মিশে নানান চেহারা নিয়েছে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। আবার ওই ভৌগোলিক অবস্থানেই গড়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, নানান ধর্ম, খিস্টান, মুসলমান, জরুথ্রিস্টিয়ান, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, আদিবাসী বিভিন্ন ধর্ম।
তারাও তাদের শুদ্ধতা ১০০ শতাংশ বজায় রেখেছে এমনও নয়। তারাও বিভাজিত হয়েছে, তাদেরও ভাগ হয়েছে, তাদের মধ্যেও নানা গোষ্ঠী হয়েছে, বিভিন্ন তত্ত্বের ভিত্তিতে, উপাসনার পদ্ধতির ভিত্তিতে তাদের নানান গোষ্ঠীর তৈরি হয়েছে। তাই এখন কেবল হিন্দু বা কেবল খ্রিস্টান বা কেবল মুসলমান বলতে কিছুই বোঝায় না, তাদের উপাসনা পদ্ধতি, রীতিনীতি, পাঠ, খাদ্য হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়েছে, হচ্ছে। এখানেই থামেনি, কিছু মানুষ ইশ্বর নিয়ে নির্বিকার, অ্যাগনস্টিক, কিছু মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাসই করেন না, এথেইস্ট, নাস্তিক, তাদের সংখ্যাও বেড়েছে, বাড়ছে। মধ্যযুগের ইতিহাসে, রাজা, সম্রাট, নবাব, সুলতানের ইতিহাসে ধর্মের বিরাট প্রভাব ছিল, ধর্মপ্রচারে শাসকের ভূমিকা ছিল, ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ ছিল, ক্রুসেড দেখেছে পৃথিবী, কালাপাহাড় দেখেছে, চেঙ্গিজ, তৈমুর দেখেছে ভারতবর্ষ, আবার সবটাই যে তেমন ছিল তাও নয়। অনেক সম্রাট, রাজা, নবাব ধর্মের সমন্বয়ের কথা বলেছেন, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির কথা বলেছেন। কিন্তু এসবের পরেও আধুনিক রাষ্ট্র উদ্ভবের আগে পর্যন্ত ধর্ম আর রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠল, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার মোটের ওপর ঘোষিত নীতি হল, ধর্ম এক ব্যক্তিগত বিষয়, যার যেমন ইচ্ছে ধর্ম পালন করুক, রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষ থাকবে, রাষ্ট্রের ধর্ম প্রজাপালন, উন্নয়ন, বিকাশ। রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চক্করে পড়বে না। সেখানেও ধর্মের মোড়লদের বিরাট বাধা, বিশেষ করে তেমন উন্নত নয়, তেমন বিকশিত নয় এমন দেশে ধর্মকে রাষ্ট্রের থেকে আলাদা করা গেল না। ইসলামিক দেশ গড়ে উঠল, সে দেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, প্রজাপালন, বিকাশ, উন্নয়ন সবই ওই মাপকাঠিতেই দেখা হতে থাকল, মানে সেই মধ্যযুগীয় অন্ধকারের ছায়া থেকে গেল। সেখানেও কি মাথাচাড়া দিল না আধুনিকতা? উন্নত দেশের সব উপকরণকে সামনে রেখে সেখানেও উদারবাদের উত্থান হল না? হল তো, আমরা দেখলাম বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল তাদের নয়া সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠল, আবার উল্টোদিকের সেই উদার চাহিদার, তার প্রতিক্রিয়ায় আরও গোঁড়ামির জন্ম হল, ধর্ম বিপন্ন স্লোগান দিয়ে কিছু জঙ্গির জন্ম হল, রাষ্ট্র এই উন্মাদদের কাজেও লাগাতে থাকল। এক উদার ইরাক, আফগানিস্তান, ইরান হয়ে উঠল মৌলবাদীদের ডেরা, দেশ চলে গেল মায়ের ভোগে। এইসবের মধ্যেই আমাদের দেশও স্বাধীন হয়েছে, সংবিধানের ছত্রে ছত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। রাষ্ট্রের থেকে ধর্মকে আলাদা করার কথা বলা আছে, ব্যক্তিগত ধর্মাচরণে আঘাত না দেওয়ার কথা বলা আছে, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য বেআইনি, সে কথা বলা আছে। কিছু মানুষ সংখ্যাগুরু হিন্দুদের হিন্দুরাষ্ট্র ইত্যাদির কথা বললেও, তাকে পাত্তাও দেওয়া হয়নি। কোথাও ঝগড়া, কোথাও অশান্তি হয়েছে বটে কিন্তু গোটা সমাজ হিন্দু আর মুসলমানে ভাগ হয়ে গেছে এমনটাও হয়নি।
কিন্তু এই প্রক্রিয়া যে চলছে, তা যে ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে তা টের পাওয়া গেল ১৯৯০-এর সময় থেকে। দেশ জুড়ে ক্রমশ এক কল্পিত শত্রু তৈরি করার চেষ্টাও শুরু হল, পাকিস্তান শত্রু, পাকিস্তান ইসলামিক দেশ, কাজেই ইসলামও শত্রু, এমন এক সরল যুক্তি হাজির করার চেষ্টা চলল। মানুষ ভুলেই গেল, ওই পাকিস্তানের মিলিটারি কী বর্বর অত্যাচার চালিয়েছিল বাংলাদেশে, সেখানে তো শুধু হিন্দুরা মারা যায়নি, লাখে লাখে মুসলমান মানুষজনদের খুন করা হল, নারীদের ধর্ষণ করা হল। একধারে মুজিবর, অন্যধারে ইয়াহিয়া খান, দুজনেই মুসলমান। পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারতবর্ষ, মানবিকতার খাতিরে, কোনও ধর্মের খাতিরে নয়। কিন্তু সে সব ইতিহাস মুছে দিয়ে ধর্মের পরিচয়কেই তুলে ধরা হচ্ছে, ধার্মিক মেরুকরণের চেষ্টা হচ্ছে, ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে এক মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কে জানে না? আমরা সব্বাই জানি, এদেশের হিন্দু মুসলমান, সংখ্যালঘু মানুষ একথা জানেন, এবং গর্বের কথা হল বেশিরভাগ মানুষ এই মেরুকরণকে অস্বীকার করেছে। এখনও বিজেপি ৩৭ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পায়, তার মানে ৭৯.৮ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম আরএসএস–বিজেপির এই চক্রান্তে সায় দিয়েছে, এটা পরিষ্কার। দেশের প্রতি দু’জন হিন্দুর অন্তত একজন সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ওসব ধর্মের ভিত্তিতে দেশ আর সমাজকে ভাগ করা যাবে না। বস্তুর ধর্ম, জীব বৈচিত্র্যের ধর্ম, পৃথিবী, সৌরজগতের ধর্ম নিয়ে ছেলেখেলা করা ঠিক নয়। অনিয়ন্ত্রিত জিন গবেষণা বিপর্যয় ডেকে আনছে, বনাঞ্চল উজাড় করা বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটাচ্ছে, মানুষ জানে, বুঝেছে, বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্যধারে এই আধুনিক রাষ্ট্র যদি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ভিত্তিতেই সমাজে দেশে বিষ ছড়ায়, তাহলে একটা জিনিস তো বোঝাই যায় যে সেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা সরকার আসলে সমাজের কল্যাণ, দেশের উন্নয়ন বা বিকাশ চায় না, এবং এই খানেই পাকিস্তানের সরকার আর নরেন্দ্র মোদি সরকারের কোনও ফারাক নেই। তারা এই আধুনিক যুগেও ধর্মের ভিত্তিতেই দেশ চালাতে চায়, দেশ আর সমাজকে মধ্যযুগে নিয়ে যেতে চায়। তাই তাদের চিন্তা দেশের দারিদ্র, বৈষম্য, বেকারত্ব বা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নয়, তাদের স্লোগান কাশী মথুরা, তাদের চিন্তা আকবর নামের সিংহ কেন সীতা নামের সিংহীর সঙ্গে লিভ ইন করবে।