দার্শনিক ভলতেয়ারের নামে এই কোটেশনটা চালানো হলেও আসলে এই কথা বলেছিলেন ওনার জীবনীকার এভিলিন বিয়াট্রিস হল, বলেছিলেন, “I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it.” আপনি যা বলছেন, আমি তার সঙ্গে একমত নই, কিন্তু আমি আপনার কথা বলার অধিকারকে জীবন দিয়েই রক্ষা করব। সন্তু পান একজন সাংবাদিক, যাঁর চ্যানেলের ঘোষিত নীতিই হল ১০ বছরের শাসক নয়, বিরোধীদেরই প্রশ্ন করা, শাসকদলের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার প্রচার করা, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গোলমাল পাকানোর ষড়যন্ত্রে থাকা, এসব আমরা জানি। কিন্তু ওই যে সাংবাদিকের অধিকার বজায় থাকুক, তাতে হস্তক্ষেপ হলে আমরা তার প্রতিবাদ করব। করছি। সন্তু পান মুক্তি পেয়েছেন, আমরা খুশি। এবং সেই মুক্তির দাবি করেছে আমাদের প্রেস ক্লাব, দাবি করাই উচিত। মুক্তি দিতে গিয়ে বিচারক বলেছেন মিডিয়াকে নির্ভয়ে কাজ করতে দেওয়াটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরাও একমত হুজুর, কিন্তু প্রেস ক্লাবের মহামান্যরা, আদালতের ধর্মাবতার হুজুর, মিডিয়া মানে কি কেবল ওই ভেঁপু টিভি চ্যানেলগুলো? আররররনব গোস্বামী? গোদি মিডিয়া। আজ্ঞে ধর্মাবতার আপনারা তো সর্বজ্ঞ, আপনাদের নাকের ডগায় ইডি একে ফর্টি সেভেন ধারী বাহিনী নিয়ে মস মস করে ঢুকছে কলকাতা টিভিতে, না আপনাদের চোখে পড়ছে না প্রেস ক্লাবের। এক কনভিক্টেড আসামির বয়ানের ভিত্তিতে গ্রেফতার হয়ে ২০০ দিনেরও বেশি জেলে আছেন কলকাতা টিভির সম্পাদক কৌস্তুভ রায়, সেদিকেও একটিবারের জন্য অমন সুন্দর উটের মত গ্রীবা উত্তোলন করুন। ১০০ দিন হতে চলল নিউজ ক্লিকের মালিক সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ, তাঁর উপরে আবার রাষ্ট্র বিরোধিতার ধারা চাপানো হয়েছে। জেলেই ছিলেন প্রায় তিন বছর সিদ্দিকি কাপ্পন, কাশ্মীরে তো সরকারের বিরুদ্ধে বলা প্রতিটা প্রতিবাদী মুখই জেলে। ধর্মাবতার আপনাদের আরেকটা তথ্য দিয়ে সাহায্য করি, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের সমীক্ষা জানাচ্ছে, আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা প্রতিদিন নামছে। তো এসব নিয়েও দু’ চারটে কথা হোক। যদিও সেসব কথা বলার আগে আবার বলা যাক, সন্তু পান মুক্তি পেয়েছে, আমরা খুশি এবং সেটাই বিষয় আজকে।
সন্তু পানের মুক্তির দাবিতে যাঁরা চোখে চোখ রেখে নৌটঙ্কি করছেন, তাঁরা এবার প্রবীর পুরকায়স্থ বা কৌস্তুভ রায়ের মুক্তির দাবিতেও দু’ চারটে কথা বলুন, নাকি তখন চোখে ন্যাবা ধরে যায়? একজন কনভিক্টেড আসামি, চিটিংবাজির দায়ে যাবজ্জীবন জেলে থাকার সাজা পাওয়া আসামির তছরুপের পরিমাণ ৬৩৮ কোটি টাকা, সে টাকার শূন্য দশমিক দুই পাঁচ শতাংশ টাকা, অর্থমূল্যে দেড় কোটি টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগে কৌস্তুভ রায় ২০০ দিনেরও বেশি জেলে।
আরও পড়ুন: Aajke | আপনার আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করা হতেই পারে
দেড় কেন এক হাজার টাকা মেরে দিলেও তার সাজা পাওয়া উচিত আমরা মানি, কিন্তু তাহলে সেই ২০১৭ থেকে বাকি ৬৩৬ কোটি টাকার কোন হিসেব ইডির কাছে আছে? কারা মেরে দিল সে টাকা? কলকাতা টিভি ১১ শতাংশ বিজ্ঞাপন পেয়েছিল ওই মনোরঞ্জনের কাছ থেকে, বাকি যারা ৮৯ শতাংশ বিজ্ঞাপন পেল, তাদের একজনকেও ডাকা হয়েছে? ডেকেছে ইডি? জেলে পুরেছে? চীনের টাকা এসেছে বলে প্রবীর পুরকায়স্থ জেলে? চীনের সঙ্গে আম্বানি আদানিদের ব্যবসা নেই? পেটিএম-এর নাম আমরা কবে শুনেছিলাম যা আদতে পুরোপুরি চীনা মালিকানাতে চলত, শুনেছিলাম ডিমনিটাইজেশনের দিনে, তারপরের দিন পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন ছিল পেটিএম-এর। মানে দেশের অর্থমন্ত্রী জানতেন না ডিমনিটাইজেশন হচ্ছে, কিন্তু পেটিএম-এর মালিকরা জানত। না জানলে সাতসকালে প্রত্যেক জাতীয় হিন্দি ইংরিজি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় একই বিজ্ঞাপন থাকত না। কেউ গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে আমাদের নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিকে যে আপনি কোন স্বার্থ রক্ষার জন্য চীনের এক কোম্পানিকে জাতীয় গোপন তথ্য জানিয়েছিলেন। সেই চীন থেকে টাকা পেয়েছে নিউজ ক্লিক, তাই প্রবীর পুরকায়স্থ দেশের কাছে বিপজ্জনক? তাঁকে ইউএপিএ-তে গ্রেফতার করা হবে? সে টাকা তিনি পেয়েছেন, এমন তথ্য প্রমাণিত নয়, সে টাকা আইনতও তো আসতে পারে, চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য তো বেআইনি নয়, তাহলে তার দায়ে একজন জেলে কেন থাকবেন। এবং তাঁকে জেলে পোরা নিয়ে আমাদের কলকাতা প্রেস ক্লাব বা আমাদের হুজুরে আলমদের এই হীরণ্ময় নীরবতা কেন? কৌস্তুভ রায় একজন সম্পাদক, কোন প্রেস ক্লাবের কর্তা তাঁকে চেনেন না? তাঁরা সন্তু পানের মুক্তির দাবি নিয়ে সরব, বেশ তো, একটু এটা নিয়েও দুটো শব্দ খরচ করুন। এই শহরের এক পরিচিত টিভি চ্যানেলের সম্পাদক কেন ২০০ দিনের বেশি জেলে আটক হয়ে আছেন, কেন তাঁর জামিনের আবেদন মঞ্জুর হচ্ছে না একটু জানার চেষ্টাও অন্তত করুন। তাঁর অবর্তমানে কীভাবে এক সংবাদমাধ্যম চলছে, সেটাও কি খোঁজ নিয়েছেন একবারের জন্য? এতজন সাংবাদিকের পাশে দাঁড়ানোটা প্রেস ক্লাবের কর্তব্য নয়? আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, বিচারব্যবস্থা থেকে বলা হচ্ছে মিডিয়াকে নির্ভয়ে কাজ করতে দেওয়াটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সন্তু পানকে গ্রেফতার নিয়ে ক্ষুব্ধ বিচারপতি, কিন্তু সেই একই বিচার ব্যবস্থায় দিনের পর দিন জেলে কাটাচ্ছেন মোদি বিরোধী সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক, মালিক, সম্পাদক, জেলে আছেন প্রবীর পুরকায়স্থ, জেলেই আছেন আমাদের সম্পাদক কৌস্তুভ রায় আরও অনেকে, বিচার ব্যবস্থা কি এক এক জায়গায় এক এক রকম করে ভাবছে? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন?
গণতন্ত্র কোনও খণ্ডিত ধারণা হতে পারে না, কোনও গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোনও এক জায়গায় গণতন্ত্রের উপর আঘাত এলে অন্য আরেক ধারের ভারসাম্য বজায় থাকে না, থাকার কথাও নয়। যদি দেখা যায় নির্লজ্জভাবে দিল্লির সরকার সমস্ত নিয়ম কানুনকে ভেঙে, অতিক্রম করে বিরোধীদের জেলে পোরার চেষ্টা করেছে, তাহলে খুব সামান্য ক্ষমতা নিয়ে এক প্রদেশের অবিজেপি সরকারের কাজকর্মে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে বাধ্য। তা কাম্য না হলেও তা হবেই, এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে। তুমি আমার ঘোড়া কেটেছ আমি তোমার হাতি কাটলাম। দাবা খেলা আর গণতন্ত্রের চর্চা এক নয়। তাই সন্তু পানের মুক্তির দাবিতে যারা সরব তাদের মাথাতে রাখতেই হবে দেশজোড়া সেইসব সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম মালিক বা সম্পাদকদের কথা যারা অন্যায়ভাবে জেলে বা যাদের অন্যায়ভাবে হ্যারাস করা হচ্ছে।