ইন্ডিয়া জোট তাদের কো-অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠকে জানিয়েছিলেন যে তাঁরা তাঁদের মিডিয়া কমিটিকে কিছু টিভি অ্যাঙ্করদের নাম বাছাই করতে বলেছেন, যাঁদের শোতে ইন্ডিয়া জোটের কোনও প্রতিনিধি যাবেন না। সেই তালিকা সামনে এসেছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাতে অর্ণব গোস্বামী, সুধীর চৌধুরি, নবিকা কুমার, অমিশ দেবগণ, আমান চোপরা ইত্যাদি সমেত ১৪ জনের নাম আছে। বিরোধী জোট এই ১৪ জনের ডাকা আলোচনা সভায় যাবেন না। দেশের অনেক কিছুর মতোই এমনকী অ্যাঙ্করদের ক্ষেত্রে আমরা ওরা, ইনি আমাদের, উনি ওদের, এরকম তো ছিলই। কিন্তু এখন তা অফিসিয়ালি ঘোষণাও হয়ে গেল। মনে আছে, জল খাব বলে ক্যামেরা বন্ধ করে, দোস্তি বনি রহে বলে সাক্ষাৎকার ছেড়ে পালিয়ে যেতে দেখেছি আমরা নরেন্দ্র মোদিকে, জীবনে আর কোনওদিন করণ থাপারের মুখোমুখি হননি তিনি। মনে আছে আমাদের ২০১৫ থেকেই রবিশ কুমার বা রাজদীপ সরদেশাই বা পূণ্য প্রসুন বাজপেয়ীর শোতে বিজেপির মোদিজি, অমিত শাহ, যোগী ইত্যাদিরা যাওয়া বন্ধ করেছিলেন, ঘোষণা করে নয়, যেতেন না। এখন বিরোধী দলের নেতারা সিদ্ধান্ত করেই জানিয়ে দিলেন যে আমরা এই অ্যাঙ্করদের অনুষ্ঠানে যাব না। এটাকে সাংবাদিকতার উপরে এক মস্ত আঘাত হিসেবে দেখছে বিজেপি। বিজেপি নেতারা জানিয়েছেন, এর ফলে গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ দুটোকেই অপমান করা হল, এই সিদ্ধান্ত নাকি জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধী নিয়েছিলেন, আবার নাকি রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। আসুন এ নিয়ে দু’ চারটে কথা বলা যাক। কিন্তু তার আগে বিজেপি নেতাদের গলায় এই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি শোনার পরে আমার সমানে মনে হচ্ছে এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে, এই ডায়ালগটা। ভাবুন একবার, যে দলের প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকতে পারলেন না, ডাকলেন না, তাঁর দল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, চতুর্থ স্তম্ভ ইত্যাদির কথা বলেই যাচ্ছে। দেশের সিনিয়রমোস্ট সাংবাদিকদের ডাকুন, ১ ঘণ্টার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সামনে বসুন, অনুষ্ঠানটা লাইভ করে দেওয়া হোক, দুধ কা দুধ পানি কা পানি হো যায়েগা।
প্রথমত, উনি এরকম ভয়ঙ্কর, হ্যাঁ ওঁর কাছে এটা ভয়ঙ্কর, বিভীষিকা, এর সামনে উনি প্রাণ গেলেও বসতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত আমরা জানি, উনিও জানেন জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ করে দেবেন সাংবাদিকেরা। তিনি আজ পর্যন্ত বসেননি, এর পরেও বসবেন না। সেই দলের নেতাদের মুখে চতুর্থ স্তম্ভের কথা? এত বড় একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল, প্রতিটা দেশের জি টোয়েন্টি সামিট বা এরকম ধরনের সম্মেলনের শেষে হোস্ট কান্ট্রি সারা পৃথিবীর সাংবাদিকদের সামনে এসে বসেন, সম্মেলনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন, আলাপ আলোচনা করেন। এবারে হয়েছে, এই প্রত্যেকটা অ্যাঙ্কর আমন্ত্রিত ছিলেন, আমাদের বাংলা থেকেও চোখে চোখ রাখা এক চিল্লানোসরাসের ছানা সেখানে গিয়েছিলেন, কোনও প্রশ্ন করতে পেরেছেন? একটা প্রশ্ন? কেউ একজনও জিজ্ঞেস করেছেন যে এই অদ্ভুত শান্তি ডিক্লারেশন, ঘোষণাপত্রের মানে কী, যেখানে ওই শান্তির ছেলে রাশিয়ার নামই নেই? কেন নেই? প্রশ্ন করবেন কাকে? সেরকম কোনও ব্যবস্থাই নেই। ২০১৪ সাল থেকে গীতা পাঠ চলছে। অর্জুন একটাই মাত্র প্রশ্ন করেছিলেন, ব্যস, তারপর উত্তর দিয়েই যাচ্ছেন ধনঞ্জয়, আর কোনও প্রশ্ন নয়, মামেকং স্মরণং ব্রজ। আমাকে স্মরণ করলেই হবে। যে দলের আমলে দেশের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স নামছে, ক্রমশ তলায় নামছে, তাঁরা মানে সেই দল বিরোধীদের এই বক্তব্যতে কেঁদে আকুল, আহারে, আমাদের দেশের সাধের প্রেস ফ্রিডম এতদিনে বিপন্ন হতে চলল, তাও আবার দেশের বিরোধীদের কারণে। কয়েকটা ধামাধরা সাংবাদিক আর এক আদেখলা সিনেমা অভিনেতাকে নিয়ে এসে যে দলের সর্বোচ্চ নেতা আপনি আম চুষে খান না চেটে খান না কেটে খান? আপনি ঘুমোন কখন? এত কাজ করে আপনার ক্লান্ত বোধ হয় না গোছের প্রশ্নের উত্তর দিতে বসেন যে নেতা তাঁর দলের নকড়া ছকড়ারা সাংবাদিকদের স্বাধীনতার কথা বলছেন।
বিজেপি দল আর নেতাদের কথা বাদই দিলাম, ওই গোদি মিডিয়ার ওই গোদি অ্যাঙ্করেরা কী বলছেন? চ্যানেলে চ্যানেলে মিটিং শুরু হয়ে গেছে, কারণ? আরে বাবা কারণ তো একটাই, মধুভাণ্ডে টান পড়বে না তো? ওসব গণতন্ত্র, চতুর্থ স্তম্ভ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ওসব ওঁদের কাছে কোনও বিষয় কোনওদিন ছিল না, আজও নয়। কাছাখোলা হয়ে বিরোধিতা তো চলছিল, এখন ট্যাঁকে টান পড়লে সামলাবে কে? মানে বিরোধীদের দিকেও তো ১৪ জন মুখ্যমন্ত্রী আছেন, যদি বিজ্ঞাপনও বন্ধ হয়। এমনকী হতেও তো পারে ২০২৪-এ উল্টো খেলা, তখন সামলাবে কে? অতএব চ্যানেলে চ্যানেলে মিটিং চলছে, কীভাবে এই ধাক্কা সামলানো যায় তার চিন্তাভাবনা চলছে। ধাক্কা কেন বলছি? ধাক্কা বলছি কারণ প্রোগ্রামগুলো মন দিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। ধরুন সনাতন ধর্মের ওপর আঘাত নিয়ে আলোচনা। প্যানেলে ডাকা হয়েছে একজন বিজেপি নেতাকে, একজন লেখককে যিনি হয়তো অমিত শাহের জীবনি লিখেছেন, ডাকা হয়েছে একজন সমাজকর্মীকে যিনি এবারে মোদি সরকারের দৌলতে পদ্মশ্রী পেয়েছেন এবং কংগ্রেসের একজনকে। তিন প্লাস একজন অ্যাঙ্কর উল্টোদিকে একলা জগাই। কিন্তু তারপরেও তিনি যেই বলতে যাচ্ছেন, ওমনি দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো বলে চিল চিৎকার করে আরেকটা প্রশ্ন করা হচ্ছে যার উত্তর দিচ্ছেন ওই তিনজনের একজন। কংগ্রেসের প্রতিনিধি হাত তুলে বসে রয়েছেন, টানা ১৭ মিনিট অপেক্ষার পরে তাঁকে বলতে দেওয়া হল, তিনি বলতে শুরু করার এক মিনিটের মধ্যে আবার চিৎকার, দিস ইজ শেম, ডোন্ট ইউ থিঙ্ক দ্য রুট কজ অফ দিস প্রবলেম ইজ জওহরলাল নেহরু? দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো, ব্যস আবার ওই সমাজকর্মী বলতে শুরু করলেন। এক সার্কাস চলছে, প্যানেলে ডেকে এনে হ্যাটা করছেন, চ্যানেলে ভক্তদের ভিড়, টিআরপি বাড়ছে। এবার ভাবুন ওই বিরোধী নেতা নেই, কাকে হ্যাটা করা হবে? কেন জড়ো হবেন ভক্তরা? তাঁরা না দেখলে টিআরপির কী হবে? সমস্যা সেখানেই, কাজেই চ্যানেলে গিয়ে হ্যাটা হওয়ার থেকে না যাওয়া ভাল। বিরোধীরা চ্যানেল বয়কট করছেন না, সংবাদমাধ্যমকে শর্ত দিচ্ছেন না, কেবল বলেছেন উনি থাকলে আমরা যাব না। ক’দিনের মধ্যে গাছে ফল ও ফুল দুটোই ফলবে, মিলিয়ে নেবেন।
এবং তিহাড়ি সুধীর চৌধুরি, যিনি নোটবন্দির সময়ে নতুন ২০০০ নোটে চিপ খুঁজে পেয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন এই চিপ নাকি মাটির তলাতেও থাকলে সিগন্যাল দেবে এবং সরকার চাইলেই বার করে ফেলতে পারবে। হ্যাঁ এঁর চাটুকারিতা এই লেভেলের, আপাতত এঁর একনিষ্ঠ শিষ্য এ বাংলার চোখে চোখ রেখে সচ বোলনেওয়ালা একদা বাম, এখন রাম সাংবাদিক। তো এঁরা দুজনেই বলেছেন যে, বিরোধীরা কঠিন প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই এই সমস্ত অ্যাঙ্করদের বয়কট করলেন। কঠিন প্রশ্ন? যাঁরা ৯ বছর ধরে এক সরকার ক্ষমতায় আছে তার প্রধানকে একটা প্রশ্নও করে উঠতে পারলেন না, তাঁরা কঠিন প্রশ্নের কথা বলছেন? সাংবাদিক কাকে প্রশ্ন করে? ক্ষমতায় যারা বসে আছে না বিরোধীদের? এই অসাংবাদিক সরকারের বেতনভুক ভেড়ার দল কাদের প্রশ্ন করছে? আচ্ছা মাত্র গতকাল কী হয়েছে? কাশ্মীরে আবার জঙ্গি আক্রমণ হয়েছে, আমি আমার প্রোডিউসারকে বলব আমার বাঁদিকে ওই ছবিটা চালান। সেনার একজন মেজর, একজন কর্নেল এবং রাজ্য পুলিশের একজন ডিএসপি ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছে, একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় ছিলেন, তিনিও আজ মারা গিয়েছেন। ছবিগুলো দেখুন, কাশ্মীর পুলিশের ডিএসপি মৃত, তাঁর সন্তানের বয়স ২৯ দিন, তাঁর বৃদ্ধ পিতা যিনি নিজেও পুলিশকর্তা ছিলেন তিনি হাজির, পরিবারের মা, স্ত্রী, আত্মীয়রা কাঁদছেন। এবার অন্যধারে ছবি দেখুন, বিজেপি হেডকোয়ার্টারে, ওই একই সময়, দায়িত্ব নিয়েই বলছি ওই একই সময়, প্রধানমন্ত্রী, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, বিজেপির সভাপতি জে পি নাড্ডা ফুলের কার্পেটে হাঁটছেন, ফুল বর্ষণ হচ্ছে, উৎসব হচ্ছে। কীসের সেলিব্রেশন? সেনাবাহিনীর কর্নেল, মেজর, রাজ্য পুলিশের ডিএসপির মৃত্যুর সেলিব্রেশন? কী চলছে সেখানে? এই সুধীর চৌধুরি, বা এই বাংলার চোখে চোখ রাখা মাথায় ভুসো ঠাসা সাংবাদিক প্রশ্ন করতে পারবেন প্রধানমন্ত্রীকে, কীসের সেলিব্রেশন চলছিল? আপনারা জানতেন না এই ঘটনার কথা, দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওখানে থাকাটা জরুরি ছিল না? উৎসব স্থগিত রাখা উচিত ছিল না? এই প্রশ্ন করার ধক আছে? নেই। জি টোয়েন্টি-তে আয়োজক দেশ আমরা, আমাদের পতাকা নিয়ম অনুযায়ীই আগে থাকবে, তো এই মেরুদণ্ডহীন সাংবাদিকেরা আমাদের দেশের পতাকা আগে আছে, দেশ কত এগিয়ে গেছে, এসো সেলিব্রেট করি গোছের অশিক্ষিত আলোচনায় মত্ত থাকবে। এদের প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার সাহস নেই যে পৃথিবীতে আমাদের দেশের মানুষের মাথা পিছু আয় ১২৯-এ কেন? এই জি টোয়েন্টির ২০টা দেশের সব্বার তলায় কেন? না এ প্রশ্ন তাঁরা করতে পারবে না, কারণ এঁদের পেট চলে সরকারি দক্ষিণায়, সকারি আনুকূল্যে। বিরোধীরা বলেছেন এঁদের অনুষ্ঠানে আমরা থাকব না। বেশ করেছেন, এর সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কোনও সম্পর্ক নেই।