প্রতিবাদী কণ্ঠ নিয়ে চিরটাকাল অস্বস্তিতে থাকে শাসকদল। সে হিটলারই হোক, স্তালিনই হোক, মাও হোক বা ইন্দিরা গান্ধী। প্রত্যেক ক্ষমতাধর শাসকের কাছে প্রশ্ন করা মানুষগুলো বড্ড খারাপ, বড্ড ওঁচা। নামে বিরাট গণতন্ত্র, কিন্তু খোদ আমেরিকাতেও রাতবিরেতে সাংবাদিককে তুলে জেলে পোরার ঘটনা ঘটেছে বইকী। ক্ষমতা প্রতিবাদকে ভয় করে, প্রশ্নকে এড়াতে চায়। আমাদের আপাতত চৌকিদার তো এই বিষয়ে তাঁদের গুরুদেব হিটলারের সমগোত্রীয়। কঠিন প্রশ্নের সামনে মুখে অসম্ভব দেখে নেব ট্যাগ ঝুলিয়ে জল খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি স্বাধীন সাংবাদিকদের সামনে বসেন না। এই প্রথম এক দেশের প্রধানমন্ত্রী যিনি কোনও প্রেস কনফারেন্স করেন না কারণ ওই যে প্রশ্ন। তাঁর আমলে প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স নেমেছে, সাংবাদিক খুন হয়ে গিয়েছে, আর আপাতত সাতজন সাংবাদিক জেলে গিয়েছেন। ইরান, মায়ানমার, বেলারুশ, চীন, টার্কির পরেই ভারতের নম্বর, ওই সাংবাদিকদের জেলে পোরার হিসেবে। সিদ্দিক কাপ্পান ২ বছর পরে ছাড়া পেয়েছেন, তিনি উত্তরপ্রদেশের হাথরসের ঘটনার হদিশ পেতে সেখানে যাচ্ছিলেন। এই সাংবাদিককে জেলে পোরা হয়, তারপর ২ বছর ২ মাস পরে ছাড়া পেয়েছেন। গৌতম নওলাখা, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির কনসাল্টিং এডিটর, তিনি গত তিন বছর ধরে জেলে ছিলেন, এখন গৃহবন্দি। মানান দার জম্মু কাশ্মীরের সাংবাদিক দেড় বছরের মতো জেলেই ছিলেন, সৈয়দ গুল, ফহাদ শাহ, কাশ্মীর ওয়ালা পোর্টালের সাংবাদিক, এদেরও জেলে পোরা হয়েছিল। আমরা এসবের বিরোধিতা করি, নরেন্দ্র মোদি বা বিজেপি বিরোধী দলের মানুষজন এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু যদি সেই একই ঘটনা এই রাজ্যতেও হয়? তাহলে কি আমরা চুপ করে থাকব? কিছু বলব না? একজন সাংবাদিককে যদি অন্যায়ভাবে জেলে পোরা হয়, তাহলে আমরা কথা বলব না? বিষয় আজকে সেটাই, সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচীর মুক্তি চাই।
দেবমাল্যর দোষটা কোথায়? স্থানীয় তোলাবাজদের সিন্ডিকেটে না থেকে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা? প্রশ্ন করা কেন বেআইনি চোলাইযন্ত্রের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মানি আর মাসল? টাকা, ক্ষমতা? স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা আর পুলিশ? প্রশ্ন করলেই অন্য কাউকে দিয়ে একটা মামলা করা হবে, সেই মামলায় পুরে দেওয়া হবে জেলে, এরকমই চলবে? সে মানুষ খুন করেনি, তার ঘর থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর জমির দলিল মেলেনি, তার বেআইনি কোম্পানি নেই, সেখানে গরুপাচার বা কয়লা পাচার হত না। তাহলে? সে এখনও জেলে, ১০ দিন হয়ে গেল, সে জেলে, তার স্ত্রী আছে, কন্যা আছে, সামাজিক মর্যাদা আছে। এটুকু বজায় রেখে যদি সাংবাদিকতা না করা যায়, তাহলে কীসের পরিবর্তন?
আমরা জানি না? স্থানীয় নেতাদের কতটা সমর্থনে চোলাই কারখানাগুলো চলে, ব্লাডারে, জ্যারিকেনে, পাউচে ভরে সে চোলাই যখন ছড়ায় বিভিন্ন প্রান্তে তখন পুলিশের কতটা যোগসাজশ থাকে তা কি আমরা জানি না? না কি পুলিশ অফিসারেরা জানেন না, না কি আমাদের মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীরা জানেন না? জানেন না সেই পরিবর্তনের পক্ষে এখনও প্রেস ক্লাবে এসে বৎসরান্তে প্রতিবাদ ঠুকে যাওয়া বুদ্ধিজীবীরা? জানেন না সংবাদপত্রের হনুরা? ক’টা এডিটোরিয়াল বের হল? কতজন প্রতিবাদ করলেন? চোখের সামনে সম্পূর্ণ নির্দোষ একটি ছেলে জেলে, কেন? কারণ সে বেআইনি চোলাই মদ নিয়ে খবর করেছিল। ক’দিন পরে এখানে বিষ চোলাইয়ে মারা গেলে খবর হত, ছেলেটি তার আগেই করেছে, সে জেলে। এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হবে, হবেই, সেই জনমতকে বিজেপি কাজে লাগাবে, সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের উপর এই আক্রমণ মেনে নেওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। আমরাও চাই দেবমাল্যর নিঃশর্ত মুক্তি। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, বিজেপি সরকারের সংবাদমাধ্যমের উপর প্রতিনিয়ত তীব্র আক্রমণ আমরা জানি, কিন্তু খবর করার অপরাধে মমতা সরকারের আমলেই সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনাকে আপনারা কীভাবে দেখছেন?
কারখানায় কর্মরত কিছু শ্রমিকদের সঙ্গে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের কথাবার্তা হচ্ছিল। বিপ্লব হয়ে গেছে, সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবার লেনিন বিভিন্ন রচনায় লিখছেন বিপ্লবের পরে কী করিতে হইবে, এই রকম কিছু লেখা। তো জিজ্ঞেস করেছিলেন এক শ্রমিককে, তোমাদের সংগঠনের খবর কী হে? লেনিনকে সেই শ্রমিক বলেছিল, বিপ্লব হয়ে গিয়েছে, শ্রমিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সংগঠন আর কী করবে? লেনিন বলেছিলেন শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার লড়াই করবে, যতদিন শ্রেণি আর রাষ্ট্র আছে, ততদিন শ্রেণির লড়াইটা শ্রেণিকে লড়ে যেতেই হবে। হ্যাঁ, অমন রুশ বিপ্লবের পরেও লেনিনের কথায় শ্রমিক স্বার্থরক্ষার লড়াই লড়ে যেতে হয়। সে লড়াই বন্ধ হয়েছিল, ফলাফলও আমাদের জানা। আর এ তো এক সাধারণ সরকারের পরিবর্তন, কিন্তু সেই পরিবর্তন যাঁরা আনলেন, সব্বাই এখন ঘুমিয়ে কাদা। সেই সুযোগে রাষ্ট্র কাড়ছে গণতান্ত্রিক অধিকার, এর বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে, বলতেই হবে যে অবিলম্বে নিঃশর্তে সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচীর মুক্তি চাই।