ইতালিয়ান ভাষায় ফাসিও বলে একটা শব্দ আছে। মানে হল, বেশ কয়েকগাছা শক্ত লাঠি একসঙ্গে বাঁধা, মানে জোরালো একটা অস্ত্র। তো উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের দিকে বিশ্বজুড়ে মন্দা চলছে, ইউরোপেও মন্দা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে চূড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়। তার ছোঁয়া ইতালিতেও লেগেছে, ছাঁটাই চলছে, শ্রমিকদের কাজ নেই, কারখানার মালিকরা গুন্ডা পুষছে, শ্রমিক বিক্ষোভ থেকে বাঁচতে। সেই সময়ে কিছু লোক একত্রিত হল, পরিত্রাতার মতো এগিয়ে এল, নিজেদেরকে ফাসিস্ত বলল, ঐক্যবদ্ধ অস্ত্র। শ্রমিকরা ভাবল তাদের পক্ষের মানুষ, মালিকরা জানত, তাদের পয়সায় মানুষ। তারা সমাজতন্ত্রের কথা বলল, তারা শ্রমিক অধিকার, মজুরির কথা বলল, বাহিনী তৈরি করার কাজে মন দিল। এবং এক নেতাও পেয়ে গেল, বেনিতো মুসোলিনি। ক্রমশ ইতালির ক্ষমতা দখল, হিটলার মুগ্ধ এই নয়া জারকে দেখে, হিটলারের মতো এক গোঁয়াড় অথচ উঠতি নেতাকে চিনতে ভুল করলেন না মুসোলিনিও, ফাসিস্ত দর্শন বিকশিত হল, ফাসিস্ত বাহিনী তৈরি হল। যুদ্ধে বিধ্বস্ত জার্মানির অর্থনীতির হাল ধরল ফাসিস্তরা, রাস্তা তৈরি হতে লাগল, পুঁজি আসতে লাগল বিশ্ব থেকে, বিরাট পুঁজি এল আমেরিকা থেকে, অর্থনীতি খানিকটা ঘুরে দাঁড়াল, ব্যস। দেশসুদ্ধু মানুষ, জার্মান মানুষ হিটলারকে দেবতার আসনে বসানো শুরু করল। এমন নয় যে হিটলার অনায়াসে দেশের ক্ষমতায় এলেন, কিন্তু দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যেকার খেয়োখেয়ি, মতান্তর, মনান্তরকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে, সংসদীয় ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েই একসময় হলেন চ্যান্সেলার, তারপরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, নাৎসিরা ততদিনে দখল করেছে সবকিছু। পুঁজি তাদের হাতে, সংসদ তাদের হাতে, সেখানে আর কোনও বিরোধিতা নেই, সংবাদমাধ্যম তাদের হাতে, বিরোধীরা হয় মারা গেছে, নয় জেলে। ইহুদিদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, ইহুদিরা জাতীয় শত্রু। তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই, কিন্তু মারা হবে কীভাবে? তৈরি হল পার্মানেন্ট সলিউশন টু দ্য জিউস কোয়েশ্চেন, ইহুদি সমস্যা মেটানোর স্থায়ী ব্যবস্থা। কী ব্যবস্থা? ইহুদিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাও। বৃদ্ধ, শিশু, অশক্তদের মেরে ফেলো, যুবক যুবতীরা কাজ করুক, বিনা পারিশ্রমিকে কাজ, তারপর তারা বৃদ্ধ হলে তাদেরও মেরে ফেলো। এমনকী সাধারণ মানুষও হয়ে গেল চূড়ান্ত ইহুদি বিরোধী, এরপর একের পর এক দেশ দখল, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ডেনমার্ক, হল্যান্ড। শুরু হয়ে গেল বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। একধারে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া। অন্যদিকে জার্মানি, ইতালি, জাপান। ছোট ছোট দেশ বা দেশের মানুষ পক্ষ নিল বেছে, একটা সময় যখন যুদ্ধে হারল জার্মানি, ইতালি, জাপান, অক্ষশক্তি, তার আগেই বেনিতো মুসোলিনিকে পিটিয়ে মেরে তাঁর বান্ধবী সহ তাঁদের দেহ ঝুলিয়ে দিয়েছে ইতালির মানুষ। হিটলার, তাঁর সদ্য বিবাহিত বান্ধবী, গোয়েবলস, তাঁর ৭ সন্তান সহ পরিবার আত্মহত্যা করেছেন, আর যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির প্রত্যেক শহর তখন ধ্বংসস্তূপ, পৃথিবীর ৮ কোটির বেশি মানুষ মারা গেছে এই যুদ্ধে, এক ফাসিস্ত দর্শনের শিকার পৃথিবীর ৩ শতাংশ জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কথা বাদই দিলাম। যুদ্ধের পরে মানুষ এই ফাসিস্ত দর্শনকে বোঝার চেষ্টা করেছে, কীভাবে এই দর্শনকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, কীভাবে এই দর্শন ছড়িয়ে দেয় তার শিকড়, কীভাবে বোঝা যায় ফাসিস্তদের পদধ্বনি।
আমেরিকার হলোকাস্ট মিউজিয়ামে, লরেন্স ডাবলিউ ব্রিটের লেখা এক ফলক রয়েছে, যাতে ১৪টা এমন চিহ্নের কথা, ১৪টা এমন প্রবণতার কথা বলা হয়েছে, যা দেখে বোঝ যাবে ফাসিস্তরা আসছে। আগামী বিশ্বের মানুষরা, যাতে সহজেই ফাসিবাদকে চিহ্নিত করতে পারে, ফাসিবাদকে চিনে নিয়ে শুরুতেই তার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াই করতে পারে, আর যাতে ফাসিবাদ ফিরে না আসে, তার জন্য এই ১৪টা প্রবণতার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে ফলক মানুষ দেখে, তাদের মনে পড়ে যায় ফাসিস্তদের উত্থানের কথা। আসুন দেখে নিই, লরেন্স ডাবলিউ ব্রিট কোন প্রবণতার কথা বলেছেন, মিলিয়ে নিই আমাদের দেশের সঙ্গে।
প্রথম প্রবণতা হল এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদ, মানে দুনিয়াতে এই একটাই দেশ আছে, দেশ মানে আমার দেশ, বাকি সব কেউ কিচ্ছু নয়, কেউ যদি ক্রিকেট খেলাতেও পাকিস্তানের কোনও ব্যাটসম্যানের ছক্কার পরে হাততালি দেয়, তাহলে সে দেশদ্রোহী। হঠাৎ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশদ্রোহী পাওয়া যেতে থাকে, দেশদ্রোহীদের জেলে পোরা হতে থাকে, ভারতবর্ষে ২০১৬তে ৩৯৬২ জন, ২০১৭তে ৪৪৫১ জন, ২০১৮তে ৫১০২ জন, ২০১৯এ ৫১৩৪ জন ২০১৮–২২এ ৫০২৩ জনের বিরুদ্ধে হয় দেশদ্রোহিতা না হলে ইউএপিএ আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে, এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদের পদধ্বনি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির ৫৬ ইঞ্চির ছাতি এখন কুঁকড়ে সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি
দুই নম্বর প্রবণতা হল, মানবাধিকারের চূড়ান্ত অবমাননা। তাকিয়ে দেখুন, কৃষকরা, দেশের অন্নদাতারা দেশের রাজধানীতে যেন না ঢুকতে পারে তার জন্য, সিমেন্টের ব্যারিকেড, দেশের সীমানায় যে কাঁটাতার ব্যবহার করা হয়, সেই কাঁটাতার লাগানো হচ্ছে, তাদের ট্রাক্টরের চাকা যাতে না এগোতে পারে, তার জন্য বিছানো হচ্ছে লোহার কাঁটা, তাদের জল আলো কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ তারা দেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার, সমাবেশ করার অধিকার, বিরোধিতা করা অধিকারের দাবি নিয়েই জড়ো হয়েছেন, মানবাধিকারের এই নির্লজ্জ পতন দেখা যায়, যখন এক অসুস্থ ৮২ বছরের কবিকে জেল থেকে জামিন দিতে, আদালতেরই লেগে যায় দেড় বছর, এক ৮৩ বছরের মিশনারি পাদ্রিকে জেলে পুরে মেরে ফেলা হয় প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মিথ্যে অভিযোগে, এক ছাত্রনেতা উমর খালিদ, এক গবেষক আজ জেলের ভিতরে। কেন? সে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছে, এই জন্য?
তিন নম্বর প্রবণতা হল, এক কল্পিত শত্রু তৈরি করা, তাদের জন্যই দেশ, জাতি, ধর্ম নাকি বিপদে, এমন প্রচার করা। কোনও কারণ ছিল না, হিটলার জার্মানির অধোগতির জন্য, ইহুদিদের দায়ী করেছিলেন, ইহুদিদের সরাতে পারলেই, জার্মানি ফিরে পাবে তার গৌরবজ্জ্বল অতীত, ইহুদিরা সভ্যতার শত্রু। আজ আমাদের দেশের শাসকরা মুসলমানদের দিকে, সংখ্যালঘুদের দিকে আঙুল তুলছেন, তারা নাকি হু হু করে জনসংখ্যায় বাড়ছে, তাদের নাকি চারটে পাঁচটা করে বিয়ে, তাদের নাকি ৭টা ৮টা করে সন্তান হচ্ছে, সব তথ্য মিথ্যে, ডাহা মিথ্যে। কিন্তু তা প্রচার হচ্ছে, মানুষের কাছে সেই প্রচার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিছু মানুষ বিশ্বাসও করছেন। মানে আমাদের দেশেও এক কল্পিত শত্রু তৈরি করা হয়েছে, সংখ্যালঘুরা সেই শত্রু।
র্যামপ্যান্ট সেক্সিজম, চতুর্থ প্রবণতা। মহিলাদের ছোট করো, আরও ছোট করো, মহিলারা ঘরের মধ্যেই থাকুক, তাদের জায়গা রান্নাঘরে, কাজ বাচ্চার জন্ম দেওয়া, নারী নরকের দ্বার, অভিনেত্রী মানে দেহ ব্যবসায়ী, রাতে বাড়িতে ফেরে মানে যৌনকর্মী। আজ আমাদের দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, শাসকদলের মহামান্য নেতারা এই কথাগুলো পরিষ্কার বলছেন।
পঞ্চম প্রবণতা বা চিহ্ন হল বিকিয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যম, আমাদের এই চতুর্থ স্তম্ভ প্রচার হওয়ার পরেই তা ইন্টারনেটে দেওয়া হয়, সেখানে দর্শকদের মতামত দেখুন, ম্যাডাম, কীভাবে এই ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন? বাকি সব তো বিকিয়ে গেছে! সাধারণ মানুষও জানেন যে মিডিয়া এখন গোদি মিডিয়া, মিডিয়া এখন হয় টু বি সোল্ড, না হলে সোল্ড। হয়ে বেচে দেওয়া হয়েছে, না হলে বিক্রি হওয়ার জন্য তৈরি আছে, সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন তলানিতে। অন্যদিকে তা ক্রমশ হয়ে উঠছে শাসকের মুখপত্র, তাদের গলা, তাদের চোখ।
ষষ্ঠ প্রবণতা হল, জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে কল্পিত উত্তেজনা। এই যুদ্ধ লাগল বলে, এই চীন আসছে, এই পাকিস্তান আসছে, এই বুঝি তারা আমাদের দেশ দখল করে নেবে, যখনই প্রশ্ন ওঠে বস্ত্র কি খাদ্য, সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য, সিয়াচেন মে জওয়ান খড়ে হ্যায়, তার সমস্যা দেখব না তোমার?
সপ্তম প্রবণতা হল সরকার আর ধর্মকে এক জায়গায় এনে ফেলা, একটা ধর্মকেই সরকারি প্রাধান্য দেওয়া, সেই ধর্মের বিরোধিতাকেই সরকারের বিরোধিতা, এটা প্রত্যেককে বোঝানো। এটা তো বুঝিয়ে বলার দরকারই নেই, আমাদের দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রধানমন্ত্রী নিজে হিন্দু ধর্মের প্রচার করছেন, অন্য সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। প্রশ্ন করলে, বিজেপি নেতাদের সাফ কথা, হিন্দু রাষ্ট্রে হিন্দুদের মত মেনেই থাকতে হবে, কোনও লুকিয়ে রাখার ব্যাপারই নয়, প্রকাশ্যেই বলছেন।
অষ্টম প্রবণতা আছে কর্পোরেট শক্তিকে ঢালাও সাহায্য করা, এখন তো, আমাদের দেশে সাহায্য করার ব্যাপারটা তুলে দিয়ে সরকারটাই কর্পোরেট মালিকদের ভৃত্যের মতো কাজ করছে, সরকার দেশের মানুষের জন্য নয়, কর্পোরেট মালিকদের জন্য কাজ করছে।
নবম প্রবণতা, শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখা। জার্মানিতে যখন নাতসিরা পুরোপুরি ক্ষমতায় চলে এসেছিল, তখন ইউরোপে জার্মানির মতো বিকশিত দেশেও কাজের ঘণ্টার সীমা তুলে দেওয়া হয়েছিল, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, চাকরি থাকত কারখানার মালিকের শর্তে, যে কোনও শর্তে রাজি না হলেই ছাঁটাই। আজ আমাদের দেশের নতুন শ্রম আইন, হুবহু সেই কথাই বলছে, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারই থাকবে না, এই নিয়ম চালু হলে, তাদের চলতে হবে মালিকের নির্দেশ মতো।
দশম প্রবণতা, অপরাধ এবং তার শাস্তি নিয়ে আইন বহির্ভূত চিন্তাভাবনা। মানে বিচার ইত্যাদির দরকার নেই, ধর্ষণ করেছে, গুলি করে মেরে দাও, আবার বিচার টিচার কেন? এবং এর ফাঁকে বিরোধীরাও গুলি খেয়ে মরবে, বা জেলে থাকবে। তাকিয়ে দেখুন ভারতবর্ষের দিকে, ঠিক এই প্রবণতা আজ বাড়ছে। এমনকী মানুষও বিশ্বাস করছেন ওসব বিচার টিচার করার দরকার নেই, অভিযুক্তদের গুলি করে মেরে ফেলাই যায়, সভ্য সমাজে এ ধরনের কথা যে চিন্তাতেও আনা যায় না, সে কথা বলার লোক কম।
আজ ১০টা প্রবণতার কথা বললাম, বললাম যে এই প্রবণতাগুলো আমাদের দেশের এই সময়ের সঙ্গে কতটা মিলছে, বাকি আর ৪টে প্রবণতা নিয়ে কাল কথা হবে, মিলিয়ে নেওয়া হবে প্রবণতা, চিহ্নিত করা হবে ফাসিস্তদের, কাল দেখা হচ্ছে।